শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট বিভাগ

অন্যান্য বিভাগের তুলনায় শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট বিভাগ

দুই বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেই ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার আবদুল আলিম। পড়ালেখার জন্য নয়, সিলেটের এ তরুণের যাত্রা কাজের সন্ধানে।

হাওড়বেষ্টিত সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার রহিমা আক্তার দেশেই আছেন। তবু মাধ্যমিকের পর আর এগোয়নি তার পড়ালেখা। তাছাড়া রহিমার বাড়ির কাছাকাছি কোনো কলেজও নেই। এ সমস্যার পাশাপাশি দারিদ্র্য আর নিরাপত্তাহীনতাও শিক্ষা থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে দিয়েছে তাকে।

আবদুল আলীম উচ্চ মাধ্যমিক ও রহিমা আক্তার মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোলেও অনেকে তাও পারছে না। প্রাথমিকের পরই থেমে যাচ্ছে তাদের শিক্ষাযাত্রা। সরকারের পরিসংখ্যানও বলছে, প্রাথমিক-পরবর্তী মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা— সর্বস্তরেই দেশের আর বিভাগের চেয়ে পিছিয়ে সিলেট। যদিও দেশের শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব যার হাতে, সেই শিক্ষামন্ত্রী এ বিভাগেরই মানুষ। ২০০৯ সাল থেকে টানা এ মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন সিলেটের বিয়ানীবাজারের নুরুল ইসলাম নাহিদ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, মাধ্যমিক শিক্ষা রয়েছে দেশের মোট ২২ শতাংশ মানুষের। অথচ সিলেট বিভাগে এ হার মাত্র ১৯ শতাংশ। মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে খুলনা। বিভাগটির ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা রয়েছে। অন্য বিভাগগুলোর মধ্যে রংপুরে এ হার ২০ দশমিক ৭, বরিশালে ২২ দশমিক ৯, চট্টগ্রামে ২৩ দশমিক ৩ এবং ঢাকা ও রাজশাহীতে এ হার ২১ দশমিক ৫ শতাংশ মাধ্যমিকের পরের স্তর উচ্চ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে সিলেট। বিভাগটির মাত্র ৯ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষের এ স্তরের শিক্ষা রয়েছে। যদিও জাতীয়ভাবে এ হার ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। বিভাগওয়ারি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্নের হার বরিশালে ১৪ দশমিক ৫, চট্টগ্রামে ১২ দশমিক ৬, ঢাকায় ১৩ দশমিক ৪, খুলনায় ১৩, রাজশাহীতে ১২ দশমিক ৩ ও রংপুরে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।

শিক্ষায় সিলেট বিভাগের মানুষের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়ার কারণ

শিক্ষায় সিলেট বিভাগের মানুষের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়ার কারণ থাকলেও বিদেশমুখী প্রবণতাকেই এক্ষেত্রে বড় করে দেখছেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হাসানুজ্জামান। তিনি বলেন, এখনো এখানকার বেশির ভাগ তরুণের স্বপ্ন কোনো রকমে বিদেশে যাওয়া, বিশেষত ইংল্যান্ডে। ফলে লেখাপাড়া শেষ না করেই তারা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। এ কারণে সিলেট বিভাগে প্রাথমিক-পরবর্তী শিক্ষার স্তরগুলোয় অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম।

উচ্চশিক্ষায়ও দেশের অন্য সব বিভাগের চেয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট। এ বিভাগের মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে। যদিও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে উচ্চশিক্ষা আছে দেশের মোট ৩ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষের। উচ্চশিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। অন্যান্য বিভাগের মধ্যে বরিশালে এ হার ৩ দশমিক ৪, খুলনায় ৩ দশমিক ৩, রাজশাহীতে ৩ দশমিক ৪, রংপুরে ৩ ও চট্টগ্রামে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাত্ উচ্চশিক্ষায় সিলেটের পরই খারাপ অবস্থায় আছে চট্টগ্রাম বিভাগ।

সিলেটে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতাকে এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নিতাই চন্দ্র চন্দ। তিনি বলেন, সিলেটে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংকট রয়েছে। এখানে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও দুটিই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। সবাই সেখানে পড়ার সুযোগ পায় না। অন্যান্য বিভাগের তুলনায় এখানে কলেজের সংখ্যাও কম। আবার জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোয়ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ তেমন নেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সিলেট বিভাগে কলেজ রয়েছে মাত্র ১৫৭টি। যদিও ঢাকা বিভাগে এ সংখ্যা ৮৭৩। অন্যান্য বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে কলেজ রয়েছে ৪৫২টি, রাজশাহীতে ৫৬২, খুলনায় ৪৫৭, রংপুরে ৪৩৫ ও বরিশালে ২৬০টি। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যায়ও সবচেয়ে পিছিয়ে আছে প্রায় এক কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বিভাগটি। সিলেট বিভাগে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দুটি। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে আরো পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতার পাশাপাশি হাওড়ের কারণ

সিলেটের বেশকিছু এলাকায় মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্য রয়েছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ কারণে সিলেট বিভাগের মানুষের প্রাথমিক-পরবর্তী শিক্ষায় অংশগ্রহণ কম জানিয়ে তিনি বলেন, চা বাগানের শ্রমিকদেরও আর্থিক সচ্ছলতা নেই। এসব মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। আর সিলেট অঞ্চলে সচ্ছল মানুষের মধ্যে বিদেশমুখী প্রবণতা রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহের ঘাটতি লক্ষ করা যায়।

চারটি জেলা নিয়ে গঠিত সিলেট বিভাগের জনসংখ্যা ৯৮ লাখের বেশি। এ জনসংখ্যার ২৭ দশমিক ১ শতাংশ কখনই বিদ্যালয়মুখী হয়নি। অর্থাত্ এক্ষেত্রেও অন্যতম শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে সিলেট। বিদ্যালয়ে যায়নি, এমন জনসংখ্যার বিবেচনায় শীর্ষ অবস্থান রাজশাহীর। বিভাগটিতে কখনই বিদ্যালয়ে যায়নি, এমন মানুষের হার ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

কোনো বিভাগ শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকলে কীভাবে তাদের এগিয়ে নেয়া যায়, যাচাই-বাছাই করে সে ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে বলে জানান জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. আফছারুল আমীন। তিনি বলেন, শিক্ষা সবার জন্য সমান অধিকার। কোনো উপজেলা, জেলা বা বিভাগের মানুষ সবচেয়ে পিছিয়ে থাকলে যাচাই-বাছাই করে তা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।

শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট বিভাগ

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline