৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি
. আন্তর্জাতিক : সিরিয়ান ক্রাইসিস আসতে পারে। গুরুত্বদিন । নিচের লেখা থেকে জানতে পারবেন কিভাবে সিরীয় যুদ্ধের অবসান হতে পারে।
.
ভূরাজনীতি
সিরীয় যুদ্ধের অবসান চাইলে
জেফরিডিস্যাকস | ০২ মার্চ, ২০১৬
বর্তমানে সিরিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্র, ভূরাজনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে উত্তপ্ত ভূমি। সিরিয়ার মানুষ এক রক্তের হোলি খেলার মধ্যে আটকা পড়েছে, যেখানে প্রায় চার লাখ মানুষ মারা গেছে, আর এক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সহিংস জিহাদি গোষ্ঠীগুলো নির্দয়ভাবে দেশটাকে ছারখার করে দিচ্ছে, মানুষ মারছে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে যতগুলো পক্ষ জড়িত আছে, তারা সবাই গুরুতর যুদ্ধাপরাধ করেছে, আর এখনো তা করে যাচ্ছে, যার মধ্যে আছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার, বাশারবিরোধী গোষ্ঠী—যাদের সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এবং ইসলামিক স্টেট। এখন সমাধানের সময় এসেছে। কিন্তু এই সমাধান করতে হবে স্বচ্ছ ও বাস্তবভিত্তিক উপায়ে এই যুদ্ধ লাগার কারণ অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে।
এই যুদ্ধের কালানুক্রমটা এ রকম: ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল হয়, সেই সময় পুরো আরবজুড়েই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছিল, যাকে ‘আরব বসন্ত’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় বাশারের সরকার একদিকে প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলে পড়ে, অন্যদিকে আবার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। ফলে শিগগিরই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বাশারের বিরোধীরা অভিযোগ করল, বাশার সরকার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর লাগামহীনভাবে বল প্রয়োগ করেছে, যদিও বাশারের সরকার পুলিশ ও সেনাদের মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করে বলেছে, প্রতিবাদকারীদের মধ্যে সহিংস জিহাদিরা রয়েছে।
সম্ভবত এটা হতে পারে যে ২০১১ সালের মার্চ বা এপ্রিল মাস নাগাদ সরকারবিরোধী সুন্নি যোদ্ধারা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য হচ্ছে, বিদেশি জিহাদিরা দেশটির পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে মারাত্মক সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছিল (এটার সত্যতা নিশ্চিত করা কঠিন, বিশেষ করে আজ পাঁচ বছর পরে)।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মধ্যপ্রাচ্যের মিত্ররা ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চেয়েছিল। তারা মনে করেছিল, মিসরের হোসনি মোবারক ও তিউনিসিয়ার বেন আলীর মতো তিনিও চাপের মুখে নতি স্বীকার করবেন। অনেক পর্যবেক্ষকই জোর দিয়ে বলেছেন, কাতার সিরিয়ার অভ্যন্তরে সরকারবিরোধী তৎপরতা বাড়ানোয় মদদ দিয়েছে, আর দোহাভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম আল-জাজিরাকে ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে বাশারবিরোধী মনোভাব উসকে দিয়েছে, যদিও এই দাবির সত্যতা নিরূপণ করা কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্র বাশার সরকারের ওপর বাণিজ্য ও আর্থিক অবরোধ আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়ন-বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন বাশারকে হটানোর ডাক দিয়েছে, ফলে মার্কিন গণমাধ্যমে বাশারবিরোধী প্রচারণা বাড়তে থাকে (তখন পর্যন্ত মার্কিন গণমাধ্যম বাশারকে আপেক্ষিকভাবে সহৃদয় ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করত, যদিও তারা তাঁকে কিছুটা কর্তৃত্ববাদী মনে করত। এরপর ২০১১ সালের মার্চ মাস নাগাদ তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই বাশারকে সংস্কারক মনে করে)।
২০১১ সালের ১৮ আগস্ট যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বললেন, ‘বাশারকে অবশ্যই যেতে হবে’, সেদিন থেকেই আসলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তখন পর্যন্ত সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল, বেসামরিক মানুষসহ মৃতের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার ৯০০ (বাশারের বিরোধীদের তথ্যানুসারে)। আগস্টের পর সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। এটা অনেক সময় দাবি করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র তখন পর্যন্ত ঢিলেঢালাভাবেই কাজ করছিল। ওবামার রাজনৈতিক শত্রুরা সাধারণভাবে তাঁকে আক্রমণ করত এই বলে যে তিনি তেমন কিছু করছেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাশারকে সরানোর চেষ্টা করেছে, যদিও তারা সেটা করেছে গোপনে ও মিত্রদের মাধ্যমে, মূলত সৌদি আরব ও তুরস্কের মাধ্যমে। সৌদি আরব ও সিআইএ গোপন সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করত।
তবে এ কথা অবশ্যই বলতে হবে, যুদ্ধের কালানুক্রম দেখে এটা বোঝার উপায় নেই। তার জন্য আমাদের গুরুত্বপূর্ণ খেলুড়েদের প্রণোদনা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমত ও প্রধানত সিরিয়ার চলমান এই যুদ্ধ প্রক্সি যুদ্ধ, যে যুদ্ধের পক্ষগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরান। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র সৌদি আরব, তুরস্ক বাশারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য ২০১১ সালে এই যুদ্ধ শুরু করে। মার্কিন জোট আবার রাশিয়া ও ইরানের ক্রমবর্ধমান পাল্টা হামলার শিকার হয়, ইরানের লেবানিন প্রক্সি হিজবুল্লাহ বাশার সরকারের হয়ে যুদ্ধ করছে।
বাশার সরকারের ইরানি ও রুশ-নির্ভরতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র তাকে সরাতে চেয়েছিল। মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন, বাশারকে সরিয়ে দিলে ইরান ও হিজবুল্লাহ দুর্বল হবে, আর রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক সম্প্রসারণও থমকে যাবে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র তুরস্ক, সৌদি আরব ও কাতার বাশারের আলাওয়াইট সরকারকে হটিয়ে সিরিয়ায় সুন্নি সরকারকে বসাতে চায় (আলাওয়াইটরা শিয়া মুসলমানদের একটি শাখা)। আরও সাধারণভাবে বললে, তারা বিশ্বাস করে, এতে ইরান দুর্বল হবে, আর মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াদের প্রভাব কমবে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল, বাশারকে সহজেই হটানো যাবে, আর তা করতে গিয়ে নিজেদের প্রচারণাই বিশ্বাস করে বসেছিল, যদিও তারা এটা প্রথমবার করল তা নয়। বাশার সরকারকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যদিও তার অভ্যন্তরীণ সমর্থন কম ছিল না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাশার সরকারের ইরান ও রাশিয়ার মতো শক্তিশালী মিত্র ছিল। তারা কেউই সাড়া দেবে না, এটা ভাবা ছিল বোকামির শামিল।
সিআইএ নেতৃত্বাধীন যুদ্ধের নোংরা চরিত্রকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সিরিয়ায় প্রচুর জিহাদি ঢুকিয়েছে, ঠিক যেমন ১৯৮০-এর দশকে তারা আফগানিস্তানে সুন্নি জিহাদি ঢুকিয়েছিল, যাদের বলা হতো মুজাহিদীন, যারা আবার পরবর্তীকালে আল-কায়েদায় পরিণত হয়। সৌদি আরব, তুরস্ক, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে সহিংস জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর পালে হাওয়া দিয়েছে, কিন্তু তারা এটা করতে গিয়ে ভুল হিসাব করে ফেলেছে। তারা মনে করেছিল, এসব প্রক্সির মাধ্যমে নোংরা স্বার্থ উদ্ধার করতে পারবে, এরপর তাদের আবার অগ্রাহ্য করতে পারবে, পুরো কাজটা তারা মূলত অসূয়া থেকে করেছে।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার গণমাধ্যম সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনাটিকে প্রতারণা ও সম্প্রসারণবাদী হিসেবে মনে করে। কিন্তু সত্যটা ভিন্ন। জাতিসংঘের সনদ অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র জোট গঠন করতে পারে না, ভাড়াটেদের টাকা দিতে পারে, একই সঙ্গে আরেকটি দেশের সরকার উৎখাত করার জন্য ভারী অস্ত্র চোরাচালান করতে পারে না। সিরিয়ার বেলায় রাশিয়া আসলে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, নিজে থেকে কিছু করছে না। তারা নিজেদের মিত্রদের বিরুদ্ধে মার্কিন উসকানির জবাব দিচ্ছে।
যুদ্ধ শেষ করতে হলে ছয়টি নীতি মেনে চলতে হবে। প্রথমত, সিরিয়ার সরকার উৎখাত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রকাশ্য ও গোপন সহায়তা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচিত হবে, যুদ্ধবিরতি নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা বাস্তবায়ন করা। তার উচিত হবে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, কাতার ও ইরানসহ সব দেশকে আহ্বান জানানো, যাতে তারা সিরিয়ার মধ্যে কোনো সামরিক শক্তিকে অস্ত্র ও টাকাপয়সা না দেয়।
তৃতীয়ত, সব আধা সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের কথিত মধ্যপন্থীদের কার্যক্রমসহ। চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে সিরিয়ার সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারে। পঞ্চমত, ধীরে ধীরে রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটাতে হবে, আর সব পক্ষের আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হলেই নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে, হুট করেই ‘স্বাধীন নির্বাচনের’ দাবি তুলে হুলুস্থুল লাগানো চলবে না।
শেষমেশ বলা যায়, দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপসাগরীয় রাষ্ট্র তুরস্ক ও ইরানকে মুখোমুখি বসিয়ে আঞ্চলিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়ন করাতে হবে। আরব, তুর্কি ও ইরানিরা হাজার হাজার বছর ধরে একত্রে বসবাস করছে। ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে তাদেরই নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে হবে, বাইরের শক্তিকে নয়।
. প্রথম আলো, ২.৩.১৬।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: প্রতীকবর্ধন
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।