নরেন্দ্র মোদির প্রথম বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

নরেন্দ্র মোদির প্রথম বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে আসছেন ৬ই জুন। গত এক বছরে তাঁর সরকারের শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কোন দিকে গড়িয়েছে? বাংলাদেশের রাজনীতিক এবং বিশ্লেষকরা কিভাবে দেখছেন দুদেশের সম্পর্ককে? মীর সাব্বিরের বিশেষ প্রতিবেদন:

নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকেই পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি বারবার গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন।

কাঠমান্ডুতে সর্বশেষ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনেও মি. মোদী উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার কথা।

তবে মি. মোদীর এক বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের সাথে স্থল-সীমান্ত চুক্তি ভারতের লোকসভা এবং রাজ্যসভায় অনুমোদিত হওয়াটা বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

“”৬৮ বছর পর রাষ্ট্রবিহীন মানুষগুলো রাষ্ট্রের ঠিকানা পেয়েছে। এছাড়াও দুই দেশের মধ্যে ট্রেন-বাসের সার্ভিস বেড়েছে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি বলবো গত এক বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সফলতম বছর।”” বলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

তবে এই এক বছরে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ককে দেখা হচ্ছে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।

স্থল-সীমান্ত চুক্তির বাধা দুর হলেও তিস্তার পানিবন্টন চুক্তিসহ বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ বলছেন, মি. মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পরও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির আশানুরূপ পরিবর্তন হয়নি।

“আমরা আশা করেছিলাম জনাব মোদী ক্ষমতাগ্রহণের পর দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক আরো বন্ধুত্বপূর্ণ হবে। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, ভারতের আরেকটি নীতিনির্ধারক মহল, ব্যুরোক্র্যটদের চিন্তা-চেতনায় আমরা পরিবর্তন দেখছি না। যার ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার সাথে আমলাতান্ত্রিক পুরনো ধারার সমন্বয় হয়নি।”” বলেন মি. শাহ।

এর একটি উদাহরণ হিসেবে অভিন্ন নদীর পানিবন্টনের সুরাহা না হওয়ার বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন।
সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন দুটি রুটে বাস সার্ভিস চালু হয়েছে

রাজনৈতিক বিশ্লেষক তারেক শামসুর রহমান বলেন, গত এক দশকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তিস্তা নদীর পানিবন্টনের সমাধান না হওয়া এবং বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতার মতো সমস্যা এখনো রয়ে গেছে।

“বাংলাদেশের সমস্যা মূলত দুটো, জ্বালানী সংকট এবং পানি সংকট। এই দুটো ক্ষেত্রেই ভারত তাদের পররাষ্ট্র নীতির অংশ হিসেবে দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে এসব সমস্যার সমাধান করতে চায়। কিন্তু আমরা বলছি, এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। কিন্তু আঞ্চলিক ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের বিষয়টি ভারত এখনো ইতিবাচকভাবে দেখেনি।””

সংযোগ বা কানেক্টিভিটি

বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে গত এক বছরে স্থলপথে যোগাযোগ বেড়েছে। সম্প্রতি আগরতলা-ঢাকা-কলকাতার মাঝে পরীক্ষামূলকভাবে বাস সার্ভিসও চালু হয়েছে।

তবে এই সংযোগের বিষয়টি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বারবার শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও।

বিএনপি নেতা হান্নান শাহ বলছেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের রাজ্যগুলোর সংযোগের ফলে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়।

“”ট্রানজিটের সুযোগের মাধ্যমে ভারত ত্রিপুরাতে খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর জন্য তারা এখনো কোন মাশুল দিচ্ছে না। অন্যান্য সুবিধা দেয়ারও কথাবার্তা চলছে এবং মনে হয় মি. মোদী আসলে বাংলাদেশ আরো কিছু চুক্তি করতে যাচ্ছে। “” তিনি বলেন।

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান বলেন, কানেক্টিভিটির মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কতটা উপকৃত হচ্ছে বা ভবিষ্যতে হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলছেন, দুই দেশের মধ্যে কানেক্টেভিটি বা সংযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে।

“”বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে এই রাজ্যগুলোর সংযোগ হলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই লাভবান হবেন এবং এই নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। এছাড়াও রয়েছে সাংস্কৃতিক এবং পর্যটনের সম্পর্ক। আমরা আশা করছি ২০১৫ সালের মধ্যে নেপাল এবং ভুটানেও বাস সার্ভিস চালু করতে পারবো। এভাবেই এই অঞ্চলের চারটি দেশ একই প্লাটফর্মে চলে আসবে।””

নিরাপত্তা সহযোগিতা

অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান এবং কানেক্টিভিটির বাইরেও দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বেড়েছে নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও।
সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হবার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে

বাংলাদেশ সরকার বলছে, দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ায় সন্ত্রাসদমনে আরো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আব্দুর রব খান বলছেন, ভারতের নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিরাপত্তাক্ষেত্রে নতুন কোন পরিবর্তন দেখা না গেলেও, ২০১০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে এবিষয়ে যে যোগাযোগ বেড়েছে তা মোদী সরকারের আমলেও অব্যাহত আছে।

তিনি বলেন, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ইতিবাচক। তবে এখানে বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশ যতটা ভূমিকা রেখেছে, সেখানে বাংলাদেশ এই সহযোগিতা থেকে কতটা উপকৃত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

“”সহযোগিতার ক্ষেত্রে যদি ভারসাম্য না থাকে তবে সেটি টেকসই হবে না। আমার মনে হয় নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রেও একটি ভারসাম্যহীনতা থেকে যাচ্ছে। ফলে শেষ ফলাফল হবে, ভারত বেশি লাভবান হচ্ছে এবং বাংলাদেশ কম লাভবান হচ্ছে।”” বলেন ড. খান।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলছেন, দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমে সীমান্তে জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ ব্যপক সাফল্য পেয়েছে।

সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ এখনো আছে। সম্প্রতি এধরণের কয়েকটি ঘটনার খবরও বাংলাদেশী গণমাধ্যমে এসেছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছেন, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা কমে এসেছে, তবে সেটি শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে তারা ভারতীয় সরকারের কাছে বিষয়টি আবারো উথ্থাপন করবেন।

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সমতা এবং অস্পষ্টতা

ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকার স্পষ্টভাবে মানুষকে জানাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে বিএনপির।

“”প্রতিবেশী দেশের সাথে চুক্তি হোক সেটা আমরাও চাই। কিন্তু আমরা চাই চুক্তি হবে সমতার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে চুক্তি করলে মানুষ সেটা মেনে নেবে না।”” বলেন বিএনপি নেতা হান্নান শাহ।
৬ই জুন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

তবে বিএনপির অভিযোগ নাকচ করে দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

“”আমরা প্রথমে সেটাই করি যেটি বাংলাদেশের জন্য যেটা লাভজনক এবং এরপর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লাভজনক।”” বলেন মি. আলম।

অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং এসংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। যার একটি মূল কারণ হিসেবে তিনি দেখেন, সংসদ যথেষ্ট কার্যকর না থাকা।

“”সংসদ এখানে কার্যকর না থাকার ফলে আমাদের সাথে কি চুক্তি হচ্ছে এবং আমরা কি পাচ্ছি বা দিচ্ছি তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হচ্ছে না, এটি একটি অস্পষ্টতা। অপরদিকে ভারত বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে কিনা তা নিয়ে আমি সন্দিহান। ভারতের আমলাতন্ত্র অনেক শক্তিশালী এবং এর আগেও দেখা গেছে তারা বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না।””

সমমর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী করতে হবে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক রহমান।

নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতাগ্রহণের পর দক্ষিন এশিয়া অঞ্চলে যোগাযোগ বৃদ্ধির যে নীতির কথা তুলে ধরেছেন, তাতে বাংলাদেশ যে ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তা বেশ স্পষ্ট।

গত এক বছরে বাংলাদেশের সাথে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে বড় ধরণের পরিবর্তন দেখা না গেলেও, আগামী দিনগুলোতে সেই সম্পর্ক অমীমাংসিত ইস্যু সমাধানে কতটা কাজে দেবে সেদিকেই বাংলাদেশের নজর থাকবে।

আরো পড়ুন:

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, গুরুত্তপূর্ণ তথ্য

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিক, পত্রিকার কলাম

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে ,. প্রথম আলো, ২.৩.১৬।

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline