বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও সমকালীন বিশ্ব
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান ।
একুশ শতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ……
একটি দেশ তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিংবা সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি অগ্রাধিকার পায় বেশি। অর্থাৎ যেখান থেকে রাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করতে পারবে বেশি, সেখানে এবং সেই দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে রাষ্ট্র তার স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। তবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক পরিমণ্ডল, কোনো কিছুকেই রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না। গত ৪৪ বছরের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে এ জাতীয় স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ হচ্ছে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘নেক্সট ইলেভেন’ (গোল্ডম্যান স্যাকসটের মতে) ভুক্ত দেশগুলোর কাতারে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে কতগুলো বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া। ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি দেখছে ৮ শতাংশ। এ জন্য দরকার বিনিয়োগে জিডিপির ৩৩-৩৪ শতাংশ। এ বিনিয়োগ এখনও নিশ্চিত হয়নি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এ বিদেশী বিনিয়োগকে আরও নিশ্চয়তা এনে দিতে পারে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে এগুলোই।
..
ট্রেডিশনাল ডিপ্লোম্যাসি বা সনাতন কূটনীতি এখন বদলে যাচ্ছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা, কানেকটিভিটি এখন প্রধান্য পাচ্ছে বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এখন তাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করছে আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিতে গড়ে উঠছে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ায়ও গড়ে উঠছে এমনি ধরনের একাধিক আঞ্চলিক তথা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। দুটি আঞ্চলিক তথা উপ-আঞ্চলিক সংস্থার নাম আমরা উল্লেখ করতে পারি- বিসিআইএম এবং বিবিআইএন এ দুটি সংস্থার ব্যাপারে বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে এবং বাংলাদেশ মনে করে এ দুটি আঞ্চলিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তার নিজের উন্নয়নকে তরান্বিত করতে পারবে। দুটি আঞ্চলিক সহযোগিতার সঙ্গে ভারত এবং চীন জড়িত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য সেখানেই নিহত, যেখানে বাংলাদেশ এ দুটি সংস্থাকে ব্যবহার করে তা জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নিতে পারবে। বিবিআইএন অর্থাৎ ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত নেপালকে নিয়ে যে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা তা পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে একদিকে সার্ক যেমনি দুর্বল হবে, ঠিক তেমনি বিসিআইএম জোটও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বলা ভালো মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ নীতিগতভাবেইে জোট গঠনে তার সম্মতি জানায়। বিবিআইএম মূলত একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
..
সাম্প্রতিককালে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান প্রদেশ, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমার) নামে যে অর্থনৈতিক জোটের জন্ম হয়েছে, তার উদ্যোক্তা কিন্তু চীন। ২০০৩ সালে চীন এ ধরনের একটি অর্থনৈতিক জোটের প্রস্তাব করে। চীনের উদ্দেশ্য ছিল চীনের ইউনান প্রদেশকে সামনে রেখে মিয়ানমার, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি জোট গঠন করা। চীনের ওই প্রস্তাবকে তখন চিহ্নিত করা হয়েছিল। ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘কুনমিং উদ্যোগ’ হিসেবে। কুনমিং হচ্ছে ইউনান প্রদেশের রাজধানী। কুনমিংয়ের সঙ্গে চট্টগ্রামের আকাশ দূরত্ব ব্যাংককের চেয়েও কম, মাত্র এক ঘণ্টা। আর কুনমিংয়ের আবহাওয়া আমাদের দেশের মতোই। কিন্তু দীর্ঘদিন ভারত চীনের এ প্রস্তাবের পেছনে কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর একটা উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলের সঙ্গে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর একটা যোগসূত্র স্থাপন করা। চীনের ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে ভারত তখন সন্দিহান ছিল। কেননা ভারত নিজে আসিয়ানের সদস্য হতে চায় এবং ইতিমধ্যে (২০০৭) আসিয়ানের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ এখন আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য। আসিয়ানের পূর্ণ সদস্য পদ পেতে হলে প্রথমে আঞ্চলিক ফোরাম ও পরে ‘ডায়লগ পার্টনার’-এর (দ্বিতীয় ধাপ) সদস্য হতে হয়। ভারত ‘ডায়লগ পার্টনার’-এর সদস্য। বাংলাদেশ এ পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। ভারতের অনাগ্রহের কারণে ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর জট খোলেনি। পরে বিসিআইএমের ধারণার বিকাশ ঘটে এবং এতে ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়। তবে বর্তমান মোদি জামানায় বিসিআইএম ধারণা আদৌ শক্তিশালী হবে কিনা, সে ব্যাপারে প্রশ্ন আছে। যদিও মোদি নিজে চীনের উন্নয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী। তিনি ২০০৬, ২০০৭ ও ২০১১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে চীন সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও চীনে গেছেন। একই সঙ্গে মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারেও মোদির আগ্রহ অনেক। ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে মিয়ানমারে। ভারত ইতিমধ্যে মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস আহরণে চুক্তি করেছে। ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানি সেখানে বিনিয়োগ করেছে। ভারত প্রাপ্ত গ্যাস নিয়ে যেতে চায় ভারতের সাত বোন রাজ্যে। এজন্য ভারত কালাদান প্রজেক্ট নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। কলকাতা থেকে মিজোরামে পণ্য পরিবহনের (মিয়ানমারের ওপর দিয়ে) লক্ষ্যেই এ ‘কালাদান প্রজেক্টটি’ ভারত হাতে নিয়েছিল। যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে অতি সম্প্রতি কানেকটিভিটির আওতায় ভারতের একটি ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় ওই কালাদান প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। ভারত এ রুটকে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেবে। তবে বিসিআইএমের ব্যাপারে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। বলা ভালো তিনটি রুটে ইউনানের সঙ্গে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে।
..
কিন্তু ক্রমশই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ভারত ও চীন ধীরে ধীরে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। চীন প্রকাশ্যে তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি নিয়ে পৃথিবীর ৫০টি দেশকে একটি পতাকাতলে আনতে চায়। ভারত মহাসাগরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এই স্ট্র্যাটেজির অন্যতম অংশ। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ভারতের স্বার্থের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ কারণে ভারত তার পাঁচ হাজার বছরের পুরনো ‘কটন রুটকে’ আবার নতুন আঙ্গিকে পুনর্গঠন করছে। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌ-বাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে ‘চোল হ্রদ’ বলা হতো। ভারত আবারও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফলে ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ভারত দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ফলে বিসিআইএম জোট নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকবেই। এ জোটের ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ এখন অনেক কমে যাবে। তার অগ্রাধিকার তালিকাায় উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন জোট গুরুত্ব পাবে বেশি।
..
এক সময় বাংলাদেশের অসহযোগিতার কারণে ভারত ‘কালাদান’ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। বাংলাদেশের সঙ্গে কানেকটিভিটি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করেছে। তাই কালাদান প্রজেক্ট গুরুত্ব পাবে কম। এখন দেখার বিষয় ভারত আদৌ কালাদান প্রজেক্ট পরিত্যাগ করে কিনা?
..
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের বিপুল জ্বালানি চাহিদাও পানি সমস্যার সমাধানে এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (বিবিআইএন) একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে ভারতের মনোভাবের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ভারত যদি দ্বিপাক্ষিক দৃষ্টিকোণের আলোকে বিবিআইএন জোটকে তার স্বার্থে ব্যবহার করে, তাহলে এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের যে অগ্রাধিকার, তা বাধাগ্রস্ত হবে। এতে করে বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি বিকশিত হবে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি এক সময় যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এ পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা শোনা যায় না। এমনকি সরকারপ্রধান কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেও এটা প্রমাণিত হয়নি যে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে। বলতে গেলে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলেই (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখিতার কথা বলে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনার দার দৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশের গত ৪৪ বছরের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্ব দিগন্তের দেশগুলো ছিল উপেক্ষিত। বিশেষ করে মিয়ানমার কিংবা থাইল্যান্ডের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার কোনো বড় উদ্যোগ অতীতে লক্ষ করা যায়নি। পূর্বমুখী নীতি বলতে সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব ও প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, জোরদার ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগকে বোঝায়। এটি ছিল অনেকটা উপেক্ষিত। যেমন বলা যেতে পারে সিঙ্গাপুরের কথা। ১৯৭৩ সালে সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশটি সফর করেছিলেন। এরপর ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর থেকে দেশ দুটির মাঝে উচ্চ পর্যায়ে তেমন একটা সফর বিনিময় হয়নি। তবে বেগম জিয়া ২০০৫ সালে সিঙ্গাপুর সফর করেছিলেন। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটা গুরুত্ব আছে। সিঙ্গাপুর কর্তৃক প্রস্তাবিত আমেড-৮ এ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী এশিয়া মিডিল ইস্ট ডায়লগ-৮ (আমেড-৮)-এর প্রস্তাব করেছিলেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, মিসর, জর্ডান, কুয়েত এবং বাহরাইনের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত এ ফোরামের লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় এবং পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য একে অপরকে সাহায্য করা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের তালিকায় আমেড ৮-এর গুরুত্ব অনেক। প্রসঙ্গক্রমেই বৈশ্বিক সন্ত্রাস দমনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে বাংলাদেশের যোগদানের প্রসঙ্গটিও আলোচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ মূলত এ জোটটিকে দেখছে সন্ত্রাস দমনের একটি কেন্দ্র হিসেবে এবং দেখতে হবে আগামী দিনগুলোতে এ জোটটি কীভাবে বিকশিত হয়। বাংলাদেশ কোনো সামরিক কার্যক্রম, অর্থাৎ কোনো যুদ্ধে অংশ নেবে না, সেটাই প্রত্যাশিত।
..
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের যে তালিকা, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কিছুটা ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া থেকে ৮ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় কিংবা রাশিয়া কর্তৃক একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি নতুন দিক, যাকে কিনা বলা হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়কার পররাষ্ট্রনীতিরই প্রতিফলন। একুশ শতকে অর্থনৈতিক কূটনীতি যেখানে সারা বিশ্বে অগ্রাধিকার পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের সাফল্য খুব আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশ এখনও তৈরি পোশাক রফতানির ওপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির আলোকে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এটি এখন নিয়ে যাওয়া হয়েছে পটুয়াখালীর পায়রাবন্দরে। এতে করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না। আমাদের পণ্যের রফতানি, একই সঙ্গে আমদানির পরিমাণও বেড়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আমদানি হয়। তাতে সময় নষ্ট হয় প্রচুর। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলে ২০ লাখ টিইউইউএস (কন্টেইনার টার্মিনাল) ধারণ করতে পারত। আর সাধারণ কার্গোর (খোলা পণ্য) ধারণ ক্ষমতা হতো ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন বছরে। এর প্রয়োজন ছিল। আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি থাকা উচিত ছিল। চীন প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এটি তৈরি করে দিতে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু ভারত নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়েছিল। ফলে এটি পায়রাবন্দরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বিশ্বের এক নম্বর। আমরা তাদের সক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারলাম না।
..
বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত ও চীনকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়। ভারত পার্শ্ববর্তী দেশ থাকায়, খুব স্বাভাবিক কারণেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গুরুত্ব বেশি। তবে নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককেও বাংলাদেশ গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক বেশি। এ দুটি দেশের মধ্যকার কূটননৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পার হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে মাত্র ৪০ বছর দিয়ে এ সম্পর্ককে বিচার করা যাবে না। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ভিত্তি রয়েছে এ দুটি দেশের মাঝে।
..
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত গত ২৯ জুন (২০১৫) স্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চায়। সে বছর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছর পূর্তি হবে। বাংলাদেশের স্বপ্ন ২০৫০ সালে ধনী দেশে পরিণত হওয়া। এসব স্বপ্ন পূরণে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিং ছিয়ায়ের বক্তব্যের মধ্যেই ফুটে উঠেছে আসল কথাটি। এটাই হচ্ছে মূল কথা। আমাদের উন্নয়নে, দরিদ্রতা দূরীকরণে, আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আর শক্তিশালী করতে হলে চীনের সাহায্য প্রয়োজন রয়েছে।
..
আঞ্চলিক সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু চীনের মতো উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিকে বাদ দিয়ে যদি শুধু উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে আমরা গুরুত্ব দিই, তাহলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না। তাই একুশ শতকের শুরুতে দাঁড়িয়ে আমাদের অগ্রাধিকারগুলোকে চিহ্নিত কতে হবে। এবং পররাষ্ট্রনীতি সেভাবেই প্রণয়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে কোনো একটি বিশেষ দেশের ওপর নির্ভরতা যদি বেড়ে যায়, তাহলে তা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বড় অবদান রাখতে পারবে না। উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা আমরা চিহ্নিত করেছি।
ওয়ান-ইলেভেনে আমাদের অবস্থান এবং ২০৫০ সালে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন তাতে পৌঁছতে হলে এখনই পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারগুলো চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক-আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
, সূত্র : অনলাইন পত্রিকা
আরো পড়ুন: