বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি
আইএস:
::পরিচিতিঃ সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো আই এস আই এস (ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক এন্ড আল-সাম)-এর উত্থান পরবর্তী সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড এবং এরই প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা নতুন চ্যালেঞ্জ। বস্তুত এ সংগঠনটি খুবই অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে যে শক্তিমত্তার সাথে নাড়িয়ে দিয়েছে তা বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির চালকদের ভাবিয়ে তুলছে।জর্ডানের নাগরিক আবু মুসাব আল জারকাবি ২০০২ সালে তাওহিদ ওয়াল-জিহাদ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পরের বছর তিনি গঠন করেন আল-কায়েদা ইন ইরাক (একিউআই)। ২০০৬ সালে জারকাবির মৃত্যুর পর একিউআই ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক (আইএসআই) নামে একটি সমন্বিত সংগঠন গঠন করে। ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা থেকে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দি ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত (আইএসআইএল)। এই সংগঠনটির অন্য নাম ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস)। পরবর্তী সময়ে সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
::দখলকৃত এলাকাঃ এটি মূলত ইরাকের সুন্নি বিদ্রোহীদের সংগঠন। ২৯ জুন, ২০১৪ ইসলামিক ওয়েবসাইটে এবং টুইটারে প্রকাশিত এক বিবৃতির মাধ্যমে সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল অংশ দখল করে নেয় আইএস। নিজেদের দখলকৃত এলাকাকে তারা ইসলামী খেলাফত ঘোষণা এবং স্বীকৃতির জন্য মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানায়। ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননের অংশবিশেষ নিয়ে একটি অঞ্চলজুড়ে খিলাফত পদ্ধতির ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে আইএস।
::সংগঠনের প্রধানঃ ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রধান ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আলী আল-বদরি আল-সামারাই, তিনি আবু বাকার আল-বাগদাদি নামেই বেশি পরিচিত। আগে তিনি ড. ইব্রাহিম ও আবু দুইয়া নামে পরিচিত ছিলেন। ইরাকে ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযান শুরুর পরপরই জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত হন। তিনি বাগদাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে ইমামও নিযুক্ত হন। বর্তমানে তিনি খলিফা ইব্রাহিম নাম ধারণ করে ইরাকের পশ্চিমাঞ্চল ও সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণা করেন এবং দখলকৃত অঞ্চলে নিজস্ব মুদ্রা চালুসহ নিজেকে ওই রাষ্ট্রের খলিফা ঘোষণা করেন। আইএস প্রধান বাগদাদি ইতিমধ্যে ইসলামিক স্টেটের টাঁকশালের জন্য সোনা, রুপা ও তামার নতুন মুদ্রা প্রচলনের নির্দেশ দিয়েছেন। এই মুদ্রাগুলো ইসলামী দিনার নামে ইসলামিক স্টেটের নিজস্ব মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
::আদর্শ ও উদ্দ্যেশ্যঃ সালাফি ও ওয়াহবি ইসলামী তত্ত্বে বিশ্বাসী ইরাক ভিত্তিক এই সংগঠনটি আধুনিকতাকে বর্জন না করে বরং তা গ্রহণ ও ব্যবহার করে যথেষ্ট পরিমাণে সাফল্য পাচ্ছে। আদর্শগত দিক থেকে আই এসের উদ্দেশ্য হলো অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এরই প্রেক্ষিতে আই এস উত্তর ও পশ্চিম ইরাক এবং পূর্ব ও উত্তর সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো দখল করে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে পদ্ধতিগত জায়গা থেকে আই এসের উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমান উদারনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে শরীয়াহ আইনভিত্তিক রাজনৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করা।
::আইএসের উত্থানের কারণঃ আইএসের উত্থানের অন্যতম কারণ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। সেখানে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলনের গোড়াতে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনপুষ্টদের একাংশ এই নতুন সংগঠনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, যিনি সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে জর্জ বুশের প্রধান সঙ্গী ছিলেন, স্বীকার করেছেন ইরাকে সামরিক হামলার কারণেই ইসলামিক স্টেটের উদয় হয়েছে। কিন্তু মার্কিন টিভি নেটওয়ার্ক সিএনএনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইরাক যুদ্ধের জন্য তিনি কোনও রকম অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশ করেননি। ইরাক যুদ্ধের পক্ষে সংসদের সমর্থন আদায় করতে তিনি মনগড়া তথ্য দিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে মি ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ওই সাক্ষাৎকারে মি ব্লেয়ার বলেছেন, সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যারা জড়িত ছিলেন ইরাকের আজকের পরিস্থিতির জন্যে তাদেরও কিছু দায়ভার আছে। কারণ ‘যুদ্ধ শেষে পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে সে বিষয়ে তাদের বোঝার কিছু ভুল হয়েছিল’। ইরাক যুদ্ধের কারণে ইসলামিক স্টেইটের উত্থান ঘটেছে বলে যে ধারণা করা হয় তার মধ্যে কিছু সত্যতা আছে বলেও তিনি স্বীকার করেছেন।কিছু নিরাপত্তা তাত্ত্বিক মনে করছেন, ৯/১১ এবং আরব বসন্ত পরবর্তী অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য আই এসের উত্থান ও বিকাশকে এমনভাবে বেগবান করেছে যে রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসবাদী সংঘাতকে বিভক্ত করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রগুলো তাদের রাজনৈতিক স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে গত তিন দশকে এ সমস্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সাথে আঁতাত করেছে এবং এক পর্যায়ে এই সংগঠনগুলো তাদেরই শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কিছু পশ্চিমা বিরোধী রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন যে, পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবসাকে সমুন্নত রাখতে এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্যই আই এসের কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে খোদ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ত্রাণকর্তারাই। বিতর্ক যে দিকে মোড় নিক না কেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আজ যে চরম চ্যালেঞ্জের মুখে সে বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। সম্প্রতি ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার (আই এস ডাব্লিউ)-এর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আই এস তিনটি স্তরে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হুমকি দিচ্ছে। প্রথম স্তরকে বলা হচ্ছে ‘অভ্যন্তরীণ বলয়’ যেটি জর্ডান, ইসরাইল, প্যালেস্টাইন, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়া নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় স্তর হলো ‘নিকটতম প্রবাস বলয়’ যেটি পূর্ববর্তী আরব খিলাফত রাষ্ট্রগুলো যেমন-আফগানিস্তান, পাকিস্থান, ইয়েমেন, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক প্রভৃতি নিয়ে গঠিত। তৃতীয় স্তরটি হলো ‘দূরবর্তী প্রবাস বলয়’ এর অঞ্চলগুলো যেমন- ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ সাইবার ক্ষেত্রগুলো। উপরের তিনটি স্তরেই যে আই এস চরমভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে তা সংগঠনটির সাম্প্রতিক সময়ের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।
::সাম্প্রতিক কর্মকান্ডঃ ২০১৪ সালের জুন থেকে আই এস ইরাকের মোসুল, নেনেয়াভাহ, তিকরিত ও কিরকুক দখল করে এবং সিরিয়ার আল-রাকাহ্ শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আইএস যোদ্ধাদের সঙ্গে যৌনকর্মে রাজি না হওয়ায় গত বছরের আগস্টে মসুলের ১৯ নারীর শিরশ্ছেদ করা হয়। ২০১৪ সালের আগস্টে ৫০০ ইয়াজিদি নারী ও কিশোরীকে অপহরণের পর যৌনদাসী করে আইএস।গত ২০ মার্চ, ২০১৫ ইয়েমেনের রাজধানী সানায় এক মসজিদে আই এস কর্তৃক আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রায় ১৪০ জন নিহত হয় এবং আরো কিছুদিন পূর্বে লিবিয়ায় ২১ জন মিশরীয় খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীর শিরশ্ছেদ করে আই এস। যে ঘটনাটি পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে ধ্বংসযজ্ঞের বার্তা দিয়েছে তা হলো গত ১৮ মার্চ, ২০১৫ তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসের একটি জাদুঘরে আই এস কর্তৃক বন্দুক হামলায় ২৩ জন নিহত হওয়া, যাদের মধ্যে রয়েছে পোল্যান্ড, জার্মানি, স্পেন ও ইতালির নাগরিক। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আক্রমণ আবার জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-এর দিকে বিশ্বের নজর ফিরিয়েছে। আই এস প্যারিস হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে, যে হামলায় অন্তত ১২৯জন মানুষ নিহত এবং তিন শতাধিক আহত হয়েছেন।
::বিশ্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আইএসের হুমকির কারণঃ এই অল্প সময়ের মধ্যে আই এস আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে তা মূলত বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
১।মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আই এস সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে অতি দ্রুত শক্তিশালী করে তুলেছে।
২।আই এসের টার্গেটগুলো হলো মূলত অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগতভাবে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অঞ্চলগুলো যেখান থেকে খুব সহজেই যোগাযোগ ও যুদ্ধ পরিচালনা করা যায়।
৩।অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের মত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার রিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে আই এস এই ব্যবস্থার অভ্যন্তরে থেকে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
৪।মুসলিম তরুণ সমাজ আই এসের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ছে সংগঠনটির কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত আধুনিকতার প্রয়োগের কারণে।
৫।রিয়েলিস্ট বা বাস্তববাদী ভূ-রাজনীতির দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে আই এস ভূখণ্ড দখলের মাধ্যমে ইসলামী খিলাফতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সচেষ্ট।
৬।আই এস অর্থনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হওয়ার কারণে সনাতন যুদ্ধ পরিচালনায় সংগঠনটির খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ তেলখনিগুলো এর দখলে থাকার ফলে প্রতিদিন সংগঠনটি কালোবাজারে তেল বিক্রি করে এক মিলিয়ন ডলারের বেশি আর্ন করছে। অন্যান্য আয়ের উত্সগুলো হলো অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় এবং হামলার মাধ্যমে লুটপাট করা।
৭। আই এসের এত দ্রুত বিকাশের আর একটি কারণ হলো আধুনিক অস্ত্র যেমন ড্রোন, এন্টি ট্যাংক ও এন্টি এয়ারক্রাফট মিশাইল প্রভৃতির ব্যবহার পশ্চিমা যুদ্ধ কৌশলেরই আরেকটি রূপ।
::আইএসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়ঃ
১।আই এস সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যথেষ্ট আধুনিক হওয়ায় সনাতন যুদ্ধে সংগঠনটিকে কোণঠাসা করা বেশ কঠিনই এবং তা হলেও সাধারণ জনগণকে এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে।
২। আই এস একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডভিত্তিক না হওয়ায় সংগঠনটিকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভূ-কৌশলগত দিকটিকে বিচেনায় রেখে দমননীতি প্রণয়ন করা।
৩।অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের মত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার রিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে আই এস এই ব্যবস্থার অভ্যন্তরে থেকে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
৪।মুসলিম তরুণ সমাজ আই এসের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ছে সংগঠনটির কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত আধুনিকতার প্রয়োগের কারণে।
৫।রিয়েলিস্ট বা বাস্তববাদী ভূ-রাজনীতির দর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে আই এস ভূখণ্ড দখলের মাধ্যমে ইসলামী খিলাফতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সচেষ্ট।
৬।আই এস অর্থনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হওয়ার কারণে সনাতন যুদ্ধ পরিচালনায় সংগঠনটির খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ তেলখনিগুলো এর দখলে থাকার ফলে প্রতিদিন সংগঠনটি কালোবাজারে তেল বিক্রি করে এক মিলিয়ন ডলারের বেশি আর্ন করছে। অন্যান্য আয়ের উত্সগুলো হলো অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় এবং হামলার মাধ্যমে লুটপাট করা।
৭। আই এসের এত দ্রুত বিকাশের আর একটি কারণ হলো আধুনিক অস্ত্র যেমন ড্রোন, এন্টি ট্যাংক ও এন্টি এয়ারক্রাফট মিশাইল প্রভৃতির ব্যবহার পশ্চিমা যুদ্ধ কৌশলেরই আরেকটি রূপ।
::আইএসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয়ঃ
১।আই এস সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যথেষ্ট আধুনিক হওয়ায় সনাতন যুদ্ধে সংগঠনটিকে কোণঠাসা করা বেশ কঠিনই এবং তা হলেও সাধারণ জনগণকে এর জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে।
২। আই এস একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডভিত্তিক না হওয়ায় সংগঠনটিকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভূ-কৌশলগত দিকটিকে বিচেনায় রেখে দমননীতি প্রণয়ন করা।
৩।আই এস ইরাক ও সিরিয়ার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে দখল করে দেশ দু’টির জাতিগত, ধর্মীয় ও প্রশাসনিক বিভাজনকে আরো গভীর করছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিভাবে এই বিভাজনকে রোধ করবে সেটাই ভাবার বিষয়।
৪।মধ্যপ্রাচ্য রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হওয়ার কারণে ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে নেয়া যে কোন সিদ্ধান্ত এ অস্থিতিশীলতাকে আরো ঘনীভূত করতে পারে।
৫।বিশ্বায়নের বর্তমানকালে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে অ-রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সত্তাসমূহ যেমন বহুজাতিক কোম্পানী, এনজিও, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনসমূহ যেভাবে কমিয়ে দিচ্ছে তাতে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়ছে।
৬।অর্থনৈতিকভাবে আই এস যেভাবে শক্তিশালী হচ্ছে তাতে অতি দ্রুততার সাথে রোধ করা না গেলে সংগঠনটিকে কোণঠাসা করা বেশ কঠিনই হয়ে পড়বে।
৭।আই এস যেভাবে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সাথে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে তাতে বুদ্ধি ও কৌশল দিয়ে এই অগ্রগতি রোধ করতে না পারলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংগঠনটির প্রভাব বলয়ে চলে যেতে পারে।
::আয়ের উৎসঃ আইএস বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ধনী জিহাদি সংগঠন। তারা সমগ্র ইরাকে প্রায় পাঁচ বছর ধরে বড় বড় অভিযান চালিয়ে আসছে। তোলাবাজি, দাস ব্যবসা, ডাকাতি, মুক্তিপণ আদায়, তেল পাচার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিদিনই তাদের প্রচুর আর্ন হয়। ইরাকের বিভিন্ন এলাকা দখলে আসার পর তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস তেল। তাদের দখলে এখন ইরাকের পাঁচ থেকে ছয়টি তেলক্ষেত্র। সেখানে তেলকূপ আছে ৪০ থেকে ৭০টি। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন ও পরিশোধন হয়। আর তা বাজারদর থেকে কম মূল্যে বিক্রি করে তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আর্ন করে। ইরাকের বিভিন্ন তেল কম্পানির সঙ্গে যুক্ত ফড়িয়ারা এই তেল মসুল প্রদেশের মাধ্যমে তুরস্কে নিয়ে যায়। একইভাবে আনবার প্রদেশের মাধ্যমে তারা তেল নিয়ে যায় জর্দানে, কুর্দিস্তানের পথে ইরানে ও সিরিয়ার কালোবাজারে। এ ছাড়া তাদের আয়ের অন্যতম উৎস মুক্তিপণ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, শুধু ফরাসিরাই ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত আইএসকে ৫৫ মিলিয়ন ডলারের মতো মুক্তিপণ দিয়েছে। কাতারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এ ধরনের অর্থ আদান-প্রদানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে তারা।নিচে আরও কিছু উৎস তুলে ধরা হলঃ
১।অনুদানঃ প্রথম দিকে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দাতব্য সংগঠন এবং ধনী ব্যক্তি আই এসকে অর্থায়ন করতেন। এই দাতাগুলো ছিল মূলত সুন্নি সম্প্রদায়ের এবং তারা সিরিয়ার সংখ্যালঘু আলাউয়ি সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আই এসকে অর্থ যোগান দিতেন। এসব উৎস থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবহার করা বিদেশী যোদ্ধাদের সিরিয়া এবং ইরাকে নিয়ে যাওয়া হলেও, আই এস এখন মোটামুটি স্বয়ং সম্পন্ন হয়ে উঠেছে।
২।তেলঃ আমেরিকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, আই এস ২০১৪ সালে তেল বিক্রি করে ১০ কোটি ডলার আয় করেছে। তারা অশোধিত তেল এবং তেল-ভিত্তিক সামগ্রী দালালদের কাছে বিক্রি করে, যারা সেগুলো তুরস্ক এবং ইরানে চোরাচালান করে – বা সিরিয়ার সরকারের কাছে বিক্রি করে। কিন্তু সম্প্রতি আই এস-এর তেল স্থাপনাগুলোর উপর বিমান হামলার ফলে তাদের অর্থের এই উৎস কমে গেছে।
৩।অপহরণঃ অপহরণ এই গোষ্ঠীর আয়ের একটি বড় উৎস। আই এস ২০১৪ সালে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে অন্ততপক্ষে দুই কোটি ডলার আয় করে। আই এস থেকে পক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসা একজন বলেছেন, অপহরণ অভিযান চালানোর জন্য সংগঠনটির একটি স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে, যার নাম ‘ইন্টেলিজেন্স এ্যাপারেটাস’।অপহরণকে আই এস তাদের পরিচিতি প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করে।ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী ইরাক এবং সিরিয়াতে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা সাংবাদিক এবং ত্রানকর্মীকে অপহরণ করে হত্যা করেছে।
৪।চুরি-ডাকাতি, লুট আর চাঁদাবাজিঃ মার্কিন অর্থ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, আই এস তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার জনগণকে জোরপূর্বক চাঁদা দিতে বাধ্য করিয়ে প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ ডলার আয় করে। যারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা দিয়ে যাতায়াত করে, বা সেখানে ব্যবসা করে বা শুধু বসবাস করে, তাদের কাছ থেকে ‘নিরাপত্তা’ দেবার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে চাঁদা আদায় করা হয়। আই এস ব্যাংক লুট করে, গবাদিপশু চুরি করে এবং পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ উপার্জন করে। সিরিয়ার বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চুরি করে বিক্রি করাও আই এস-এর অর্থের একটি উৎস।
৫।ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর করঃ আই এস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘যিযিয়া’ নামে একটি বিশেষ কর দিতে হয়।ইরাকের মোসুল শহরে মসজিদগুলোতে একটি ঘোষণা পড়া হয়, যেখানে ক্রিশ্চানদের বলা হয় মুসলমান হয়ে যেতে, নয় ‘যিযিয়া’ দিতে। শহর ছেড়ে না চলে গেলে তাদের হত্যার হুমকি দেয়া হয়। “তাদের আমরা তিনটি পথ দিয়েছি। হয় ইসলাম গ্রহণ করো, নয় যিযিয়া করসহ ধিমা চুক্তি। তারা যদি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তাদের জন্য তলোয়ার ছাড়া আর কিছুই থাকবে না”, আই এস বিবৃতিতে বলা হয়।
৬।দাসত্বঃ আই এস অপহরণকৃত মেয়েদের যৌন দাস হিসেবে বিক্রি করে অর্থ আয় করেছে। স্থানীয় ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের তথ্য অনুযায়ী, যখন আই এস ইরাকের উত্তরে সিনজার শহর দখল করে, তখন তারা হাজার হাজার ইয়াজিদি নারী এবং যুবতী মেয়েকে বন্দী করে, এবং তাদের অনেককে যৌন দাস হিসেবে ব্যবহার করে। হান্নান নামের একজন ইয়াজিদি নারী বলেন তিনি আই এস-এর হাত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি বিবিসিকে বলেন, তাকে আরো ২০০ নারী ও মেয়ের সাথে একটি ক্রীতদাসীদের হাট-এ নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে আই এস যোদ্ধারা এসে নিজের পছন্দ মত মেয়ে নিয়ে যেত।
::আইএস এর যোদ্ধাঃ যোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা অজানা। সংগঠনটির পক্ষে হাজার হাজার জিহাদি ইরাকে লড়াই করছে বলে ধারণা করা হয়। অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের কলাকৌশলের দিক থেকেও তারা বেশ অগ্রসর। বিরোধীদের ঢালাও শিরশ্ছেদ করে নিন্দিত হয়েছে আইএস। ইতিমধ্যে তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার জবাবে পাশ্চাত্যের কয়েকজন সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীকে জবাই করে ভিডিও প্রচার করে। বিমান হামলার আগেও কয়েকটি শিরশ্ছেদের ঘটনা ঘটিয়েছে। আল-কায়েদার মতো তারাও সংগঠনে যোদ্ধা নিয়োগ করে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে তাদের মাল্টিমিডিয়া প্রচারণা খুব সংঘবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। সামাজিক মাধ্যমেও উচ্চমানের চমৎকার ভিডিও প্রোডাকশনের মাধ্যমে স্পষ্ট ও সহজ বার্তা প্রচার করে তারা। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার বিদেশি যোদ্ধা আই এস-এ যোগদান করেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ যোদ্ধা এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ব্রিটিশ মুসলিম নারীর আই এসের যোদ্ধা হিসেবে যোগ দেয়া।আল-কায়েদাও তাদের কিছু কাজকর্মকে বাড়াবাড়ি বলেছে। তারা ইয়াজিদি নারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে জোর করে যৌন দাসত্ব গ্রহণে বাধ্য করেছে। এ থেকে বাঁচতে কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে বলে ওই সময় জানিয়েছিল মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
::আইএস নির্মুলে গৃহিত পদক্ষেপঃ
১।২০১১ সালের ৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আইএস প্রধান আল-বাগদাদিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ঘোষণা করে তাকে জীবিত বা মৃত গ্রেপ্তার বা তথ্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে।
২।২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে ২৬তম ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের শেষদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আইএস দমনে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গঠনের ঘোষণা দেন।
৩।২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে আইএস নির্মূলে সর্বাত্মক বিমান হামলা শুরু করে। এরপর জাতিসংঘ ও তার সদস্য দেশগুলোর নাগরিকদের যোগ দেওয়া ঠেকাতে সদস্য দেশগুলোর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগাদা দিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৫টি সদস্য দেশের সর্বসম্মতিতে একটি প্রস্তাব পাস হয়। ওই বৈঠকে বারাক ওবামা এই সংগঠনকে নেটওয়ার্ক অব ডেথ এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন দুষ্টচক্র আখ্যায়িত করে।
৪। ২৩ জানুয়ারি, ২০১৫ আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পন্থা নিয়ে আলোচনা করতে লন্ডনে ২২ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সমন্বিত বৈঠক হয়েছে।
৫।২০১৬ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধার সংখ্যা ৩১ হাজার থেকে কমে ২৫ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সূত্রে এ তথ্য জানিয়েছে হোয়াইট হাউস। আইএসের যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার ব্যাখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা লড়াইয়ে হতাহত হওয়া ও বাহিনী ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদনে আইএস নির্মূলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অভিযানে অগ্রগতি হচ্ছে দেখানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তারা। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জোশ আর্নেস্ট বলেন, নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ীও (আইএসের) হুমকি উল্লেখযোগ্যভাবে বজায় আছে, তবে তাদের সামর্থ্য হ্রাস পেয়েছে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের জোট অংশীদারদের স্থলযুদ্ধের প্রচেষ্টাও আইএসবিরোধী লড়াইয়ে প্রভাব রেখেছে, যে গোষ্ঠীটিকে আইএসআইএস বা আইএসআইএল-ও বলা হয়। ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর বেসামরিক বাহিনী এবং সিরিয়ার মধ্যপন্থি সরকারবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে বলে দাবি করেন তিনি।
==উৎস
=
১।বিবিসি বাংলা।২৫ অক্টোবর, ২০১৫।
২।দৈনিক ইত্তেফাক।৩১ মার্চ, ২০১৫।
৩। বিবিসি বাংলা।১৮ নভেম্বর, ২০১৫।
৪। দৈনিক কালের কন্ঠ।৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫।
৫।রয়টার্স।৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬।
আরো পড়ুন: