লেখক পরিচিতি
পাঠ পরিচিতি
অনুশীলনী কর্ম
সংস্কৃতি বলতে আমরা সাধারণত সাহিত্য শিল্প নৃত্যগীতবাদ্য বুঝে থাকি। এগুলো সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ, তবে এগুলোই সংস্কৃতির সবটা নয়। সংস্কৃতি বলতে মুখ্যত দু’টো ব্যাপা বোঝায় : বস্তুগত সংস্কৃতি আর মানস-সংস্কৃতি। ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি, আহারবিহার, জীবনযাপন প্রণালী-এসব বস্তুগত সংস্কৃতির অন্তর্গত। আর সাহিত্য-দর্শনে শিল্পে-সঙ্গীতে মানসিক প্রবৃত্তির যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তাকে বলা যায় মানস-সংস্কৃতি। বস্তুগত আর মানস-সংস্কৃতমিিলিয়েই কোনো দেশের বা জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে আমরা যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি, তা অনেক পুরনো। এই সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মেলে, কিছু বৈশিষ্ট্য আলাদা করে সনাক্ত করা যায়। নৃতাত্ত্বিক বিচারে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশে, ধর্মানুপ্রেরণায়, বর্ণপ্রথায়, উৎপাদন-পদ্ধতির অনেকখানিতে বাঙালি সংস্কৃতির মিল পাওয়া যাবে গোটা উপমহাদেশের সঙ্গে। বাংলাভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর ভাষা-এই গোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষা ছাড়িয়ে আছে উপমহাদেশে উত্তরাঞ্চলে। বাংলার অনেক রীতিনীতিরও মিল খুঁজে পাওয়া যায় সেই এলাকায়। আবার ধান-তেল-হলদি-পান-সুপারির ব্যবহারে মিল পাওয়া যায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে। সেলাই ছাড়াকাপড় পরার বিষয়েও বেশমিিল ঐ এলাকার সঙ্গে। এর কারণ, বাংলার আদি জনপ্রবাহ ছিল প্রাক-আর্য নরগোষ্ঠীসম্ভত। পরে এর ওপরে আর্য জনগোষ্ঠী ও তাদের প্রভাব এসে পড়ে। সে প্রভাব এত তীবধ ছিল যে, তাই দেশজ উপকরণে পরিণত হয়। পরে মুসলমানরা যখন এদেশ জয় করলেন, তখন তাঁরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এলেন, তাতে তুর্কি-আরব-ইরান-মধ্য এশিয়ার সাংস্কৃতিক উপাদানের মিশেল ছিল। সেখানে থেকে অনেক কিছু এল বাঙালী সংস্কৃতিতে। তারপর এদেশে যখন ইউরোপীয়রা এলেন, তখন তাঁরা এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ ঘটালেন আরো একটি সংস্কৃতির। এভাবে বাংলার সংস্কৃতিতে অনেক সংস্কৃতি- প্রবাহের দান এসে মিশেছে। আর নানা উৎসের দানে আমাদের সংস্কৃতি হয়েছে পুষ্ট। বাংলার প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের সংস্কৃতিতে দান করেছে স্বাতন্ত্র্য। ভৌগোলিক বৈশিষ্টে্যর দরুন বাংলায় বিভিন্ন রাজত্ব যেমন স্থায়িত্ব লাভ করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি বাংলার এই বিচ্ছিন্নতার ফলে ধর্মমতের ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ও উদ্ভাবন দেখা দিয়েছে। বাংলার সাহিত্য-সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বৈচিত্রে্যর প্রভাব লক্ষ করা যায়। সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য গান করে লেখা ‘মনসামঙ্গল’ কাবে্যর উঞগ¢ব র্পূব বঙ্গের জলাভমিতে, পন্ডিম বঙ্গের রুক্ষ মাটিতে বিকাশ বৈষ্ণব পদাবলীর। নদীমাত…ক র্পূব বঙ্গে ভাটিয়ালি গানের বিস্ত ার, শুষ্ক উত্তর বঙ্গে ভাওয়াইয়ার, আর বাংলা পন্ডিমাঞ্চলে কীর্তন ও বাউলের। শিল্পসামগ্রীর লভ্যতাও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই বাংলার স্থাপতে্য পাথরের চেয়ে ইট আর মাটির প্রাধান্য, মৃৎফলক এখানকার অনন্য
১ক্ত৬ মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য
সৃষ্টি। বাংলার ভাস্কর্যেও মাটির প্রাধান্য, আর সেই সঙ্গে দেখা যায় এক ধরনের সামগ্রীর ওপরে অন্য ধরনের সামগ্রীর উপযোগী শিল্প সৃষ্টির প্রয়াস। অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বাংলার মানস-সংস্কৃতি প্রধানত আশ্রয় করেছে সাহিত্য ও সঙ্গীত, অধ্যাত্মচিন্তা ও দর্শনকে। স্বল্প হলেও স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাংলার দান আছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিতের সাধনার তেমন ঐতিহ্য বাংলায় গড়ে ওঠে নি। ফলিত বিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্রে-আয়ুর্বেদশাে ̄¿ বাংলার একটা ভমিকা ছিল, কিন্তু তাও ছিল সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলার অগ্রগতি দেখা দিয়েছিল মলত কারুশিল্পে। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই কারুশিল্প বিকশিত হলেও এর প্রযুক্তিতে বৈপ−বিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন হয়েছে ইংরেজ আমলে। তবে সে প্রযুক্তি বাংলার নিজস্ব সৃষ্টি নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে ধার করা। বাংলার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট হতে থাকে খৃস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে। এই স্বাতন্ত্র্য দেখা দেয় শাসন-ব্যবস্থায়, সামাজিক জীবনে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও লিপির বিকাশ সে স্বাতন্ত্র্যকে অর্থর্পূণ করে তোলে। বহিরাগত মুসলমানরা এদেশ জয় করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে। মুসলমান শাসকেরা বাংলা ভাষা ও সাহিতে্যর পৃষ্ঠপোষকতা করে তার বিকাশে সহায়তা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে মুঘলরা বাংলাদেশ জয় করেন। মুঘল আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আগের মত রাষ্টধীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নি, তবে একটা বৃহত্তর পরিবেশের সঙ্গে তখন বাংলার সংস্কৃতির যোগ ঘটে। তারপর আঠারো শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে যোগাযোগের পরিধি আরো বিস্ত…ত হয়; বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার যোগ সাধিত হয়। ঐ সময় র্পূযন্ত বাংলাদেশে উচ্চ বর্গের সংস্কৃতির সঙ্গে নি¤œ বর্গের সংস্কৃতির কিছু কিছু ভেদ ছিল। কারুশিল্পের ক্ষেত্রে ভেদটা খুব চোখে পড়ে। এর একটা ধারা ছিল উচ্চ শ্রেণীর ভোগ্য-রুপোর কাজ, হাতির দাঁতের কাজ, রেশমী ও উঁচু মানের সুতি কাপড়ের শিল্প; অন্য ধারাটা ছিল সাধারণের ভোগ্য-শাঁখের ও পিতলের কাজ, নকশী কাঁথা, পাটি, আলপনা। সমাজে উঁচু র্পূযায়ে সংস্কৃত বা ফারসির যে-চর্চা হত তা নিচু স্তরকে স্র্পূশ করে নি। ধধুপদী সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত চর্চার মধ্যেও এমনি পার্থক্য ছিল। লোকসাহিত্য ও শিষ্ট সাহিতে্যর ভেদও ছিল। তবে বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীত সমাজের প্রায় সকল স্তরকে স্র্পূশ করতে সমর্থ হয়েছিল। এইজনে্য বাংলার মানস-সংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রাধান্য সাহিত্য ও সঙ্গীতের। ইংরেজ আমলে যে নতুন সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে, তার প্রেরণা এসেছিল প্রধানত পা-াত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে। পা-াত্য শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের যোগ ঘটে নি, তারা এর বিকাশে এবং এর উপভোগ্যতায়ও অংশ নিতে পারে নি। একালের সাহিত্য-সঙ্গীত-নাটক-চিত্রকলা প্রধানত নগরের সৃষ্টি। এর অর্থে আমাদের মানক-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রপ নির্মিত হয় উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর মুষ্টিমেয় ইংরেজী শিক্ষিতের হাতে। ঔপনিবেশিক নয়, কিন্তু আগের মতই শ্রেণীবিভক্ত। তাই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সকলের অধিকার সমান নয় এবং এক শ্রেণীর সৃষ্ট সংস্কৃতিতে অন্য শ্রেণীর প্রবেশাধিকার নেই; আবার এক শ্রেণীর সৃষ্ট সংস্কৃতি অন্য শ্রেণীর পক্ষে রুচিকর নয়। সমাজের বৈপ−বিক পরিবর্তন না হলে এই অবস্থার কোনো বদল আশা করা যায় না। আঠারো শক র্পূযন্ত বাংলার সাংস্কৃতিকে এক অর্থে ধর্মমুখী বলা যায়। বৈষ্ণব সাহিত্য বা মঙ্গলকাব্য, ইসলাম ধর্মবিষয়ক রচনা বা নবীজীবনী, কীর্তন বা শ্যামাসঙ্গীত তার উদাহরণ। এমনকি আধ্যাত্ম-তত্ত্বাশ্রিত প্রণয়োপাখ্যানও এর মধ্যে ধরা যায়। তবে এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীতে নানা ধর্মসম্পধদায়ের বক্তব্য একই সঙ্গে স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, ধর্মকলহের পাশাপাশি এক ধরনের সমন্বয়- চেতনা কাজ করেছে- যোগ ও সুফীবাদের সমন্বয় আর বাউল গান তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ত…তীয়ত, এর সব ক্ষেত্রেই শেষ র্পূযন্ত ধর্মীয় বস্তুর চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানবিকতা। বৈষ্ণব কবিতা বা আধ্যাত্মিক
মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য ১ক্ত৭
প্রণয়কাহিনী তত্ত্বের চেয়ে প্রেমের কাহিনীরপেই আদৃত হয়েছে, মঙ্গলকাবে্য দেবতার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষ। অবৈষ্ণব কবি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ লিখেছেন, অমুসলমান কবি লিখেছেন কারবালা-কাহিনী। এই মানবিকতাকে যদি বাঙালী সংস্কৃতির একটা মুখ্য প্রকাশ বলে গণ্য করি, তাহলে উনিশ-বিশ শতকের বাংলা সংস্কৃতিতে সেই মানববাদের বিচিত্র রপ প্রত্যক্ষ করি। পুরনো ধারার সংস্কৃতিতে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ আছে। একালের সংস্কৃতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা সরবে শোনা যায়। এই দিক দিয়ে দেখলে আমাদের সংস্কৃতির প্রবহমান ধারায় মানবকল্যাণ ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি সু স্পষ্ট পক্ষপাত ফুটে উঠেছে। আমাদের সংস্কৃতির বিচিত্র রপ নিয়ে যেমন আমরা গর্ব করতে পারি, তেমনি তার এই ভাববস্তুও আমাদের গৌরবের বিষয়।
শব্দার্থ ও
টীকা : প্রবৃত্তি- অভ্যাস, অভিরুচি, ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী- পৃথিবীর ভাষাসম-তে তাদের উৎপত্তি অনুসারে কয়েকটি পরিবারে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী অন্যতম। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজী ইত্যাদি প্রধান ভাষাগুলো এ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, নৃ-তাত্ত্বিক- জাতি গোষ্ঠী সম্র্পূকিত, আর্য নরগোষ্ঠী- প্রাচীন ইরাক- ইরান অঞ্চল থেকে আগত জনগোষ্ঠী, মনসামঙ্গল- মধ্যযুগের কবি চন্ডিদাস রচিত কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থে সাপের দেবমিনসার বন্দনা করা হয়েছে, বৈষ্ণবপদাবলী- মধ্যযুগে রচিত ভক্তিমলক কবিতা। কবি জয়দেব একজন বিখ্যাত বৈষ্ণবপদাবলীর কবি, আয়ুII্বররȠƦশা ̄¿- দেশজ চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্র্পূকিত গ্রন্থ, কারুশিল্প- হস্তনির্মিত শিল্প যেটি একাধারে সুন্দর ও প্রাত্যহিক কাজে লাগে, সপ্তম- অষ্টম শতাব্দী-৬০০- ৭০০ শতাব্দী, সুফিবাদন্ড মুসলিম ধর্মীয় মতবাদ।