৩৮ তম বিসিএস প্রস্তুতি – অধ্যাপক রুহুল আমিন পার্ট – ২

সিরিয়া সংকট সমাধানে মেগাপ্লান

মুহাম্মদ রুহুল আমীন
,

……..
গত কয়েক বছর ধরে সিরিয়ায় অনুসৃত পাশ্চত্য নীতির তালগোল পাকানো অবস্থা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের জবর-দখলের লক্ষ্য ব্যর্থ হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহ বাশার-বিরোধী বিদ্রোহীদেরকে সর্বমুখী সহায়তা দিয়ে বাশারকে উত্খাত করে তাঁদের তাবেদার গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ইরান ও রাশিয়ার মদদপুষ্ট সিরিয়ার লৌহমানব বাশার আল-আসাদ পাশ্চাত্যের সে মহাপরিকল্পনা নস্যাত্ করতে সক্ষম হয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভা চলাকালে সংঘটিত আলাপ-আলোচনায় সিরীয় সংকট সমাধানের নতুন পরিকল্পনা আঁকা হচ্ছে, যাতে সকলের অংশগ্রহণে সিরীয় সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
,
এ প্রেক্ষিতে এই নিবন্ধের মূল লক্ষ্য হলো- সিরীয় সংকট সমাধানের লক্ষ্যে একটি মেগাপ্লানের ধারণা তৈরী করা, যাতে আধিপত্যবাদ পরিহার করে কেবল কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে সকলের অংশগ্রহণে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া যায়। প্রথমে আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো কেন সিরিয়া সংকটটি এত ঘনীভূত হলো।
,
আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিক্ষার্থী হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ হলো সিরীয় জনগণের স্বার্থে সিরীয় সংকট সমাধানে বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণের পরিবর্তে প্রবল ক্ষমতাধর কতিপয় পাশ্চাত্য রাষ্ট্র তাদের স্বার্থ-বিরোধী প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নগ্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সিরিয়ার জনগণের মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে কেবল দখল-তত্ত্ব জিইয়ে রাখতেই বাশারকে উত্খাত করতে তারা তত্পর হয়। এমনকি সিরিয়ার প্রতিবেশী ও মৈত্রী রাষ্ট্র ইরান ও রাশিয়ার স্বার্থকেও পাশ কাটাতে চেষ্টা করে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিরীয় সংকট এতই জটিল হয়ে উঠে, যার সমাধান করা হয়ত সম্ভব হবে না এমন ধারণা জন্মলাভ করে।
.
সিরিয়াতে কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে, শনাক্ত করা দুরূহ। কোন যুদ্ধ বা দ্বন্দ্বে সাধারণত পরস্পর বিরোধী দুটি পক্ষ থাকে। কিন্তু সিরীয় সংকটে বহু-পক্ষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো পক্ষগুলোর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও প্রকট। ফলে কোন পক্ষ বা কোন যোদ্ধা জানে না কোন পক্ষ বা কোন যোদ্ধার বুলেট তার বুক ঝাঝরা করে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সিরিয়ানরা অস্ত্র তুলে নেয়। কিন্তু অচিরেই সেই বিদ্রোহীদের মধ্যে নানা মত, পথ এবং ধারা গোচরীভূত হয়। তাদের কেউ আল-কায়েদার অনুসারী, কেউ তালেবানপন্থী, কেউ আবার সেক্যুলার আবার কেউ তুর্কীপন্থী। সবাইকে চমকে দিয়ে অভিভূত হয় ইসলামী স্টেটের ভয়ংকর, শক্তিশালী, প্রশিক্ষিত যোদ্ধারা। একদিকে এরা সকলেই বাশারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে তারা পাশ্চাত্যের মিত্র। অন্যদিকে তারা পৃথকভাবে পাশ্চাত্যের দুশমন। তাহলে বাশারকে কি শুধু গদিচ্যুত করলেই পাশ্চাত্যের স্বার্থ রক্ষা হবে? বাশারকে উত্খাত করা সম্ভব হলে বাশার-বিরোধীরা শীঘ্রই আরো অনেকগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। প্রথমে তারা আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একে-অন্যের বিরুদ্ধে লড়বে। এরপর শুরু হবে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে তাদের তৃতীয় পর্যায়ের মারাত্মক লড়াই। সেই ভয়ংকর যুদ্ধসমূহের পূর্বাভাস যখন মিলছে, তখন তা প্রতিহত করতে এখন প্রয়োজন একটি বৃহত্ সিরিয়া পরিকল্পনার। সেই মেগাপ্লানের প্রকৃতি ও পরিধি কি হবে, তা জানা দরকার। আন্তর্জাতিক সমাজের প্রধান কর্তব্য হবে বিবদমান পক্ষগুলোর সবার প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়ার নিরাপত্তা এবং অখণ্ডতা রক্ষায় পবিত্র দায়িত্ব তাদের এবং সে কারণে তাদেরকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার সকল উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। সিরীয় সংকট সমাধানে এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কারের এবং সেই লক্ষ্যে বাশারসহ বিবদমান সকল পক্ষকেই যত্নবান হতে হবে। বিবদমান পক্ষগুলোর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে বাশার বিরোধী কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই সিরীয় সংকটের সমাধান হবে না। তাই আলোচনার টেবিলে বাশারের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি দরকার। যতটুকু জানা যায়, বাশার নিজেও সিরিয়ার রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার সফল করতে হলে সিরিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী ইরান এবং স্ট্রাটেজিক পার্টনার রাশিয়ার ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা যাবে না। আশার কথা হলো জাতিসংঘের সাম্প্রতিক ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা করেছেন যে, ইরান বা রাশিয়া যেই হোক, সিরিয়া সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র সবার সাথে কাজ করতে প্রস্তুত।
.
অর্থাত্ দেরিতে হলেও পাশ্চাত্য তাবেদার রাষ্ট্রসমূহ সিরীয় সংকট সমাধানে সকলের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। পূর্বে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর ধারণা ছিল, এক ফুত্কারে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয় স্বার্থ জীবিত রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু সিরিয়া ইস্যুতে ইউরোপ এখন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর রয়টার্স এবং যুক্তরাজ্যের সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকা জানিয়েছে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন স্বল্প মেয়াদে বাশারকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়ার পক্ষে। এ সময়ে সিরিয়ায় তারা ঐকমত্যের সরকার গঠনে কাজ করতে আগ্রহী। বাশারের সাথে সংলাপে না বসায় মার্কিন নীতি থেকে ক্রমে সরে যাচ্ছে ব্রিটিশ নীতি-নির্ধারকগণ। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেলও বলেন, অনেক পক্ষের সাথে কথা বলা উচিত, যার মধ্যে থাকবেন বাশার আল-আসাদও। ইতোমধ্যে জার্মানি প্রস্তাব দিয়েছে। যাতে সিরিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়।
.
সিরীয় সংকট সমাধানে যে বৈশ্বিক পরিকল্পনা উদীয়মান হচ্ছে, তার বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সমাজের দায়বদ্ধতা প্রচুর। বিশেষ করে পাশ্চাত্য বৃহত্ রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্যবাদী নীতির কারণে, সিরীয় সংকট ঘনীভূত হয়েছে। এ উপলক্ষে যখন সর্বত্র জেগে উঠেছে তখন সকলের উচিত সিরীয় প্রকল্পের বাস্তবায়নে নির্মোহ ভূমিকা রাখা। সকলের অংশগ্রহণে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সিরীয় সরকার গঠনে বৈশ্বিক শক্তিসমূহের উচিত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সিরীয় সংকটের সমাধান হলে সিরিয়াসহ অত্রাঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে, যেটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজন। তদুপরি ইরান ও রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের যে প্রীতি সম্পর্কের দুর্গ উন্মোচিত হয়েছে, তার স্থায়িত্বের স্বার্থেও সিরীয় সংকটের সমাধান জরুরি।
.
লেখক :প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিন, স্কুল অব বিজনেস এন্ড সোস্যাল সাইন্সেস, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

আরো পড়ুন:

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৪১

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৪২

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৪৩

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline