উপবৃত্তি প্রদানে দুর্নীতি

উপবৃত্তি প্রদানে দুর্নীতি

বরগুনা সদর উপজেলার সাহেবের হাওলা গ্রামের মো. আলাউদ্দিন মিয়ার ছেলে মো. তারেক। ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তিনি বরগুনা সরকারি কলেজে বিবিএস তৃতীয় বর্ষে পড়েন।

অথচ ২০১৩ সালেই তাঁকে পূর্ব গুদিঘাটা নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী দেখিয়ে তোলা হয়েছে উপবৃত্তির টাকা।

ঘটবাড়িয়া গ্রামের মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে নাঈমুর রহমান প্রান্ত ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাশের ২ নম্বর পূর্ব ঘটবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। ২০১৬ সালে সে ঘটবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। অথচ ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাকে নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেখিয়ে উপবৃত্তির টাকা তোলা হয়েছে।

আঙ্গারপাড়া গ্রামের আবুল কালামের মেয়ে তাঞ্জিলা আক্তার ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আঙ্গারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। নিয়মানুযায়ী অগ্রণী ব্যাংক বরগুনা শাখায় তার একটি হিসাব খোলা হয়। যে হিসাব নম্বরের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা তোলা হতো। অথচ একই সময়ে তার নামে নুরিয়া সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ের অধীনেও অগ্রণী ব্যাংক বরগুনা শাখায় দুটি পৃথক হিসাব নম্বর খোলা হয়। দুটি হিসাবের মাধ্যমে এই বিদ্যালয় ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে উপবৃত্তির টাকা তুলে আত্মসাৎ করে।

এভাবে অর্ধশতাধিক ভুয়া নাম ব্যবহার করে কৌশলে ব্যাংক হিসাব খুলে বছরের পর বছর ধরে উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ভবন মেরামতের নামে সরকারিভাবে বছর বছর যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কোনো কাজ না করে তার সবটাই চলে গেছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও তার সহযোগীদের পকেটে।

সম্প্রতি সরেজমিনে সাহেবের হাওলা গ্রামের ১৪ নম্বর পূর্ব গুদিঘাটা নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ ভবনের চারটি কক্ষ। একটি ঝুঁকিপূর্ণ, সারা বছর থাকে তালাবদ্ধ। একটির কোনো দরজা নেই, তাই সারা বছর খোলা। চার হাত প্রস্থ আর আট হাত দৈর্ঘ্যের আরেকটি কক্ষে আছে জরুরি কিছু কাগজপত্র। পলেস্তারা খসা, নড়বড়ে বাকি একটি কক্ষে চলে পাঠদান। প্রথম থেকে পঞ্চম পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণিকক্ষ বলতে এই একটিই।

স্থানীয়রা জানায়, বিদ্যালয়টিতে প্রধান শিক্ষকের পদ খালি। সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক রয়েছেন চারজন। একজন সারা বছর রাজনীতি করেন। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মারামারি মামলার আসামি হয়ে সাময়িক বরখাস্ত। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় বেশির ভাগ সময় থাকেন অনুপস্থিত। বরগুনার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। মাসের বেশির ভাগ দিন থাকেন তিনি বরগুনা সদরে। তাঁর পক্ষে বদলি হিসেবে শিক্ষকতা করেন স্থানীয় এক যুবক। সুযোগ পেয়ে অন্য দুই শিক্ষকও বিদ্যালয়ে আসেন খেয়ালখুশি মতো।

পরিদর্শনের দিন একটি কক্ষে তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণির ১৬ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা নিচ্ছেন যুবক ইব্রাহীম হোসেন সুমন (২০)। তিনি জানান, তাঁর এক পা নেই। ছোট বেলায় পাওয়ার টিলার দুর্ঘটনায় তা কেটে ফেলতে হয়েছে। সেই থেকে কৃত্রিম পা লাগিয়ে চলেন। বরগুনা সরকারি কলেজে স্নাতক (সম্মান) পড়ছেন তিনি। বাড়িতে যে ১০-১৫ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ান তাদের সবাই এই বিদ্যালয়ে পড়ে। এখানে তিনি বদলি শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।

সুমন বলেন, ‘শিক্ষিকা শামীমা নাসরিনের ছেলে অসুস্থ, আসেননি। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত। শিক্ষক মোশারেফ হোসেন দীর্ঘদিন ধরে সাময়িক বরখাস্ত। আরেক শিক্ষিকা শিরীন ব্যস্ত পারিবারিক জরুরি কাজে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন অভিভাবক জানান, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার অ্যাডহক কমিটির সভাপতি সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) মো. মনির হোসেন। তাঁর সঙ্গে যোগসাজশ করে অনিয়ম করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবুল হোসেন।

গ্রামবাসী মো. বেলাল হোসেন (৩০) বলেন, ‘এই বিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে মিথ্যা মামলার আসামি হতে হয়েছে। ’ একই কথা বলেছেন চাঁদাবাজি মামলার আরেক আসামি মো. হালিম দফাদার (৬০)।

নুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবুল হোসেন বলেন, ‘স্কুলের কাজে আমাকে বিভিন্ন সময় বরগুনা সদরের শিক্ষা অফিসে থাকতে হয়। তাই সুমনকে অর্থের বিনিময়ে স্কুল পরিচালনার জন্য রেখেছি।

অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও এটিইও মো. মনির হোসেন বলেন, ‘বাইরে থেকে অনেকে অনেক কথা বলেন। সব সত্য নয়। ঠিকঠাক মতো স্কুলটি চলছে। ’ অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মানুষ তো কত কথাই বলে।

ফুলঝুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনিয়ম সম্পর্কে জানা আছে।

বরগুনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মজিদ বলেন, ‘স্থানীয় এক অধিবাসীর দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

 

আরো পড়ুন:

ডাচ-বাংলা ব্যাংকে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ, ৩৫ লাখ অ্যাকাউন্ট বন্ধ

সরকারি কর্মচারীর সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করেছে (বিকেকেবি)

এসএসসি/এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্য সোনালী ব্যাংক শিক্ষাবৃত্তি ২০১৭

এসএসসিএইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের জন্য বিভিন্ন জেলা পরিষদের শিক্ষাবৃত্তি

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline