
দেশে মাদকের ভয়াবহতা রোধ ও মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে চার বছর আগে বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্টের (মাদক পরীক্ষা) নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে ডোপ টেস্টের বিধান না থাকায় সর্বশেষ গত বছর আইনের সংশোধনীর খসড়ায় ডোপ টেস্টের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে মাদক ছড়িয়ে পড়ায় ফের ডোপ টেস্টে গুরুত্ব দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকাসক্তি দেখা দিলে প্রথম ডোপ টেস্টের চিন্তা করেছিল ডিএনসি। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে মাদকাসক্তি শনাক্ত হলে চালকদেরও ডোপ টেস্টের আওতায় আনার চিন্তা করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০১৩ সালে ডোপ টেস্টের একটি বিধিমালা পাঠিয়েছিল ডিএনসি। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর বিরোধিতার কারণে সেই প্রস্তাব অনুমোদন পায়নি।
ডিএনসির সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, শিক্ষার্থী, কর্মজীবী ও পরিবহন শ্রমিকদের মাদকাসক্তি প্রতিরোধেই ডোপ টেস্টের পরিকল্পনা করা হয়। অনুমোদন পেলে ডোপ টেস্টের কিড (মাদক শনাক্তকরণ সরঞ্জাম) সহজপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করবে ডিএনসি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা, স্কুল-কলেজে সন্দেহ হলে এবং পরিবহন চালকদের রাতে চালনা এবং সন্দেহ হলে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ডোপ টেস্ট করবেন। কেউ মাদকাসক্ত শনাক্ত হলে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে মাদকাসক্তি নিরাময় প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের পূর্ণ চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে প্রশাসন।
ডিএনসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, আগের দফায় ডোপ টেস্টের অনুমোদন চেয়ে না পেয়ে এবার অধিদপ্তর কিছুটা সাবধানী। তাই আইনের খসড়ায় শুধু পরীক্ষার কিড ব্যবহার এবং পরীক্ষার ব্যাপারে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। ডিএনসি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় প্রার্থীর পরীক্ষার এটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এক সভায় ভবিষ্যতের সব নিয়োগে ডিএনসিতে ডোপ টেস্ট করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এখন শুধু অনুমোদনের অপেক্ষা।
ডিএনসির আইন সংশোধন সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা বলেন, উন্নত বিশ্বে ক্ষতিকর মাদকের প্রভাব এবং ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি চালনা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসন ডোপ টেস্ট করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিসহ অনেক কাজেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার সঙ্গে ডোপ টেস্ট করানো হয়। এটিকে তারা স্বাভাবিকভাবে নেয়।
ওই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদকের ভয়াবহতার চিত্র উঠে এসেছে। এটি প্রতিরোধে ডোপ টেস্ট জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। সরকার অনুমোদন দিলে ডোপ টেস্টের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক বাণিজ্য চালানো দুই হাজার ৮৩৪ জনের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে ৪৪ প্রতিষ্ঠানের ৪২৭ জন কারবারির নামও জানা গেছে। গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠ এ নিয়ে প্রধান শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
ডোপ টেস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডোপ টেস্টের এটি আমরা চাইছি। এটি করতে পারলে ভালো হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করা প্রয়োজন এমন নয়, যেখানে প্রয়োজন করা যাবে। চাকরির ক্ষেত্রে হতে পারে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদক সেবনের প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে প্রাথমিকভাবে ডোপ টেস্টের চিন্তা করা হয়।
এদিকে মদ্যপ অবস্থায় বাজি ধরে ‘রেসে’ নেমে বা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মজা করতে অনিয়ন্ত্রিত গতিতে বেপরোয়া গাড়ি চালনার শিকার হচ্ছে পথচারীরা। এমনকি ফুটপাত দিয়ে হাঁটা ব্যক্তিও বেপরোয়া গাড়ি চালনার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) ১৪ বছরের তথ্যে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারায় পথচারীরা। এসব দুর্ঘটনার ৯১ শতাংশই ঘটে অতিরিক্ত গতিতে বেপরোয়া যানবাহন চালানোর কারণে।
ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৩০ শতাংশের ক্ষেত্রে দায়ী চালকের মাদক সেবন। এ কারণে চালকদের ডোপ টেস্টের পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। প্রাথমিকভাবে দূরপাল্লার নৈশকোচগুলোকে টার্গেট করা হচ্ছে। এসব রুটে দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে কম হলেও চালকরা রাতে নেশা করে বাস নিয়ে রওনা হয় দূরের পথে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, দূরপাল্লার অধিকাংশ চালক ও হেলপার নেশাগ্রস্ত থাকে। তারা টার্মিনালে বসে বা ফেরিঘাটে নেমে দেশীয় মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে।
আর শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্টের ব্যাপারে ডিএনসি সূত্র জানায়, শরীরে মাদকের উপস্থিতি পাওয়া গেলে ছয় মাস বা চিকিৎসকের পরামর্শ মতো বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে। এর পরও যদি কোনো শিক্ষার্থী মাদক পরিহার না করে তাহলে তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কারের প্রস্তাব দেওয়া হবে। ডিএনসির কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের সমন্বয়ে দল গঠনেরও চিন্তা করা হচ্ছে।
ডিএনসির এক কর্মকর্তা জানান, ডোপ টেস্টের মাধ্যমে ইয়াবা, কোকেন, হেরোইন, ফেনসিডিল ও গাঁজার উপস্থিতি শনাক্ত করা যাবে। প্রতিটি টেস্টের জন্য ১০০-১২০ টাকা খরচ হবে। ডোপ টেস্টের কিড (মাদক শনাক্তকরণ সরঞ্জাম) সহজপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করবে ডিএনসি। কিড সহজলভ্য হলে ঘরে বসেই মাত্র ১০০ টাকা খরচ করে সন্তানদের মাদকাসক্তি শনাক্ত করতে পারবেন অভিভাবকরা।
আরো পড়ুন: