৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি
পানামা পেপার্স
——-
পানামার আইনি প্রতিষ্ঠান মোস্যাক ফনসেকার অভ্যন্তরীণ তথ্যভাণ্ডার থেকে ৪ এপ্রিল ফাঁস হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ও ২ দশমিক ৬ টেরাবাইট তথ্য। সামগ্রিকভাবে এসব ফাইলে রয়েছে ৪৮ লাখ ইমেইল, ১০ লাখ ছবি ও ২১ লাখ পিডিএফ ফাইল। এই সংখ্যা ২০১০ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যের অনুপাতে (এক দশমিক ৭৩ গিগাবাইট) অনেক গুণ বেশি। ২০১৩ সালে এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা নথির চেয়েও বেশি। এই নথিপত্রগুলোকে বলা হচ্ছে ‘দ্য পানামা পেপারস’। এটি এ যাবত্কালের সবচেয়ে বড় তথ্য ফাঁসের ঘটনা। মোস্যাক ফনসেকার এসব নথির মাধ্যমে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, বিশ্বখ্যাত ফুটবলার, বলিউড তারকাসহ অনেকেরই গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। ধনী আর ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কোন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, সে তথ্য বেরিয়ে এসেছে এসব নথিতে।
,
কী এই মোস্যাক ফনসেকা?
,,,,,,,,,,,,,,,,,,
মোস্যাক ফনসেকা হলো পানামাভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান। মক্কেলদের পরামর্শ দিয়ে তারা বার্ষিক ফি গ্রহণ করে থাকে। আইনি সহায়তার পাশাপাশি সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্যও এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বখ্যাত। নিজ দেশের বাইরে অর্থ রাখার বিষয়ে দুনিয়াজুড়ে যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সেবা প্রদান করে তার মধ্যে মোস্যাক ফনসেকার অবস্থান চতুর্থ। তিন লক্ষাধিক কম্পানির সঙ্গে কাজ করে তারা। ৪২টির বেশি দেশে প্রতিষ্ঠানটির শাখা রয়েছে, যাতে কর্মরত রয়েছেন ৬০০-র বেশি কর্মী।
,
মোস্যাক ফনসেকা দাবি করছে, তারা মুদ্রা পাচারবিরোধী আইন মেনে চলে। সেদিকে খেয়াল রেখেই সেবা দেয় তারা। তবে মোস্যাক ফনসেকার বেশ কয়েকজন মক্কেলের বিরুদ্ধে আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। আর তা জানার পরও ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দিয়ে গেছে ফনসেকা।
,
ইউএস ট্রেজারির তরফ থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে এমন ৩৩ ব্যক্তিত্ব ও কম্পানির কাজ করত মোস্যাক ফনসেকা। এগুলোর মধ্যে ইরান, জিম্বাবুয়ে ও উত্তর কোরিয়ার বেশ কয়েকটি কম্পানিও রয়েছে। একটির আবার উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিল। এসব কম্পানিকে নিজস্ব নামে নিবন্ধন করত ফনসেকা। আর সে কারণে এসব কম্পানির সত্যিকারের মালিকদের শনাক্ত করা সম্ভব হতো না। ফনসেকার সঙ্গে কিছু কিছু কম্পানির সম্পর্কটা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আগেই শুরু হলেও কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও বেশ কয়েকটি কম্পানিকে সহায়তা দিয়ে আসছিল তারা।
,
যাদের তথ্য ফাঁস হয়েছে
গোপন এসব নথিতে উঠে এসেছে কিভাবে গোপনীয়তার আড়ালে ল ফার্মটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অর্থপাচার, নিষেধাজ্ঞা এড়ানো এবং কর ফাঁকিতে সহযোগিতা করেছে। এতে বিশ্বের কিছু স্বৈরশাসকসহ সাবেক ও বর্তমান ৭২ জন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের নিজেদের দেশ থেকে অর্থ লোপাটের ভয়াবহ চিত্রও উঠে এসেছে। এর মধ্যে মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসনি মোবারক, লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ রয়েছেন। নথিগুলোতে বিলিয়ন ডলার পাচারের একটি চক্রের সন্ধান মিলেছে, যার সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর নামও এসেছে। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল-আজিজ আল সউদ, আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জায়েদ বিন সুলতান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বাবা প্রয়াত ইয়ান ক্যামেরন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ছেলে, চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী লি পেংয়ের মেয়ে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের তিন ছেলেমেয়ে প্রমুখের নামও রয়েছে। নথিতে প্রকাশ পায়, ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি, বলিউড অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ও ঐশ্বর্য রাইও তাদের সেবা নিয়েছেন।
,
যেভাবে তথ্য ফাঁস হয় ও ছড়িয়ে যায়
,
————
এক ‘অজানা’ সূত্র জার্মান পত্রিকার ‘স্যুডয়েশ যেইটংয়ের’ এক প্রতিবেদকের সঙ্গে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আলাপ করে পুরো বিষয়ের আভাস দেন। এরপর এই ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্য নিয়ে কাজ করার জন্য একটি বিশেষ সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের (আইসিআইজে) ডেভেলপাররা। দুনিয়াজোড়া বিভিন্ন পার্টনার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এই সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যে তথ্যের আদান-প্রদান করেন। রিয়েল-টাইম চ্যাট সিস্টেমে সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে আলাপ, ডকুমেন্টে উল্লিখিত নামের সঙ্গে অন্যান্য তথ্য মেলানো, আর আনকোরা তথ্যকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরের ব্যবস্থাও করা হয়। ‘নুইক্স’ নামের একটি সফটওয়্যার কম্পানি প্রাপ্ত বিশাল নথি প্রাথমিকভাবে সাজানোর দায়িত্ব পালন করে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এসব নথি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচার হতে থাকে।
,
পদত্যাগের হিরিক
,
————-
পানামা পেপার্সে নাম আসার পর ব্যাপক বিক্ষোভ ও জন দাবির মুখে ৫ এপ্রিল পদত্যাগ করেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন। নথি অনুযায়ী, গুনলাগসন একটি বিদেশি কম্পানির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন, যেটি তিনি গোপন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও তিনি জানিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ করেননি, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন মাত্র।
,
এদিকে ফাঁস হওয়া নথিতে অন্তত পাঁচটি বিদেশি কম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে তথ্য বের হওয়ার পর ১১ এপ্রিল পদত্যাগ করেছেন ট্রান্সপারেনসি ইন্টারন্যাশনাল চিলির প্রেসিডেন্ট গনসালো দেলাবো। তাঁর পদত্যাগপত্র জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদ গ্রহণও করেছে। বলা হচ্ছে, দেলাবো অবৈধ কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত না হলেও এই ফাঁসের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যবসায় ও রাজনৈতিক দুর্নীতি নজরদারি এবং নির্মূলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই সংস্থাটির পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরপর ১৫ এপ্রিল পদত্যাগ করেন স্পেনের ভারপ্রাপ্ত শিল্পমন্ত্রী হোসে মানুয়েল সোরিয়া। পদত্যাগের পাশাপাশি সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকেও তিনি ইস্তফা দিয়েছেন।
,
বিভিন্ন কার্যালয়ে অভিযান
,
১২ এপ্রিল আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোস্যাক ফনসেকার সদর দপ্তরে অভিযান চালায় পানামার পুলিশ। পানামা সিটিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের পক্ষ থেকে চালানো এই অভিযানে দেশটির সংগঠিত অপরাধ দমন ইউনিটের সদস্যরাও অংশ নেন। তবে ৭২ ঘণ্টা ধরে তল্লাশি অভিযান চালানোর পর পানামার পাবলিক প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, মোসাক ফনসেকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
,
অভিযান চালানো হয়েছে মোস্যাক ফনসেকার এল সালভাদর কার্যালয়েও। এই শাখা থেকে জব্দ করা হয়েছে বিভিন্ন নথি ও কম্পিউটার। ফাঁস হওয়া নথিতে ফিফার সদ্য নির্বাচিত সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর নাম থাকায় নথিপত্র আটক করতে ইউরোপীয় ফুটবল সংগঠন উয়েফার দপ্তরে ৬ এপ্রিল অভিযান চালায় সুইজারল্যান্ড পুলিশ। নথি বের হওয়ার পর পরই ফ্রান্স সরকার পানামার সেন্ট্রাল আমেরিকান নেশন ব্যাংককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। প্রতিবাদে পানামাও ফ্রান্সের ব্যাংকগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
,
অভিযোগ অস্বীকার ফনসেকার
,
——-
শুরু থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে মোস্যাক ফনসেকা। তারা বলছে, তাদের এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ফাঁস হয়নি, বাইরে থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা হয়েছে। ৫ এপ্রিল বার্তা সংগঠন রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে প্রতিষ্ঠানটির অংশীদার ও প্রতিষ্ঠাতা র্যামন ফনসেকা বলেন, আমাদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বৈধ। আমরা কোনো গোপন কাজ করি না। তাদের কাজ নিয়ে কোনো অভিযোগও এর আগে কখনো ওঠেনি। তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের কাছে থাকা কোনো তথ্য নষ্ট করা হয়নি এবং প্রতিষ্ঠানটি কাউকে কর ফাঁকি বা মুদ্রা পাচারে (মানি লন্ডারিং) সহায়তা করেনি।
,
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের ডিরেক্টর জেরার্ড রাইল বলেন, নথিগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির গত ৪০ বছরের প্রাত্যহিক কার্যক্রমের তথ্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। যদি এগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হয়, তবে তা পুরো দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দেবে।
.
লিখেছেন >>>আতাউর রহমান কাবুল