ঢাকার অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুবান্ধব নয়

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি ব্লকে সড়কের ঠিক পাশেই সরকারি আইডিয়াল প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাঁচতলা বিদ্যালয় ভবনে শ্রেণীকক্ষ রয়েছে আটটি। ৩০০ শিক্ষার্থী থাকলেও খেলার মাঠ অনুপস্থিত। টিফিনের সময় ব্যস্ত সড়কের ওপরই খেলাধুলা করে শিক্ষার্থীরা। খেলতে গিয়ে একাধিকবার দুর্ঘটনার শিকারও হয়েছে তারা। শ্রেণীকক্ষের অবস্থাও ভালো নয়। চুনকাম, রঙ সবই নষ্ট হয়ে গেছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও তীব্র শব্দদূষণের মধ্যেই পাঠ নিতে হচ্ছে শিশুদের।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শবনম বানু বলেন, ১৯৭০ সালে স্থাপিত বিদ্যালয়টি সরকারি হয় ১৯৭৩ সালে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কিছুদিন আগে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা ও তীব্র শব্দদূষণের এটি তাদেরও নজরে এসেছে। দেখা যাক কী হয়।

১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদপুরের শের শাহ সুরি রোডের একটি গলিতে অবস্থিত নবযুগ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১৫০ জন। ২০১৩ সালে এলজিইডি বিদ্যালয়টি নতুনভাবে নির্মাণ করে। ২০১৬ সালে একবার সংস্কারও করেছে। অল্প দিনের মধ্যেই আবার নষ্ট হয়ে গেছে। শিশুদের খেলার মাঠও নেই বিদ্যালয়টিতে।

মোহাম্মদপুরের এ দুই বিদ্যালয়ের মতোই অবস্থা রাজধানীর সিংহভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ঢাকা মহানগরীর ৪৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৪৩টি অর্থাত্ প্রায় ৭০ শতাংশই এ ধরনের সমস্যা নিয়ে চলছে বলে জানায় এলজিইডি সূত্রগুলো। বিদ্যালয়গুলো শিশুবান্ধব করতে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্প নিচ্ছে সংস্থাটি। এর আওতায় নতুনভাবে সাজানো হবে বিদ্যালয়গুলোকে, যেন সব ধরনের পরিবারের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আকৃষ্ট হয়।

জানা গেছে, এটি নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্প্রতি আলোচনা করেছে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শুধু ঢাকার ৩৪৩ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুনর্বাসন ও সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে যাচ্ছে এলজিইডি।

এলজিইডি সূত্রমতে, সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এ প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনে পরিবর্তন আনা হবে ভবনের নকশায়। বিদ্যালয় এমনভাবে স্থাপন হবে যাতে শিশুদের খেলাধুলার জন্য যথেষ্ট জায়গা থাকে। পরিবর্তন আনা হবে শ্রেণীকক্ষের রঙেও। পাঠ্যবইয়ের লেখার সঙ্গে মিল রেখে শ্রেণীকক্ষের ভেতরের দেয়ালেও থাকবে চিত্র। শ্রেণীকক্ষে দেয়া হবে দৃষ্টিনন্দন চেয়ার-টেবিল।

এলজিইডি বলছে, ঢাকার বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হলে এ ধরনের অন্তত ১৫টি শিক্ষালয় অবৈধ দখলমুক্ত হবে।

জানতে চাইলে এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (শিক্ষা) এ কে আজাদ বলেন, ঢাকার ৩৪৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে শিশুবান্ধব করে গড়ে তুলতে আমরা একটি আলাদা প্রকল্প নেব। শুধু নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো নয়, সব ধরনের পরিবারের সন্তানরাই যাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সেভাবে গড়ে তোলা হবে এগুলো।

শিক্ষকরা জানান, বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা ব্যয়বহুল ইংলিশ মিডিয়াম অথবা বেসরকারি বিদ্যালয়ে পাঠ নিচ্ছে। একই পন্থা বেছে নিচ্ছে মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারও। রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা নিচ্ছে মূলত দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা। বিদ্যালয়গুলো শিশুবান্ধব না হওয়া এর অন্যতম কারণ।

ঢাকার জয়কালী মন্দিরের দিক থেকে কাপ্তান বাজারের প্রবেশপথেই চারতলা খোদাবক্স সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রংচটা ভবনটি অবস্থিত। এক সময় শত শত শিক্ষার্থীর পদভারে মুখর থাকত শিক্ষাঙ্গনটি। বর্তমানে ভবন থাকলেও নেই শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে সিটি ছাগল ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাইনবোর্ড টানানো। মূল ভবন বাদে বাকি সব দখলে নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। স্থানীয়রা জানান, দখলদারিত্বের মুখে টিকতে না পেরে বিদ্যালয়টি প্রথমে পরিত্যক্ত, এরপর বন্ধ হয়ে যায়।

পুরান ঢাকার প্যারীদাস রোডের বাংলাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও নেই পাঠদানের মতো পর্যাপ্ত জায়গা। শৌচাগার তো নেই-ই, রাখা হয়নি খাবার পানির ব্যবস্থাও।

রাজধানীর নাজিরাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ও বিদ্যুত্ সংযোগ নেই। বিদ্যালয়ের সামনের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা। বিদ্যালয়ের নেই নিজস্ব ভবন ও জমি। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীসংখ্যা ৩৩৬ জন।

কোতোয়ালির জিন্দাবাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ের নেই পাকা ভবন ও খেলার মাঠ। টিনশেডের আধাপাকা একটা বাড়ির ছোট ছোট তিনটি কক্ষে গাদাগাদি করে পাঠদান চলে। বৃষ্টি হলে কক্ষ ভিজে যায়। শ্রেণীকক্ষ সংকটের কারণে গাদাগাদি করে বসতে হয়। এজন্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে।

সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি এলাকার কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা আরো বেহাল। রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি জরাজীর্ণ। এর পাশে দুই কক্ষবিশিষ্ট পিডিবির একটি নতুন ভবনে একই সঙ্গে পাঠদান ও দাপ্তরিক কাজ চলে। মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বাজারসংলগ্ন বলে এর সামনে প্রায় সব সময় ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডেমরার সারুলিয়া, কামারগোপ, কোতোয়ালির মাহুতটুলী রেনেসাঁ, ছোট কাটরা, হযরত নগর ও চম্পাতলী, গোয়ালঘাট, লালচাঁন ও পাড়া ডগাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার সার্বিক পরিবেশও নাজুক।

বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ঢাকা মহানগরীর সচিব আমিনুল ইসলাম বলেন, ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রধান সমস্যা এগুলোর অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যস্ত সড়কের পাশে। খেলার মাঠও নেই। এমনকি শ্রেণীকক্ষগুলোও স্বাস্থ্যকর নয়। চুনকাম, সিমেন্ট খসে পড়ছে।

 

 

আরো পড়ুন:

প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া বইয়ে ভুলে ভরা

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণীর প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় সরকারের কোন দায় নেই

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline