
বছর জুড়ে শিক্ষকদের নানা আন্দোলন, ছাত্রলীগের একাধিকবার সংঘর্ষসহ নানা কারণে বার বার শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হওয়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) এবার চলছে উপাচার্যবিহীন অবস্থায় চরম হযবরল অবস্থা। উপাচার্য না থাকায় এখনো প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। অন্য দিকে, একাডেমিক এবং প্রশাসনিক সব কার্যক্রম পড়ছে মুখ থুবড়ে। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ডিসেম্বর মাসের বেতনও দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা রয়েছেন চরম মানবেতরভাবে। ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই সেশনজটের কবলে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। আর বৃত্তি পাওয়া শিক্ষকরাও যেতে পারছেন না বিদেশে উপচার্যের কাছে ছুটি নিতে না পারার কারণে। মাঝিবিহীন নৌকা মাঝ নদীতে থাকলে যে অবস্থা কুবির সামগ্রিক পরিস্থিতিও এখন অনেকটা তেমন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করার জন্য বৃত্তি পেয়েছেন। ৪ জানুয়ারি থেকে তার ক্লাস শুরু হয়েছে। তিনি বাধ্য হয়ে ছুটি না নিয়েই হতাশ হয়ে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। আরো কয়েক শিক্ষকও শিক্ষাছুটির জন্য অপেক্ষায় আছেন।
একই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩৪ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী ডিসেম্বর মাসের বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। আটকে আছে প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষাও। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও আটকে আছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দ্রুত উপাচার্য নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম উপাচার্য অধ্যাপক মো. আলী আশরাফের মেয়াদ শেষ হয়। এর এক দিন আগেই তার পুরনো কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান তিনি। এরপর থেকে পদটি শূন্য। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদও শূন্য। যে কারণে ভারপ্রাপ্ত কিংবা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনেরও কেউ নেই। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮০ জন শিক্ষক, ৬৬ জন কর্মকর্তা ও ১৮৮ জন কর্মচারী বেতন-ভাতা পাবেন না। নিয়মানুযায়ী, উপাচার্যের অনুমোদন নিয়ে বেতন-ভাতা দেয়া হয়।
জানতে চাইলে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘উপাচার্যের পদ শূন্য থাকায় ডিসেম্বর মাসের বেতন-ভাতা আমরা এখনো পাইনি। এতে করে মাস চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
এদিকে ভর্তি পরীক্ষা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ৫৪ হাজার ৮০৯ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন। এ বছর ১ হাজার ৯৭ আসনের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন প্রায় ৫০ জন করে শিক্ষার্থী। তিনটি অনুষদে ১৯টি বিভাগে এবারো শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। গত বছরের ১৭ ও ১৮ নভেম্বর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আলী আশরাফের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে শিক্ষক সমিতি আন্দোলন করে। শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের কারণে তৎকালীন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে ঢুকতে পারেননি টানা ৪৭ দিন। ওই কারণে ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এতে করে অনিশ্চয়তায় পড়েন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তখন কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, নতুন উপাচার্য এলে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কুমিল্লা নগরির ঝাউতলা এলাকার শিক্ষার্থী আনিকা তাবাসুম, মোগলটুলি এলাকার জেরিন তাসনিম ও চৌধুরীপাড়া এলাকার রাকা ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভর্তিও শেষ। অথচ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেনি।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন মো. আবু তাহের বলেন, উপাচার্যের পদ শূন্য থাকায় ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। এ মাসের মধ্যে উপাচার্য পদে নিয়োগ না দিলে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ২ মাস বন্ধ হয়ে যাবে। অনেকগুলো কমিটি উপাচার্যের অনুমোদনের পর করতে হয়, সেগুলোও আটকে আছে। ডিন নির্বাচন, শিক্ষকদের বিদেশ যাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও দীর্ঘদিন যাবৎ সিন্ডিকেট সভাও হচ্ছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আক্ষরিক অর্থে স্থবির হয়ে পড়েছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় আক্ষরিক অর্থে অভিভাবকশূন্য। যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মজিবুর রহমান মজুমদার বলেন, ‘উপাচার্য নিয়োগের এটি সরকারের সর্বোচ্চ মহলে প্রক্রিয়াধীন। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের গত ডিসেম্বর মাসের বেতন-ভাতা দেয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছি। উনারা বলেছেন, উপাচার্য এলেই বেতন-ভাতা দিতে হবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। উপাচার্য না থাকায় ভর্তি পরীক্ষাও আটকে আছে। আমরা আশা করছি, এ মাসের মধ্যেই সরকার কাউকে না কাউকে এ পদে নিয়োগ দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য রুটিনওয়ার্ক চলছে।’
কুবির প্রক্টর ড. কামাল উদ্দিন বলেন, সত্যি কথা বলতে কী ভিসি স্যার না থাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও মারাত্মক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আমরা ডিসেম্বর মাসের বেতন পাইনি। ভিসি না আসা পর্যন্ত একই অবস্থা বিরাজ করবে বলে তিনি জানান।
আরো পড়ুন: