তিস্তা ইস্যু বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ

তিস্তা ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য জরুরি:

মুহাম্মদ রুহুল আমীন |

ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদী তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি এখন অন্যতম জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বিরোধী দলগুলো বিশেষত বিএনপি তিস্তা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকা থেকে ডালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত দু’দিনের লংমার্চ কর্মসূচি পালন করেছে। এর আগে সিপিবি ও বাসদ যৌথভাবে একই ইস্যুতে লংমার্চ করে। জাতীয় স্বার্থে আহূত এ ধরনের ‘লংমার্চ’ যেন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ারে ‘রং মার্চে’ পরিণত না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
ভারত ও বাংলাদেশের মোট ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে, যেগুলোর পানি পাওয়ার অধিকার রয়েছে দু’দেশের জনগণেরই। আন্তর্জাতিক নদী আইনে স্বীকৃত রীতি অনুযায়ী এ অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত এ নদীগুলোর প্রতিটির উজানে ভারত বাঁধ দিয়ে ইচ্ছামতো পানি নিয়ন্ত্রণ করছে, যেটি আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লংঘন। পাকিস্তান আমল থেকে অদ্যাবধি এ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে তিস্তা নদীর পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে উভয় দেশের মধ্যে নানা আশাব্যঞ্জক আলোচনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বার্থের কিয়দাংশও অর্জিত হয়নি। এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলগুলো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে।
বাংলাদেশের জন্য তিস্তার পানি কেন জরুরি, তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার প্রায় তিন কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে তিস্তার পানির সম্পর্ক সরাসরি। এ অঞ্চলের প্রায় ৯ হাজার ৬৬৭ বর্গকিলোমিটার জমির সেচকাজ নির্ভর করে তিস্তার পানি প্রবাহের ওপর। রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুরের চাষীরা ১.১ লাখ একর জমিতে বোরো ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় তিস্তার পানি এ বছরের গ্রীষ্মকালে পাননি। ফলে প্রায় ১৫ গুণ বেশি অর্থ খরচ করে সেখানে চাষাবাদ করতে হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা যায়, গত বছর পর্যন্ত এক একর জমি চাষ করতে যেখানে ৪৮০ টাকার বেশি খরচ হতো না, সেখানে বর্তমানে ডিজেল বা বিদ্যুৎচালিত পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে চাষাবাদ করতে ৭ হাজার টাকারও বেশি খরচ হচ্ছে। তিস্তার সঙ্গে সংযুক্ত বড় নদীগুলো এরই মধ্যে শুকিয়ে গেছে। পাশাপাশি তিনটি জেলার ৩০ হাজার জেলে ও মৎস্যজীবী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অনেক পানি বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ ভূমি বিরান মরুভূমিতে পরিণত হবে। কাজেই এটা অনুধাবন করা যায়, তিস্তার পানি এক অর্থে সব বাংলাদেশীর জীবন ও জীবিকার জন্য অপরিহার্য। বস্তুত, তিস্তার পানির অধিকার একটি অভিন্ন জাতীয় স্বার্থের বিষয়। এ নিয়ে কারও রাজনীতি করার সুযোগ নেই।
বেদনাদায়ক হল, এ ইস্যু নিয়ে ইদানীং বেশ নোংরা রাজনীতি হচ্ছে। ২২ এপ্রিল বিএনপি ঢাকা থেকে নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে অবস্থিত তিস্তা বাঁধ পর্যন্ত দু’দিনের লংমার্চ কর্মসূচি শুরু করলে দলটির অতীত নীতি নিয়ে অনেকে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা সমালোচনা শুরু করেন। বিএনপি দীর্ঘ সময় সরকারে থাকাকালে ভারত-বাংলাদেশ অভিন্ন নদীগুলোর পানিতে বাংলাদেশের অধিকার আদায়ে তেমন কার্যকর নীতি ও পদক্ষেপ নেয়নি বলে তারা বিএনপির ওপর দোষারোপ করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের এক সিনিয়র নেতা বিএনপির লংমার্চ কর্মসূচিকে ‘অভিনয়’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
আমি মনে করি, তিস্তা ইস্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থের অগ্রাধিকার নিয়ে কোনো রকম দ্বিমত, দ্বিধা ও ভিন্নমত প্রকাশ করা সমীচীন নয়। আওয়ামী লীগের গত শাসনামলে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, এ ইস্যুকে ঘিরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক গণ-অসন্তোষ তৈরি হয় তা স্বীকার করা, অনুধাবন করা উচিত আওয়ামী লীগের। এ কারণে তিস্তা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপির লংমার্চ প্রকারান্তরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সৃষ্ট অচলাবস্থা দূরীকরণে সরকারের সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগের সিনিয়র-জুনিয়র নেতারা, সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা দায়িত্বহীনভাবে বিএনপির লংমার্চ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে তিস্তার মতো জাতীয় ইস্যুকে অগ্রাহ্য করে চলেছেন। কেউ কেউ হুমকি-ধামকি দিয়ে বলেছেন, লংমার্চের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করলে তা বরদাশত করা হবে না। কেউবা বলেছেন, খালেদা জিয়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসভবনে আরাম-আয়েশে থেকে জনগণকে তীব্র গরমে লংমার্চে নামিয়েছেন। মন্ত্রী, নেতা-নেত্রীদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে, বিএনপির লংমার্চ কর্মসূচির কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আসলে কি তাই? বিএনপি কি এককভাবে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে?
বিএনপি, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তিস্তা অভিমুখে লংমার্চের মতো কর্মসূচি দিয়েছে। ইসলামপন্থী দলগুলোও তিস্তা বিষয়ে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।
গত ফেব্র“য়ারি ও মার্চে তিস্তার পানিপ্রবাহ ৫০০-৫৫০ কিউসেকে নেমে এসে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সাধারণত খরা মৌসুমে এ প্রবাহ থাকে ৬ হাজার ৫০০ কিউসেক পর্যন্ত। মজার বিষয় হল, বিএনপির লংমার্চের প্রথমদিকে ২২ এপ্রিল দুপুরে হঠাৎ করে তিস্তার পানি প্রবাহ ৩ হাজার কিউসেক পর্যন্ত বেড়ে যায়। তবে তা মাত্র একদিনের জন্য। খুবই অবাক হতে হয়, যখন এই একদিনের পানিপ্রবাহ বৃদ্ধিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং প্রধানমন্ত্রীর ‘দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের’ ফসল হিসেবে কৃতিত্ব নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। অবশ্য পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির ২৪ ঘণ্টা পর আবার তা ১ হাজার ২৪০ কিউসেকে নেমে এলো কেন, সে বিষয়ে সরকার এখনও কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি।
আগেই বলেছি, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরকার প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। সরকার জনগণকে একাধিকবার এ প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। অধিকন্তু ভারতের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক ও সরকারের একাধিক মন্ত্রীও তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের অধিকার প্রদানের প্রতিশ্র“তি দেন। ভারতের সরকার ও রাজনীতিকসহ বাংলাদেশের সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতাদের উচিত বাংলাদেশের জনগণকে দেয়া এসব প্রতিশ্র“তি পূরণ করা। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব?
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের বড়ভাইসুলভ নীতি সর্বজনবিদিত। তারা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে মোটেই উদার নয়। তবে কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে ভারতকে রাজি করিয়ে বা ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তাদের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে পারে। ভারত সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের কার্যকর কৌশল গ্রহণ করে বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর ঈপ্সিত পানি আদায় করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭৬ সালে মরহুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চের পর তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভারত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বেশকিছু সুবিধা আদায় করেছিলেন। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের লংমার্চ কর্মসূচিকে সরকার তার কূটনৈতিক-কৌশলে প্রয়োগ করে ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিতে বাংলাদেশের অধিকারের এটি দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সবার কাছে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে বিবেচিত হতে হবে। আমাদের স্বভাবগত রাজনৈতিক ব্লেমগেইমের জাঁতাকলে যেন আমাদের জাতীয় স্বার্থ পিষ্ট না হয়, সেদিকে নজর দিত হবে সবাইকে। বিএনপি যেন তার লংমার্চ কর্মসূচিকে কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই যে লংমার্চ কর্মসূচি, একথা যেন প্রতিটি নাগরিকের কাছে স্পষ্ট ও বোধগম্য হয়। সেজন্য বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে দ্রুত নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরির ফাঁদ হিসেবে যেন বিএনপি ‘লংমার্চকে’ ‘রং মার্চ’ হিসেবে কলংকিত না করে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের।
উত্তরাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের জীবনও সম্পর্কিত। তাই তিস্তার সঙ্গে আবদ্ধ দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য। এমন জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুটি যেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের হীন-রাজনীতির শিকার না হয়। বরং অভিন্ন জাতীয় স্বার্থে, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন এবং দেশের উত্তরাঞ্চলসহ অন্যান্য এলাকার কৃষক, জেলে, ব্যবসায়ীর সুখী জীবন নিশ্চিত করতে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিকে দুর্বার গণআন্দোলনে পরিণত করে ভারত সরকারের দৃষ্টিতে আনা দরকার। এ দায়িত্ব সরকার, বিরোধী দলসহ প্রত্যেক নাগরিকের। কেবল সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যই তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করবে। এ ঐক্য এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যুগান্তর : ০১ মে ২০১৪

আরো পড়ুন:

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৪৭

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৪৮

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৪৯

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline