প্রাইমারি স্কুলে ভুয়া শিক্ষক নিয়োগের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েকটি প্রতারক চক্র। সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে এই চক্রটি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এবার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার নামে প্রতারণা করছে চক্রটি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নাম স্বাক্ষর স্ক্যান করে ভুয়া নিয়োগপত্র বানিয়েও প্রতারণা করছে তারা। প্রতারণার পুরো এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। গত ৭ই নভেম্বর ডিপিই উপ-পরিচালক মাহবুবুর রহমান বিল্লা স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে জানানো হয়, এক শ্রেণির প্রতারক চক্র প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর স্ক্যান করে জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি দেয়ার নামে ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানায় একটি ডায়রি করা হয়েছে। এ ধরনের কোনো প্রতারক চত্রেুর কার্যত্রুম নজরে এলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউকে এইড’র অর্থায়নে পরিচালিত স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে চিঠির মাধ্যমে ইতিমধ্যে কোটি হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। এই আগে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকবার প্রতারক চত্রুটি ধরলেও আইনের ফাঁকে তারা বের হয়ে যায়। নতুন করে দেশের চরাঞ্চল ও রংপুরের কয়েকটি জেলায় চত্রুটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল মানবজমিনকে বলেন, এ প্রতারক চক্রের ব্যাপারে আমরা সর্ব্বোচ সতর্ক। ইতোমধ্যে একটি ডায়রি করা হয়েছে। তারা ভুয়া শিক্ষক নিয়োগের নামে নানা ধরনের প্রতারণা করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমরা সারা দেশে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসকে এটি জানিয়েছি। কেউ যেন এ ধরনের কোন প্রতারক চত্রেুর খপ্পরে না পড়ে সেজন্য সর্তক থাকার পাশাপাশি চত্রুটি ধরিয়ে দিতে বলেছি।
শরীয়তপুর জেলার দক্ষিণ ভাসানচর গ্রামের নার্গিস বেগম। গত সেপ্টেম্বরে প্রাইমারি এডুকেশনাল অর্গানাইজেশন লিমিটেডের (পিইওএল) নামে একটি সংস্থার চিঠি আসে। চিঠিতে বলা হয়, জাতিসংঘের দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত দুস্থ, গরিব শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা কার্যাত্রুম ভিশন-২০৪০ সংস্থায় আপনার আবেদনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সন্তুষ্ট হয়ে আপনাকে নির্বাচিত করছে। আপনার মাসিক বেতন হবে ২০ হাজার ৩৫০, তিন মাস পর মাসিক বেতনের ওপর বাসা ভাড়া ২৫ শতাংশ, চিকিৎসা ভাতা ২০ শতাংশ এবং অন্যান্য ভাতা আরও ১০ শতাংশ সঙ্গে যোগ হবে। বছরের দু’টি ঈদে বোনাস পাবেন। সরকারি ছুটিসহ সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন। চাকরি করার সময় টিএ/ডিএ বিল পাবেন। আপনার এলাকায় ও আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী মোটরসাইকেল প্রয়োজনে প্রাইভেট কার পাবেন।
তবে একজন প্রার্থীকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। সেজন্য নির্ধারিত তিনটি নম্বরে ৭ হাজার টাকা বিকাশ করতে হবে। টাকা বিকাশ করার দুইদিন পর মানব সম্পদ বিভাগ থেকে আপনার মৌখিক পরীক্ষার জন্য আপনার ঠিকানায় পুনরায় চিঠি ইস্যু করা হবে। মৌখিক পরীক্ষার দুই ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেয়া হবে। যারা পাস করবে তাদের তাৎক্ষণিক নিয়োগপত্র দেয়া হবে। আর যারা ফেল করবে তারা মোবাইলে মেসেজ দিয়ে বিকাশে পাঠানো টাকা ফেরত নিতে পারবেন। চিঠি পেয়ে নার্গিস বেগম ওই বিকাশ নম্বরে ৭ হাজার টাকা পাঠান। এরপর আর তার ঠিকানায় আর কোন চিঠি যায়নি। প্রায় দুইমাস পর চিঠিতে দেয়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের ঠিকানায় টেলিফোন করে ফোন বন্ধ পান।
পরে তার এক আত্মীয়কে দিয়ে ঢাকা মতিঝিলের সিটি সেন্টারে দেয়ায় ঠিকানায় গিয়ে ওই অফিসের খোঁজ মিলেনি। এরপর মাসখানের পর হঠাৎ ওই অফিসের মানব সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলেন, আপনি রেজিস্ট্রেশনের জন্য যে ৭ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সেটি আমরা পাইনি। এরপর নতুন আরও দু’টি নম্বরে আবার ৭ হাজার টাকা পাঠানোর কথা বলে তারা। এরপর ওই মহিলা আর টাকা পাঠাননি। এটি স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে অভিযোগ করেন ওই এলাকায় কয়েকশ’ ভুক্তভোগী। তারা জানান, প্রতারক চত্রুটি আমাদের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আবদুল সোবহান। গত অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশন নামের একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপিই উপ-পরিচালক নাম ও স্বাক্ষর করা একটি নিয়োগপত্র যায়। বছর দু’-এক চাকরি করার পর তার চাকরি জাতীয়করণ করা হবে বলে এমন নিশ্চয়তা দিয়ে তিন লাখ টাকা চায় এই প্রতারক চত্রু। এক লাখ দিয়ে বাকি বাকি টাকা জাতীয়করণ হওয়ার পর দিবেন এমন কথা সায় দেয়নি প্রতারকরা। তারা পুরো টাকা না দিলে কাজ আগাবেন না বলে জানান। তারপর আরও এক লাখ টাকা দেন। এরপর নাম সবস্ব একটি এনজিওর নিয়োগপত্র দেয়া হয়। এরপর বিষয় বুঝতে পেরে তিনি স্থানীয় জেলা অফিসকে জানান। জেলা অফিসের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের আরও প্রতারণা হচ্ছে বলে খবর পায় ডিপিই। এরপর সবাইকে সর্তক করে চিঠি ইস্যু করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনার স্বপ্ন, দেশ হবে রত্ন, জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন ইত্যাদি নাম ব্যবহার করে রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় এসব প্রতারণা করে বেড়াচ্ছে তারা। ঝরেপড়া পথশিশুদের শিক্ষাদানের জন্য তরুণ প্রি-ক্যাডেট স্কুল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউএসএআইডি, ইউকে এইড ইত্যাদি সংস্থার তাদের আর্থিক সহায়তা করছে বলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। এরপর জাতীয়করণের স্বপ্ন ও তাৎক্ষণিক ভালো বেতন চাকরি পাওয়ার আশায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন শিক্ষিত বেকারা। প্রত্যেক স্কুলে একজন প্রধান শিক্ষক, চারজন সহকারী শিক্ষক ও একজন দপ্তরি কাম অফিস সহকারী নিয়োগ দেয়া কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে। টাকা নেয়ার পর ওই চত্রুটি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর নতুন নাম দিয়ে প্রতারণা শুরু করে।
আরো পড়ুন:
0 responses on "স্কুলে ভুয়া শিক্ষক নিয়োগের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে"