৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি :
সু চি কি মিয়ানমারের ভাগ্য বদলাতে পারবেন? যদিও কম গুরুত্বপূর্ণ তারপরেও ধারাণা রাখা ভালো। ।
.
সম্প্রতি মিয়ানমারের পার্লামেন্ট একটি শক্তিশালী আইন পাস করে সরকারি দলনেতা অং সান সু চিকে দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার (State cunselor) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন এই অদ্ভুত বিধান। দীর্ঘকাল পরে দেশটিতে গণতন্ত্রের শুভযাত্রা শুরু হয়েছে। সু চির ছিল NLD (National League for Democracy)। গত নভেম্বর ২০১৫ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে। সেনাশাসনের পাঁচ দশকের অধিক দীর্ঘ অন্ধকারের নিচে থাকা মিয়ানমারের মুক্তিকামী জনতা সঙ্গত কারণেই চাইবে তাদের প্রিয় নেতা গণতন্ত্রকন্যা সু চি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ কর কিন্তু বার্মায় সামরিক শাসনের বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেলেও সামরিক আধিপত্যবাদের হ্যাংওভার এখনো শেষ হয়নি। সেনাবাহিনী রচিত সংবিধান তাই জন্মসূত্রে মিয়ানমারের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও এমনকি নোবেল পুরস্কারের মতো সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পরও কেবল ব্রিটিশ সন্তানদের জননী হওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট মনোনীত হওয়া থেকে বিরত রাখে। সু চিও ইলেকশন প্রচারাভিযানের সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ঊর্ধ্বে থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছিলেন। কিন্তু রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনায় তার নির্বাহী দায়িত্ব গ্রহণের অনিবার্যতা দেখা দেয়। এদিকে প্রচলিত সংবিধানের সাথে বিরোধপূর্ণ হওয়ায় পার্লামেন্টে নতুন আইন পাস করে সু চিকে এই স্টেট কাউন্সিলরের দায়িত্ব দেয়ার বিধান রচনা করা হলো।
.
স্টেট কাউন্সিলরের এই অবস্থান সু চিকে আইন বিভাগের সাথে নির্বাহী বিভাগের কাজের একটি সমন্বয় সাধনে সক্ষম করবে। এ ছাড়াও তিনি রাষ্ট্রপতির দপ্তরের মন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন। এভাবে সু চি তার পূর্ব ঘোষিত above the president-এর ভূমিকাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বন্দোবস্ত করেন। অবশ্য পার্লামেন্টের ২৫% সামরিক প্রতিনিধি সু চির এই স্টেট কাউন্সিলরের দায়িত্ব গ্রহণের সাংবিধানিক আয়োজনকে প্রচলিত সংবিধানের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক অভিহিত করে সু চির সমালোচনা করেন। সামরিক বাহিনী ছাড়াও আরো অনেকে সু চি
সরকারের মতো একটি নতুন বিকাশশীল সরকারের জন্যে এই আইনকে এক মারাত্মক নজির হিসাবে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য অনেকেই এই যুগান্তকারী আইনি সংস্কারকে অর্ধ শতকের অধিককাল সময় পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের দ্বারা সৃষ্ট একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত মনে করছেন। তবে প্রেসিডেন্টের পদ কার দখলে যাবে তা নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন উত্তরহীনই থেকে যাচ্ছে। তবে সকল সমালোচনাকে মাথায় রেখেই বলা চলে সু চির এই আইনি সংস্কার তাকে অধিকতর ক্ষমতাশালী করার চাইতে ক্ষমতাকে অধিকতর কার্যকরভাবে পরিচালিত করার অভিপ্রায়ের সাথে বেশি সম্পর্কিত।
.
আধুনিক মিয়ানমার, সাবেক বার্মার রাজনৈতিক ইতিহাস ঘটনাবহুল। ১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত দেশটি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ছিল। সু চির পিতা জেনারেল অং সান এবং বার্মার আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা, এক সফল মধ্যস্থতার মাধ্যমে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দেশটির স্বাধীনতা অর্জন করেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে নিহত হন। ১৯৬২ সালে জেনারেল হন উনি এবং তার সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির নেতৃত্বে এক শক্তিশালী সামরিক জান্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। জেনারেল অং সানের কন্যা সু চি বার্মার স্বাধীনতার ৩ বছর পূর্বে এবং তার বাবার মৃত্যুর পর ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে লেখাপড়ার জন্য যুক্তরাজ্য যান এবং ১৯৮৮ সালে বার্মার এক উত্তাল রাজনীতির সময়ে অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে ফেরেন। জেনারেল নে উইন সবেমাত্র পদত্যাগ করেছেন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনীতি নিয়ে দেশব্যাপী এক চরম অসন্তোষ বিরাজ করছিল। ১৯৮৮-এর আগস্টে প্রতিবাদ মিছিলে মিলিটারি ক্র্যাকডাউনে হাজার হাজার লোক নিহত হয়। সেই প্রবল উত্তাল গণআন্দোলন থেকে জন্ম লাভ করে সু চির রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সু চি এক গণতান্ত্রিক সরকারের দাবির এজেন্ডা জনসম্মুখে তোলেন। সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (NLD) প্রতিষ্ঠিত হয় (সেপ্টেম্বর ২৭, ১৯৮৮)। কিন্তু সকল গণদাবি উপেক্ষা করে জেনারেল স মঙ-এর নেতৃত্বে নতুন সামরিক জান্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। এক মুক্তি বার্মা সৃষ্টির জন্য সু চি তার জীবন ও রাজনীতিকে উত্সর্গ করেন। ‘যখন কারো হাতে বন্দুক থাকে না, তিনি তার মন ব্যবহার করার চেষ্টা করেন, সমাধানের জন্য সমবেদনা ও বুদ্ধির এক সমন্বয়।’ সু চির রাজনীতির এই সর্বজনীন লক্ষ্য তাকে গণতন্ত্রের বর্মীয় চ্যাম্পিয়ন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। NLD-এর মাধ্যমে বার্মার দীর্ঘবাহিত সামরিক ঐতিহ্যকে পরিহার করে গণতন্ত্রের বিজয় কেতন ওড়াবার ব্রত তিনি গ্রহণ করেন। NLD-এর ১ম নির্বাচনে ১৯৯০ সালে গৃহবন্দি হিসাবে নির্বাচন করেও ৮৩% পার্লামেন্টারি সিট উইন করেন কিন্তু সামরিক জান্তা সে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। সু চি তার রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করেন এবং তার গৃহবন্দিত্বকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক প্লাটফর্ম হিসাবে দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। ১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক চাপে তাকে মুক্ত করা হয়। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণের অনুমতি পেলেও দেশত্যাগের কোনো অনুমতি তাকে দেয়া হয় না। বন্দিনী সু চি ক্রমাগত ক্ষমতাশীল হতে থাকেন।
.
২০০০ সালে আবার সু চিকে গৃহবন্দি করা হয়। একজন বৌদ্ধ হিসাবে, সু চির নিজের ভাষ্যমতে, এই প্রলম্বিত অন্তরীণ সু চিকে দুঃখের স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করে। এক নতুন রাজনৈতিক দীক্ষা দেয়। সু চি সিদ্ধান্তে পৌঁছান: ‘যদি দুঃখ আমাদের অস্তিত্বের এক অনিবার্য অংশ হয়ে থাকে, তবে তাকে পার্থিব, বাস্তবসম্মত উপায়েই পরিহার করার চেষ্টা করতে হবে।’ গৃহবন্দি অবস্থায় সু চি তার দেশ ও মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছেন, মানব পাচারের নির্মমতার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন থেকেছেন। ২০০২ সালের মে মাসে মুক্ত হয়ে NLD’র জন্য ব্যাপক প্রচারাভিযানে নামেন এবং আবারো ২০০৩ সালের মে মাসে গৃহবন্দি হন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্যাপক সমর্থন পান যারা তার মুক্তির জন্য বর্মী সরকারকে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। ২০১০ সালে নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে এক সপ্তাহ পরে তাকে মুক্ত করা হয়। প্রয় সাড়ে সাত বছরের বন্দি জীবনের অবসান ঘটে। সু চি একজন আত্মনির্মাণকারী রাজনীতিবিদ। তার নেতৃত্ব-প্রতিভাকে পিতৃ ঐতিহ্যজাত বললে তার ওপর অবিচার করা হবে। প্রখ্যাত অহিংসবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং মহাত্মা গান্ধীর প্রভাব তার রাজনৈতিক জীবনে প্রবল।
.
সু চি একজন মানবতাবাদী দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। নভেম্বর ২০১৫ নির্বাচনে তার পার্টি ক্ষমতায় আসায় দীর্ঘকাল সামরিক জাঁতাকলে পিষ্ট মিয়ানমার নতুন স্বপ্ন বোনা শুরু করেছে। সু চি ঘোষণা করেছেন, তার প্রধান লক্ষ্য জাতীয় সমন্বয় ও সংহতি রক্ষা করা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক আধুনিক গণতান্ত্রিক ও সুসংহত মিয়ানমার গড়ে তোলাই তার এবং তার NLD-এর ঘোষিত লক্ষ্য। সু চির ভাষায় :‘অনেক পাহাড় এখনো ডিঙ্গোতে বাকি, অনেক ফাঁক এখনো জোড়া লাগাতে বাকি, বাকি অনেক বাধা অতিক্রম করতে।’ সু চির প্রধানতম বাধা হবে সামরিক প্রতিকূলতা। তার পার্লামেন্টের ২৫% সামরিক প্রতিনিধিত্ব— সর্বদাই গলার কাঁটা হয়ে থাকতে চাইবে। তার পরও দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং দক্ষিণ এশিয়ার তথা বিশ্ব শান্তির বৃহত্তম স্বার্থে মানবপাচার, রোহিঙ্গা প্রভৃতি সমস্যার একটা টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে এবং মিয়ানমারের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের স্থায়ী প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সু চির কোনো বিকল্প আপাতত চোখে পড়ে না। তারা শাসনতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য নানা ভূ-রাজনৈতিক কারণে কামনা করা যেতেই পারে। সু চি হতে পারেন মিয়ানমারের ভাগ্যবিধাতা।
.
:ড. রাশিদ আসকারী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
,ইত্তেফাক , ১৮ এপ্রিল।