৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে,পার্ট – ৪৮

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি আসবে .গুরুত্বদিন

.
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি :একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
মো. জিয়াউল হক

.
পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার এটি সারাবিশ্বে বহুল আলোচিত বিষয়। একে মানবজাতি তথা পৃথিবীর নিরাপত্তার প্রতি গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। মূলত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নামে দেশে দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিমিত যথেচ্ছ ব্যবহার এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যাপক নির্গমন আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অন্য কথায় উন্নত দেশসমূহের ভোগবাদী উন্নয়ন মডেলের ধারাবাহিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফল বিশ্বব্যাপী আজ অনুভূত হচ্ছে।
,
জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UN Framework Convention on Climate Change, UNFCCC)-এর আওতায় গত ৩০ নভেম্বর হতে ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২১তম জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (21st Conference of the Parties or COP21) অনুষ্ঠিত হয়। আলোচ্য বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনটি বাংলাদেশসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাত্পর্যমণ্ডিত ছিল। এই সম্মেলনে কনভেনশনের সকল সদস্য দেশের (১৯৫টি দেশ) ঐকমত্যের ভিত্তিতে UNFCCC-এর আওতায় একটি জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তি গৃহীত হয়, যেটি ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি (Paris Agreement) নামে অভিহিত। চুক্তিটি ২২ এপ্রিল ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত জাতিসংঘের সদর দপ্তরে স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত আছে (চুক্তির আর্টিকেল ২০ ও ২১ অনুযায়ী)। এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের সদর দফতরে ২২ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে একটি ঐতিহাসিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের প্রথম দিনেই জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশনের ১৯৫টি সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ ১৭৫টি দেশ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেটি আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ঘটনা। বাংলাদেশের পক্ষে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, এমপি প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
,
জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC) প্রণয়নের জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৯০ সালে Intergovemental Negotiating Committee (INC) গঠন করা হয় এবং উক্ত কনভেনশনটি INC কর্তৃক জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ৯ মে ১৯৯২ সালে গৃহীত হয়। পরে কনভেনশনটি রাষ্ট্রসমূহের স্বাক্ষরের জন্য জুন ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে (Earth Summit) উন্মুক্ত করা হয়।
,
এখানে ১৯৯০ সালে UNFCCC প্রণয়ন ও গ্রহণের সময় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি গ্রহণের সময়ের প্রেক্ষাপটের একটি সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা সমীচীন হবে। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশনের মূল লক্ষ্য ও নীতিমালার আলোকে প্যারিস চুক্তিটি কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, ভারসাম্যমূলক ও বাস্তবভিত্তিক হয়েছে সে দিকটিও দেখা প্রয়োজন। এটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশনের আওতায় চলমান আন্তঃরাষ্ট্রীয় নেগোসিয়েশন একটি বহুমাত্রিক, বৈচিত্র্যপূর্ণ, জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখানে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে ১৯৫টি সদস্য দেশের সর্বসম্মত ঐকমত্যের প্রয়োজন হয়।
,
আশির দশকের শেষার্ধে বিশ্বের দেশসমূহের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতি ও সামর্থ্য, শিল্পায়নের উত্কর্ষ, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ তথা উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা বিবেচনা করে তত্কালীন Organization for Economic Cooperation (OECD)-এর দেশসমূহকে অ্যানেক্স-১ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময় বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগের উত্স ছিল শিল্পোন্নত অ্যানেক্স-১ভুক্ত দেশসমূহ। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবেই বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের শতকরা প্রায় ২৫ ভাগের জন্য দায়ী ছিল। জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশনে শিল্পোন্নত দেশসমূহের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের যে অঙ্গীকার বিধৃত হয়েছে তাকে আরো সুনির্দিষ্ট, সুসংবদ্ধ ও আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতামূলক কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট আর্টিক্যাল অনুসরণে ১৯৯৭ সালে সর্বসম্মতভাবে কিয়োটো প্রটোকল গৃহীত হয়। কিয়োটো প্রটোকলের সঙ্গে সংযুক্ত অ্যানেক্স-বি তালিকায় প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশের জন্য ভিত্তি বছর ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০০৮ থেকে ২০১২-এর মধ্যে কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাবে তার শতকরা হার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিয়োটো প্রটোকলে পৃথিবীর শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে স্বাক্ষর করলেও পরে কংগ্রেস কর্তৃক অনুসমর্থন না করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রটোকলের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত থেকে যায়। ফলে শুরুতেই কিয়োটো প্রটোকলের কার্যকারিতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এমনকি এই প্রটোকলের প্রথম পর্যায়ের শেষ বর্ষে ২০১২ সালে কানাডা প্রটোকল থেকে বের হয়ে যায়। অন্যদিকে কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় পর্যায়ের (২০১৩-২০২০) জন্য গৃহীত সংশোধনীতে জাপান, রাশিয়া ও নিউজিল্যান্ড অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ফলে কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় পর্যায়ের মাধ্যমে বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের শতকরা মাত্র ১৫ ভাগ নিয়ন্ত্রিত হতে পারত এবং অবশিষ্ট শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ কোনো ধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। তবে কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী ১৪৪টি দেশ কর্তৃক কিয়োটো প্রটোকলের সংশোধন অনুসমর্থন না করায় অদ্যাবধি প্রটোকলের দ্বিতীয় পর্যায় কার্যকর হতে পারেনি। ফলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিয়োটো প্রটোকলের কার্যকারিতা প্রায় নেই বললেই চলে।
,
পক্ষান্তরে জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশন গৃহীত হওয়ার পর গত প্রায় ২৫ বছরে ভৌগোলিক অবস্থানগত বিচারে বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের অগ্রগতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর (Economic in Transition) তুলনায় গত দুই দশকে বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও শিল্পায়নের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বর্তমানে পৃথিবীর শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হয়েছে চীন এবং তৃতীয় শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হয়েছে ভারত। বিশ্বের প্রথম ২০টি সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে ১০টি হলো উন্নয়নশীল দেশ। এ অবস্থায় অ্যানেক্স-১ভুক্ত উন্নতদেশসমূহ বর্তমানে পৃথিবীর মোট কার্বন নিঃসরণের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগের জন্য দায়ী, বাকি শতকরা প্রায় ৬০ ভাগের উত্স হলো উন্নয়নশীল দেশ। অন্যদিকে বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ মাত্র দুটি দেশ—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে উদ্ভূত। এ অবস্থায় জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশনের আওতায় বিশ্বের সার্বিক কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণসহ পৃথিবীর নিয়ত পরিবর্তনশীল বাস্তবতার নিরিখে ২০১৫ সালে ২১তম প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, কার্যকর, দীর্ঘমেয়াদি, সকলের অংশগ্রহণমূলক, আইনি বাধ্যবাধকতাযুক্ত সর্বজনীন চুক্তি সম্পাদনের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায় ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত ১৭তম জলবায়ু সম্মেলনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের জন্য এই প্যারিস চুক্তিটি অত্যন্ত জরুরি ও তাত্পর্যপূর্ণ।
,
তবে প্যারিস চুক্তির অন্যতম প্রধান দুর্বলতা হলো বিশ্বের সকল সদস্য দেশকে বিশেষ করে শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশসমূহকে এই চুক্তির বাধ্যবাধকতায় আনার জন্য কতিপয় ছাড় দেওয়া হয়েছে, যেমন—দেশসমূহ কর্তৃক মধ্যমেয়াদি বা দীর্যমেয়াদি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস, আর্থিকসহ অন্যান্য সহায়তা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সংখ্যাভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে বর্ণিত লক্ষ্যমাত্রা স্ব স্ব দেশ কর্তৃক নির্ধারিত হবে, যেটি পাঁচ বছর পর পর Nationally Determined Contribution-এর মাধ্যমে কনভেনশন সচিবালয়ে দাখিল করা হবে এবং তার ওপরই বিশ্ব সম্প্রদায়কে নির্ভর করতে হবে। এই কারণে এই চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত Compliance Mechanism-কে শক্তিশালী করা যায়নি। তবে এই ঘাটতি যথাসম্ভব পুষিয়ে নেওয়ার জন্য একটি কার্যকর ও শক্তিশালী Transparency Framework-এর রূপরেখা দেওয়া হয়েছে যার খুঁটিনাটি পরবর্তীকালে তৈরি করা হবে। এ ছাড়া উন্নত দেশের প্রবল আপত্তির মুখে প্যারিস কপের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লস অ্যান্ড ড্যামেজ সংক্রান্ত liability and compensation আরোপের এটি অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
,
পরিশেষে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশনের আওতায় পরিচালিত গত দুই দশকের নেগোসিয়েশনের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে এটা বলা সঙ্গত হবে যে, জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশনের আওতায় সত্যিকার অর্থে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, কার্যকর, দীর্ঘমেয়াদি, সকলের অংশগ্রহণমূলক, আইনি বাধ্যবাধকতাযুক্ত সর্বজনীন চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্যারিস চুক্তি একটি ঐতিহাসিক শুভ সূচনা। এর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সিঁড়ি বেয়েই ধাপে ধাপে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি হবে এবং বিশ্ব সম্প্রদায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক সমস্যাকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
,
লেখক:পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর
১৫মে . ২০১৬ । ইত্তেফাক

 

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline