
চর্যাপদের আবিস্কার– ১৯০৭ খ্রি পূর্ববঙ্গের প্রখ্যাত মনীষী ও পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় ডঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকালে তার গবেষণাকাজের সহযোগিতার জন্য নেপালের রাজেন্দ্রলাল মিত্রের আমন্ত্রণে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির অর্থায়নে নেপালে গমন করেন এবং নেপালের রাজ গ্রন্থশালা পরিভ্রমণকালে চর্যাপদের হাতে লেখা ৪ খানি পুঁথি উদ্ধার করেন। পুঁথি ৪ টি হল-
১) চর্যাচর্যবিনিশ্চয়
২) কাহ্নপাদের দোহা
৩) সরহপাদের দোহা
৪) ডাকার্ণব
২। চর্যাপদের আবিস্কারক– হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), তার উপাধি-মহামহোপাধ্যায় ১৮৯৮ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে এই উপাধি দেন। তিনি ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের(তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) তত্ত্বাবধানে এশিয়াটিক সোসাইটির অর্থায়নে পি এইচ ডি করেন যার বিষয় ছিল- পূর্ববাংলার ভাষা, সাহিত্যের ইতিহাস আদি সাহিত্য, সংস্কৃত।গবেষণাকালে তিনি নেপালের রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের একটি গ্রন্থ পান যার নাম– Sanskrit Buddhist Literature in Nepal (1882)। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নেপাল গমন করেন এবং চর্যাপদ আবিস্কার করেন।
৩। চর্যাপদের
টীকাকার এবং তার কাজ– সংস্কৃত
টীকাকার মুনিদত্ত। তিনি চর্যাপদের ৪ টি পুঁথি লিখেন। এতে ধারাবাহিকভাবে নিম্নোক্ত কাজগুলো করেন-
১) তিনি মুলপদগুলো লিখেন। চর্যাপদের কবিতাগুলা প্রতিটি ৮/১০/১২ ও ১৪ চরণের ছিল। এর মধ্যে সর্বাধিক কবিতা ১০ চরণ।
২) এরপর তিনি পদগুলোকে সমকালীন বাংলায় রূপান্তরিত করেন।
৩) এবং প্রতিটি পদের
টীকা ভাষ্য প্রদান করেন।
*তবে ১১ নং পদটি
টীকাকার কর্তৃক ব্যাখ্যা করা হয়নি।
৪। চর্যাপদের কতজন কবির কোন পদ পাওয়া যায় নি? এ সম্পর্কে যেটি জানেন লিখুন।
১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত চর্যাপদে পাওয়া পদের সংখ্যা ছিল সাড়ে ছেচল্লিশটি যার পদকর্তা ২২ জন। কিন্ত সংস্কৃত
টীকাকার মুনিদত্তের
টীকায় ২৪ জন পদকর্তার নাম পাওয়া গিয়েছিল। সেদিক থেকে ২ জনের কোন পদ পাওয়া যায় নি বলা হয়। এরা হলেন- (১) তন্ত্রী পা (২) লাড়ীডোম্বী পা
কিন্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর ১৯৩৮ সালে ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের ১ টি তিব্বতী অনুবাদ আবিস্কার করেন। যার মধ্যে ২৫ নং পদের পদকর্তা হিসাবে তন্ত্রী পার নাম পাওয়া গেলেও লাড়ীডোম্বী পার কোন পদই পাওয়া যায় নি।
৫। চর্যাপদের ভাষা– চর্যাপদে ৫টি ভাষার মিশ্রণ রয়েছে। যথা-
১) বাংলা- ৬০%
২) হিন্দী- ১০%
৩) মৈথিলি- ১০%
৪) অসমীয়া- ১০%
৫) উড়িয়া- ১০%
চর্যাপদের ভাষাকে প্রাচীন বাংলা বলে প্রতিপন্ন করেন প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। এ সম্পর্কিত তার লিখিত দাবী প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে ODBL গ্রন্থে।
পণ্ডিতগণ চর্যাপদের ভাষাকে সান্ধ্য বা আলো-আধারি ভাষা বলে অভিহিত করেছেন। সন্ধ্যাবেলায় গোধূলিলগ্নে আলো আঁধারের খেলা চলে। এ আলোতে যেমন স্পষ্ট অবয়ব বুঝা যায় না। তেমনি চর্যাপদের ভাষাও কিছুটা বুঝা যায় কিছুটা বুঝা যায় না।
৬। চর্যাপদের সম্পাদনা– ১৯১৬ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে আবিষ্কৃত ৪ টি পুঁথির সমন্বয়ে সাড়ে ছেচল্লিশ টি পদ নিয়ে “”হাজার বছরের পুরানা বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোহা”” নামে চর্যাপদ সম্পাদনা করেন।
পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে ৪ জন ভাষা বিজ্ঞানী চর্যাপদকে পুনরায় সম্পাদনা করেন। তারা হলেন-
১) ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
২) ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
৩) প্রবোধচন্দ্র বাগচী
৪) রাহুল সংকীর্তায়ন
৭। চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কার– ১৯৩৮ সালে কলকাতার বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী প্রবোধচন্দ্র বাগচী (হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর শিষ্য)নেপাল থেকে চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কার করেন। এর অনুবাদ করেন- কীর্তিচন্দ্র।
৮। চর্যাপদের বাঙালি কবি কারা ছিলেন?
যেহেতু চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি গ্রন্থ সেহেতু এর সকল পদকর্তাই বাঙালি ছিলেন। তবে এখানে বাঙালি কবি বলতে পূর্ব বাংলা তথা অত্র এলাকার বাঙালি কবিদের কথা বলা হয়েছে। এরুপ ২ জন পদকর্তা হল শবর পা এবং ভুসুকু পা।
শবর নামের অর্থ ব্যাধ বা শিকারি
পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালিরা আদিকাল থেকেই শিকারী বৃত্তের সাথে জড়িত ছিলেন, তাই শবর পা কে এই বঙ্গের কবি বলা হয়।
অপরদিকে ভুসুকু পার কবিতায়ও শিকারীবৃত্তির চিহ্ন প্রতিফলিত হয়, তাছাড়া ভুসুকু পা তার ৬ নং পদে নিজেকে বাঙালি বলে দাবী করেছেন।
৯। চর্যাপদ কি গান? এ সম্পর্কে আপনার মতামত দিন।
বহু সমালোচকের মতে চর্যাপদ হল- “”বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সাধন ভজন সম্পর্কিত গানের সংকলন””
সৈয়দ আলী আহসান এটিকে চর্যাগীতিকা বলে অভিহিত করেছেন। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একে “”Buddhist mystic songs”” বলে অভিহিত করেছেন কারণ চর্যাপদের পদগুলোর মধ্যে ১৬টি গানের রাগ পাওয়া গিয়েছিল। তাই একে গানের সংকলন বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। চর্যাপদে প্রাপ্ত গানের রাগগুলো হল-
১) রাগ ভৈরবী
২) রাগ গুঞ্জরী
৩) রাগ পঠমঞ্জরী
১০। চর্যাপদের সাহিত্যমুল্য নিরূপণ– যদিও চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সাধন জ্ঞান সম্পর্কিত গানের সংকলন তথাপি এটি আবিষ্কারের পরে এর মধ্যে কয়েকটি সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে। সেগুলো হল- ভাষা, ছন্দ এবং অলংকারের যথাযথ প্রয়োগ।
১) চর্যাপদের ভাষা হল প্রাচীন বাংলা। এটি ১ম প্রমাণ করেন ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। বাংলা কোন ধর্মীয় ভাষা নয়।
২) ছন্দ হল কবিতা রচনার ধরন বা রীতি। ছন্দ ৩ প্রকার। যথা- স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত। চর্যাপদের পদগুলোতে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ প্রয়োগের কারণে এটিকে সাহিত্য বলে অভিহিত করা যায়।
৩) কবিতা চরণের সৌন্দর্যবর্ধনের নাম হল অলঙ্কার। অলঙ্কার ২ প্রকার। যথা-শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার। চর্যাপদে অর্থালঙ্কার এর অন্তর্ভুক্ত রূপক অলঙ্কার এর প্রয়োগ রয়েছে।
ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার এর প্রয়োগের কারণে চর্যাপদকে একটি স্বার্থক সাহিত্যকর্ম হিসাবে অভিহিত করা যায়
আরো পড়ুন: