১১. যে সকল ব্যঞ্জনসন্ধি কোনো নিয়ম না মেনে, বরং নিয়মের ব্যতিক্রম করে সন্ধি হয়, তাদেরকে নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি বলে। যেমন, ‘পতৎ+অঞ্জলি’, এখানে অঘোষ অল্পপ্রাণ ধ্বনি ‘ত’ এর সঙ্গে স্বরধ্বনি ‘অ’ এর সন্ধি হয়েছে। সুতরাং, সন্ধির নিয়ম অনুসারে ‘ত’ এর জায়গায় ‘দ’ হওয়ার কথা। তার বদলে একটি ‘ত’ লোপ পেয়ে হয়েছে ‘পতঞ্জলি’। এরকম-
নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি
আ+চর্য = আশ্চর্য
গো+পদ = গোষ্পদ
বন+পতি = বনস্পতি
বৃহৎ+পতি = বৃহস্পতি
তৎ+কর = তস্কর
পর+পর = পরস্পর
ষট+দশ = ষোড়শ
এক+দশ = একাদশ
পতৎ+অঞ্জলি = পতঞ্জলি
মনস+ঈষা = মনীষা
মনে রাখার জন্য : আশ্চর্য, গোষ্পদ বনস্পতি, বৃহস্পতি তস্কর, পরস্পর ষোড়শ, একাদশ পতঞ্জলি, মনীষা
বিসর্গ সন্ধি
যে দুইটি ধ্বনির মিলনে সন্ধি হবে, তাদের একটি যদি বিসর্গ হয়, তবে তাকে বিসর্গ সন্ধি বলে। বিসর্গ সন্ধি ২ ভাবে সম্পাদিত হয়-
১. বিসর্গ + স্বরধ্বনি
২. বিসর্গ + ব্যঞ্জনধ্বনি
[বিসর্গসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধির সম্পর্ক : সংস্কৃত নিয়ম অনুযায়ী শব্দ বা পদের শেষে ‘র্’ বা ‘স্’ থাকলে তাদের বদলে ‘ঃ’ বা অঘোষ ‘হ’ উচ্চারিত হয়। এর উপর ভিত্তি করে বিসর্গকে ২ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
র-জাত বিসর্গ : ‘র্’ ধ্বনির জায়গায় যে বিসর্গ হয়, তাকে র-জাত বিসর্গ বলে। যেমন : অন্তর- অন্তঃ, প্রাতর- প্রাতঃ, পুনর- পুনঃ, ইত্যাদি।
স-জাত বিসর্গ : ‘স্’ ধ্বনির জায়গায় যে বিসর্গ হয়, তাকে স-জাত বিসর্গ বলে। যেমন : নমস- নমঃ, পুরস- পুরঃ, শিরস- শিরঃ, ইত্যাদি।
মূলত, ‘ঃ’ হলো ‘র্’ ও ‘স্’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
এই র-জাত বিসর্গ ও স-জাত বিসর্গ উভয়েই মূলত ব্যঞ্জনধ্বনিরই অন্তর্গত। এই কারণে অনেকে বিসর্গ সন্ধিকেও ব্যঞ্জনসন্ধিরই অন্তর্গত বলে মনে করে।]
বিসর্গ+স্বরধ্বনি
‘অ’ স্বরধ্বনির পরে’ থাকলে এবং তারপরে আবার ‘অ’ থাকলে অ+ঃ+অ = ‘ও’ হয়। যেমন- ততঃ+অধিক = ততোধিক
বিসর্গ+ব্যঞ্জনধ্বনি
১. (ক) ‘অ’-এর পরে স-জাত ‘ঃ’, এবং তারপরে ঘোষ ধ্বনি, নাসিক্য ধ্বনি, অন্তস্থ ধ্বনি কিংবা হ থাকলে, ‘ঃ’-র জায়গায় ‘ও’ হয়।
অর্থাৎ, ‘অ’-এর পরে স-জাত ‘ঃ’, এবং তারপরে গ, জ, ড, দ, ব কিংবা ঘ, ঝ, ঢ, ধ, ভ কিংবা ঙ, ঞ, ণ, ন, ম কিংবা য, র, ল, ব অথবা হ থাকলে আগের অ+ঃ=‘ও’ হয়।
অর্থাৎ, ‘অ’-এর পরে স-জাত ‘ঃ’, এবং তারপরে বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম ধ্বনি থাকলে কিংবা য, র, ল, ব, হ থাকলে আগের অ+ঃ=‘ও’ হয়। যেমন-
তিরঃ+ধান = তিরোধান (অ+ঃ+ধ)
মনঃ+রম = মনোরম (অ+ঃ+র)
তপঃ+বন = তপোবন (অ+ঃ+ব)
মনঃ+হর = মনোহর (অ+ঃ+হ)
(খ) ‘অ’-এর পরে র-জাত ‘ঃ’ থাকলে, এবং তারপরে স্বরধ্বনি কিংবা ঐ একই ধ্বনিগুলো থাকলে (ঘোষ ধ্বনি, নাসিক্য ধ্বনি, অন্তস্থ ধ্বনি ও হ), ‘ঃ’-র জায়গায় ‘র’ হয়। যেমন-
অন্তঃ+গত = অন্তর্গত (অ+ঃ+গ)
পুনঃ+আয় = পুনরায় (অ+ঃ+আ)
অন্তঃ+ধান = অন্তর্ধান (অ+ঃ+ধ)
পুনঃ+উক্ত = পুনরুক্ত (অ+ঃ+উ)
অন্তঃ+ভুক্ত = অন্তর্ভুক্ত (অ+ঃ+ভ)
পুনঃ+জন্ম = পুনর্জন্ম (অ+ঃ+জ)
অন্তঃ+বর্তী = অন্তর্বর্তী (অ+ঃ+ব)
পুনঃ+বার = পুনর্বার (অ+ঃ+ব)
অহঃ+অহ = অহরহ (অ+ঃ+অ)
পুনঃ+অপি = পুনরপি (অ+ঃ+অ)
প্রাতঃ+উত্থান = প্রাতরুত্থান (অ+ঃ+উ)
২. ‘অ/আ’ ছাড়া অন্য স্বরধ্বনির পরে ‘ঃ’ থাকলে এবং তারপরে অ, আ, ঘোষ ধ্বনি, নাসিক্য ধ্বনি, অন্তস্থ ধ্বনি কিংবা হ থাকলে ‘ঃ’-র জায়গায় ‘র’ হয়।
অর্থাৎ, ‘অ/আ’ ছাড়া অন্য স্বরধ্বনির পরে ‘ঃ’ থাকলে এবং তারপরে অ, আ কিংবা, গ, জ, ড, দ, ব কিংবা ঘ, ঝ, ঢ, ধ, ভ কিংবা ঙ, ঞ, ণ, ন, ম কিংবা য, র, ল, ব কিংবা হ থাকলে ‘ঃ’-র জায়গায় ‘র’ হয়।
অর্থাৎ, ‘অ/আ’ ছাড়া অন্য স্বরধ্বনির পরে ‘ঃ’ থাকলে এবং তারপরে অ, আ, বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ধ্বনি কিংবা য, র, ল, ব কিংবা হ থাকলে ‘ঃ’-র জায়গায় ‘র’ হয়। যেমন-
নিঃ+আকার = নিরাকার (ই+ঃ+আ)
দুঃ+যোগ = দুর্যোগ (উ+ঃ+য)
নিঃ+আকরণ = নিরাকরণ (ই+ঃ+আ)
দুঃ+লোভ = দুর্লোভ (উ+ঃ+ল)
নিঃ+জন = নির্জন (ই+ঃ+জ)
দুঃ+অন্ত = দুরন্ত (উ+ঃ+অ)
আশীঃ+বাদ = আশীর্বাদ (ঈ+ঃ+ব)
প্রাদুঃ+ভাব = প্রাদুর্ভাব (উ+ঃ+ভ)
জ্যোতিঃ+ময় = জ্যোতির্ময় (ই+ঃ+ম)
বহিঃ+গত = বহির্গত (ই+ঃ+গ)
ব্যতিক্রম : ‘ই/উ+ঃ+র’ হলে ‘ঃ’ লোপ পায় এবং ‘ঃ’-র আগের হ্রস্ব স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়। যেমন- ‘নিঃ+রব’, এখানে ‘ন+ই+ঃ’-এর ‘ই+ঃ’-এর পরে ‘র’ ধ্বনির সন্ধি হয়েছে। সুতরাং এখানে ‘ঃ’ লোপ পাবে এবং ‘ই’-র জায়গায় ‘ঈ’ হবে। অর্থাৎ সন্ধি হয়ে হবে ‘নিঃ+রব = নীরব’। এরকম- নিঃ+রস = নীরস।
৩. বিসর্গের পরে তালব্য অঘোষ ধ্বনি (চ, ছ) থাকলে বিসর্গের জায়গায় তালব্য শিশ (শ) ধ্বনি,
বিসর্গের পরে মূর্ধণ্য অঘোষ ধ্বনি (ট, ঠ) থাকলে বিসর্গের জায়গায় মূর্ধণ্য শিশ (ষ) ধ্বনি,
বিসর্গের পরে দন্ত্য অঘোষ ধ্বনি (ত, থ) থাকলে বিসর্গের জায়গায় দন্ত্য শিশ (স) ধ্বনি হয়।
অর্থাৎ,
‘ঃ’-এর পরে ‘চ/ছ’ (তালব্য) থাকলে ‘ঃ’-এর জায়গায় ‘শ’
’-এর পরে ‘ট/ঠ’ (মূর্ধণ্য) থাকলে ‘ঃ’-এর জায়গায় ‘ষ’
‘ঃ’-এর পরে ‘ত/থ’ (দন্ত্য) থাকলে ‘ঃ’-এর জায়গায় ‘স’ হয়। যেমন-ঃ
চ/ছ = শ+চ/ছ
নিঃ+চয় = নিশ্চয়
শিরঃ+ছেদ = শিরশ্ছেদঃ
+ট/ঠ = ষ+ট/ঠ
ধনুঃ+টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার
নিঃ+ঠুর = নিষ্ঠুরঃ
+ত/থ = স+ত/থ
দুঃ+তর = দুস্তর
দুঃ+থ = দুস্থ
৪. (ক) ‘অ/আ’ স্বরধ্বনির পরে ‘ঃ’ থাকলে এবং তারপরে অঘোষ কণ্ঠ্য বা ওষ্ঠ্য ধ্বনি (ক, খ, প, ফ) থাকলে ‘ঃ’-র জায়গায় অঘোষ দন্ত্য শিশ ধ্বনি (স) হয়।
অর্থাৎ, ‘অ/আ’-এর পরে ‘ঃ’ থাকলে এবং তারপরে ‘ক/খ/প/ফ’ থাকলে ‘ঃ’-র জায়গায় ‘স’ হয়।
(খ) ‘অ/আ’ ছাড়া অন্য কোন স্বরধ্বনির পরে ‘ঃ’ থাকলে এবং তারপরে অঘোষ কণ্ঠ্য বা ওষ্ঠ্য ধ্বনি (ক, খ, প, ফ) থাকলে ‘ঃ’-র জায়গায় অঘোষ মূর্ধণ্য শিশ ধ্বনি (ষ) হয়।
অর্থাৎ, ‘অ/আ’-এর পরে ‘ঃ’ থাকলে এবং তারপরে ‘ক/খ/প/ফ’ থাকলে ‘ঃ’-র জায়গায় ‘ষ’ হয়।
যেমন-
(ক) অ/আ+ঃ+ক/খ/প/ফ
(খ) ই/ঈ/উ/ঊ/এ/ঐ/ও/ঔ +ঃ+ক/খ/প/ফ
নমঃ+কার = নমস্কার
পদঃ+খলন = পদস্খলন
নিঃ+কার = নিষ্কর
দুঃ+কার = দুষ্কর
পুরঃ+কার = পুরস্কার
নিঃ+ফল = নিষ্ফল
দুঃ+প্রাপ্য = দুষ্প্রাপ্য
মনঃ+কামনা = মনস্কামনা
বাচঃ+পতি = বাচস্পতি
নিঃ+পাপ = নিষ্পাপ
দুঃ+কৃতি = দুষ্কৃতি
তিরঃ+কার = তিরস্কার
বহিঃ+কৃত = বহিষ্কৃত
চতুঃ+কোণ = চতুষ্কোণ
ভাঃ+কর = ভাস্কর
বহিঃ+কার = বহিষ্কার
চতুঃ+পদ = চতুষ্পদ
আবিঃ+কার = আবিষ্কার
৫. ‘ঃ’-র পরে স্ত, স্থ কিংবা স্প যুক্তব্যঞ্জনগুলো থাকলে পূর্ববর্তী ‘ঃ’ অবিকৃত থাকে কিংবা লোপ পায়। যেমন-
নিঃ+স্তব্ধ = নিঃস্তব্ধ/ নিস্তব্ধ
দুঃ+স্থ = দুঃস্থ/ দুস্থ
নিঃ+স্পন্দ = নিঃস্পন্দ/ নিস্পন্দ
৬. কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্ধির পরও ‘ঃ’ থেকে যায়। যেমন-
প্রাতঃ+কাল = প্রাতঃকাল
মনঃ+কষ্ট = মনঃকষ্ট
শিরঃ+পীড়া = শিরঃপীড়া
৭. কয়েকটি বিশেষ বিসর্গ সন্ধি (এগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু নিপাতনে সিদ্ধ বা বিশেষ নিয়মে সাধিত সন্ধি নয়। এগুলো কেবলই বিসর্গ সন্ধি)-
বিশেষ বিসর্গ সন্ধি
বাচঃ+পতি = বাচস্পতি
অহঃ+নিশা = অহর্নিশ
ভাঃ+কর = ভাস্কর
অহঃ+অহ = অহরহ
প্রতিটি লেকচারে নতুন নতুন লিখা যুক্ত হচ্ছে, তাই কাঙ্খিত কোন লিখা না পেলে দয়া করে কিছুদিন পর আবার ভিজিট করে দেখবেন।
লিখাতে কিংবা লেকচারে কোন ভুলত্রুটি থাকলে অথবা আপনার কাঙ্খিত লিখা খুঁজে না পেলেইশিখন.কম এর ফ্যানপেইজ অথবা নিচে কমেন্ট কর