প্রাথমিক শিক্ষায় টাকায় মিলছে ‘জিপিএ-৫’ সিন্ডিকেটের খপ্পড়ে সমাপনীর ফল

প্রাথমিক শিক্ষায় টাকায় মিলছে ‘জিপিএ-৫’ সিন্ডিকেটের খপ্পড়ে সমাপনীর ফল

প্রাথমিক শিক্ষায় টাকায় মিলছে ‘জিপিএ-৫’। পরিবর্তন হচ্ছে ‘গ্রেড’। শিক্ষা কর্মকর্তা ও অভিভাবকরা ইচ্ছেমতো নম্বর পরিবর্তন করছেন; এতে শিশুদের পাবলিক পরীক্ষার গ্রেড পরিবর্তন হচ্ছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় শিশুদের এই ধরনের দুর্নীতিতে জড়ানো হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় টাকার বিনিময়ে নম্বর বা জিপিএ বাড়িয়ে দেয়ার প্রমাণও পেয়েছে সরকার।

শিশুদের এই ধরনের অনৈতিক কাজে নিমজ্জিত করতে শুধু ঢাকায় বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে বিগত বছরের মতো এবারও এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় অপরাধীরা রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। নম্বর টেম্পারিংয়ের জন্য একটি থানার শিক্ষা কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের তদবিরেম রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন জালিয়াতকারীরা।

সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ১ হাজার ২০০ ফলপ্রার্থীর উত্তরপত্রে নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরীক্ষকদের জিম্মি করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ ছয় সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুল উত্তর সংশোধন করে প্রাপ্ত নম্বরের চেয়ে বেশি দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় একজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাকে স্যান্ড রিলিজড করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিপিই’র ঢাকার বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইন্দু ভূষণ দে  বলেন, ‘নম্বর টেম্বারিং, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে আমরা খুব ভেজালের মধ্যে আছি। এ বিষয়ে বেশি কথা বলা ঠিক হবে না।’

শিক্ষবিদরা বলছেন, ‘জিপিএ-৫ ও সনদের প্রতিযোগিতার’ কারণেই এক শ্রেণীর অভিভাবক সন্তানদের দুর্নীতিতে জড়াচ্ছেন। আর অসাধু শিক্ষা কর্মকর্তারা অর্থের লোভে এই ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতায় সহায়তা করছেন। তাদের কারণেই শিশুরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিতে শিখছে। এতে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছেন।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির  বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণীতে জিপিএ বা গ্রেডনির্ভর পাবলিক পরীক্ষা নেয়ার কথা শিক্ষানীতিতে বলা নেই। এই জিপিএ এবং সার্টিফিকেট পাওয়ার প্রতিযোগিতার কারণেই অভিভাবকরা সন্তানদের দুর্নীতিতে নিমজ্জিত করছেন। কোমলমতি শিশুদের রক্ষা করতে হলে অবিলম্বে পঞ্চম শ্রেণীতে জিপিএ নির্ভর সার্টিফিকেট পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। তবে বছর শেষে একটি সমাপনী পরীক্ষা থাকবে, সেটার সনদে কোন জিপিএ থাকবে না। সনদে কেবল উল্লেখ থাকবে ‘উত্তীর্ণ’ হয়েছে।

নম্বর জালিয়াতির কারণে শিক্ষা কর্মকর্তাকে শোকজ

গত বছর পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের এই সমাপনী পরীক্ষায় রাজধানীর গুলশান থানার বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জিপিএ-এ (গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ) ১৫ জনের স্থলে ৫১ জনকে জিপিএ-৫ দেয়াসহ পরীক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)।

এ জালিয়াতির জন্য গুলশান থানার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খান মাহছুরা আক্তার টুইনকে গত ২৪ অক্টোবর কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। তিনি ইতোমধ্যে শোকজ নোটিশের জবাবও দিয়েছেন। এই শিক্ষা কর্মকর্তা এখন চাকরিতেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

খান মাহছুরা আক্তার টুইনকে দেয়া ডিপিইর উপপরিচালক রাজা মিয়া স্বাক্ষরিত কারণ দর্শানো নোটিশে বলা হয়, ‘আপনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় কিছুসংখ্যক উত্তরপত্রের নম্বর ও সফটওয়ারে এন্ট্রিকৃত নম্বর ফর্দে নম্বর গরমিল করেছেন; আপনি কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ের নম্বর ফর্দের প্যাকেট-১ পরিবর্তন করেছেন। আপনি জিপিএ-৫ প্রাপ্ত ১৫ জনের স্থলে ৫১ জনকে জিপিএ-৫ দেয়াসহ উদয়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে নম্বর বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং আপনার এরূপ আচরণ সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ১৯৮৫ এর ৩ উপবিধি অনযায়ী অদক্ষতা ও অসদাচরণের শামিল। উপরে বর্ণিত কারণে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী কেন আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা পত্র প্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জানানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’

ধারাবাহিক নম্বর জালিয়াতি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত আগস্টে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবের কাছে ঢাকার কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষার নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে লিখিত অভিযোগপত্র দেন।

এতে দেখা গেছে, তিন বছর ধরে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে রাজধানীর বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফলাফল পরিবর্তন ও ঘষামাজা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি বিদ্যালয়ের ২০১৪ সালে ৫২টি, ২০১৫ সালে ৯২টি এবং ২০১৬ সালে ৫২টি জিপিএ-৫ দেয়া হয়। এ বিষয়ে ২০১৫ সালে ডিপিই মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হলেও প্রতিকারমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্ত স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষক, থানা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গত কয়েক বছর ধরেই ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছেমতো নম্বর টেম্পারিং হয়ে আসছে। অসাধু অভিভাবকরা টাকার বিনিময়ে অনৈতিক পন্থায় সন্তানদের ফল পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন।

ডিপিই’র একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ‘সমাপনী পরীক্ষায় এক থানার খাতা একই জেলা ও উপজেলার পরীক্ষকদের (শিক্ষক) মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। এর ফলে কোন স্কুলের খাতা কোথায় মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয় সে সম্পর্কে থানা শিক্ষা কর্মকর্তারা ভালোভাবেই অবহিত থাকেন। তারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই খাতায় নম্বর পরিবর্তন বা ঘষামাঝা করার সুযোগ করে দেন।’

একটি অভিযোগপত্র অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় রাজধানীর গুলশান থানার কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খাতা মূল্যায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ডেমরা থানা শিক্ষা অফিসকে। ডেমরা থানা থেকে পাঠানো ইংরেজী বিষয়ের মূল মার্কশিটে (নম্বরপত্র) দেখা গেছে, কালাচাঁদপুর স্কুলে ইংরেজী বিষয়ে এ-প্লাস পেয়েছে ১৫ জন শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে একটি সংযুক্ত মার্কশিট থেকে দেখা যায়, ওই স্কুলে ইংরেজী বিষয়ে এ-প্লাস পেয়েছে ৩৬ জন শিক্ষার্থী। তবে ডিপিই’র তদন্তে দেখা গেছে, ওই স্কুলে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫১ জন।

 

আরো পড়ুন:

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনি পরীক্ষা একসঙ্গে দিচ্ছে নানি ও নাতি

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি: গণিত

প্রাথমিক শিক্ষাস্থর অষ্টম শ্রেণি হচ্ছে না, আপাতত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তই থাকবে

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline