মোদির ঢাকা সফরে বাংলাদেশের লাভ

মোদির ঢাকা সফরে বাংলাদেশের লাভ

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক

মুহাম্মদ রুহুল আমীন
.
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য হলো অত্রাঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস। মোদির বাংলাদেশ সফরে সেই বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন বয়ে আনবে বলে অনুমান করা যায়। ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রানজিট ইস্যুটি বেশ বিতর্কিত ছিল। সেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে মোদির সফরকালে দুটি দেশের মধ্যে যে সংযোগ (Connectivity) স্থাপিত হয়েছে, তা উভয়ের জন্যই কল্যাণকর।
.
ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোদির সফর এ কারণে তাৎপর্যপূর্ণ যে দক্ষিণ এশিয়ায় গতানুগতিক রাজনীতিতে ‘ভারত ফ্যাক্টর’-এর যে ভীতি রয়েছে এবং প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতের যে বড় বোনসুলভ (Big Sisterly) মনোভাব রয়েছে এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে দখলদারি তত্ত্বের (Hegemonic Stability theory) দক্ষিণ এশীয় বৈশিষ্ট্যে যে ‘ভারত-মতবাদ’ (India doctrine) প্রচলিত আছে, তার অপনোদন ঘটিয়ে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিকতার (Reciprocity) বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ দুই দেশের সংযোগ স্থাপননীতির কারণে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই তৃতীয় কোনো দেশে যাতায়াত বা বাণিজ্যের প্রয়োজনে একে অপরের সীমানা ব্যবহার করার অধিকার অর্জন করেছে। একইভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ছিটবাসী এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ছিটবাসীরা সমানভাবে স্বাধীনতা ভোগ করবে তাদের বসবাসের ক্ষেত্রে। তারা বসবাসের জন্য স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। অর্থাৎ তারা যদি চায়, তাহলে তারা বাংলাদেশ বা ভারত যেকোনো রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারবে।
.
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ভারতের মতো একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমানা চুক্তি এবং যোগাযোগ চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের সুযোগ লাভ। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় পক্ষ আন্তর্জাতিক চুক্তি, সনদ ও রীতি অনুসরণ করে আলোচনার ভিত্তিতে দুই দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিটের মাসুলের হার ঠিক করবে এবং উভয় দেশকেই এ মাসুল দিতে হবে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতীয় ভিসা সহজ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালুর ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিসও উদ্বোধন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রায় ভূবেষ্টিত রাষ্ট্রের জন্য এ যোগাযোগ-সুবিধা বৃহত্তম ভারতের সর্বত্র বাংলাদেশের পণ্য ও নাগরিকদের অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে, যেটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রভূত উৎকর্ষ লাভ করবে।
.
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের ফলে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ সহজ শর্তে ঋণ পেতে যাচ্ছে, যেটি অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ২০১০ সালে মাত্র ১ শতাংশ হারে ২০ বছরের জন্য ১০০ কোটি ডলার ঋণদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। মোদির সফরের ফলে প্রথম ঋণচুক্তির মতো সহজ শর্তে দ্বিতীয় ঋণচুক্তির দুয়ার উন্মোচিত হলো। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ২০০ কোটি ডলার ভারতীয় ঋণ পাওয়া গেল, যেটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে রয়েছে মোদির সফরকালে স্বাক্ষরিত ১৯টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক।
.
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের ফলে ভারতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের ভারতবিরোধী মনোভাবের অপনোদন। বাংলাদেশের গত ৪৪ বছরের ইতিহাসে যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য বিরোধী দল ভারতবিরোধী মনোভাবকে ব্যবহার করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে টাটা গ্রুপের সঙ্গে যখন বিএনপি সরকার বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে উদ্যত হয় তখন তদানীন্তন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে যে বিএনপি ভারতের কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছে। একইভাবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির অভিযোগ যে আওয়ামী লীগ ভারতের কাছে দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর এ ভারতবিরোধী মনোভাব অনেকটা দূর করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ে নরেন্দ্র মোদিকে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানাচ্ছে।
.
মোদির ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিনব নেতৃত্ব ও শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। ভারত মতবাদের দুর্নাম কাটিয়ে ভারত এখন প্রমাণ করছে যে ভারতের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো আস্থা রাখতে পারে। ফলে ভারতের জন্য বৈশ্বিক নেতৃত্বের পথও সুগম হচ্ছে। ভারতের জন্য আরেকটি বিরল অর্জন হলো ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্ব্যর্থহীন সহযোগিতা ও ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান। সর্বোপরি একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি থেকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার ভারতীয় অভিপ্রায় নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের মাধ্যমে বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছে বলে অনুমিত হচ্ছে।

এ সফরকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের জনগণ ও সরকারের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তা বাস্তবায়িত হোক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের জনগণকে অভিনন্দন।
..
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিন, স্কুল অব বিজনেস, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

আরো পড়ুন:

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি , পার্ট – ৯

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৫৯

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৬০

 

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline