প্রিলি, লিখিত ও ভাইভা
.
লিখিত প্রস্তুতি : আন্তর্জার্তিক বিষয়াবলি + বাংলাদেশ বিষয়াবলি
Topic: জাতিসংঘ, মানবাধিকার, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, মানবাধিকার সনদ ও নারীপ্রগতি
:: মানবাধিকার সনদ :
* অনুমোদন = ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪৮
* সনদে অনুচ্ছেদ রয়েছে = ৩০
* মানবাধিকার দিবস পালন করা হচ্ছে = ১৯৫০ সাল থেকে
* মানবাধিকার দিবস = ১০ ডিসেম্বর
* সনদ ঘোষিত হয় = প্যালাইজ দ্য চেইলট, প্যারিস
.
* মানবাধিকার সনদ (Universal Declaration of Human Rights) হলো একটি ঘোষণাপত্র যেটি প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে প্যারিসে ঘোষিত হয়।
* জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের উপর সার্বজনীন ঘোষণার খসড়া সিদ্ধান্তটি অনুমোদিত হয়।
* প্রস্তাবের পক্ষে ৪৮ ভোট পড়ে এবং বিপক্ষে কোন ভোটপড়েনি। কিন্তু ৮টি দেশ ভোট প্রদানে বিরত থাকে। দেশগুলো হলো: সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউক্রেন, বেলারুশ, যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চেকোস্লোভাকিয়া এবং সৌদী আরব।
.
.
:: মানবাধিকার সনদ (একনজরে-সনদে যেটি বলা আছে) :
“”যেহেতু মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা ও সম অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহের স্বীকৃতি বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়-বিচার ও শান্তির ভিত্তি; যেহেতু মানবিক অধিকারসমূহের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা মানবজাতির বিবেকের পক্ষে অপমানজনক বর্বরোচিত কাযর্কলাপে পরিণতি লাভ করেছে এবং সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হিসেবে এমন একটি পৃথিবীর সূচনা ঘোষিত হয়েছে যেখানে মানুষ বাক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং ভয় ও অভাব থেকে নিষ্কৃতি ভোগ করবে;
যেহেতু চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে মানুষকে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে বাধ্য করা না হলে মানবিক অধিকারসমূহ অবশ্যই আইনের শাসনের দ্বারা সংরক্ষিত করা উচিত;
.
যেহেতু জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়তা করা অবশ্যক; যেহেতু জাতিসংঘভুক্ত জনগণ সনদের মাধ্যমে মৌল মানবিক অধিকারসমূহ অধিকারসমূহ, মানুষের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী ও পুরুষের সম-অধিকারের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং সামাজিক অগ্রগতি ও ব্যাপকতর স্বাধীনতা উন্নততর জীবনমান প্রতিষ্ঠাকল্পে দৃঢপ্রতিজ্ঞ;
.
যেহেতু সদস্যরাষ্ট্রসমূহ জাতিসংঘের সহযোগিতায় মানবিক অধিকার ও মৌল স্বাধিকারসমূহের প্রতি সার্বজনীন শ্রদ্ধা ও মান্যতা বৃদ্ধি অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ; যেহেতু সকল অধিকার ও স্বাধিকারের ব্যাপারে একটি সাধারণ সমঝোতা উক্ত অঙ্গীকার সম্পূর্ণরূপে আদায় করার জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ;
.
তাই সাধারণ পরিষদ সকল জাতি ও জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির একটি সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে জারি করছে এই মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র;
.
ঐ লক্ষ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ মানবিক অধিকারসমূহের এই সর্বজনীন ঘোষণাপত্রটিকে সর্বদা স্মরণ রেখে শিক্ষাদান ও জ্ঞান প্রসারের মাধ্যমে এ সকল অধিকার ও স্বাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে জাগ্রত করতে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রগতিশীল ব্যবস্থাদির দ্বারা সদস্য-রাষ্ট্রসমুহের জনগণ ও তাদের অধীনস্থ অঞ্চলসমূহের অধিবাসীবৃন্দ উভয়ের মধ্যে ঐগুলোর সর্বজনীন ও কার্যকর স্বীকৃতি ও মান্যতা অর্জনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাবে৷””
.
.
:: মানবাধিকার: বিবর্তনের ধারাস্রোতে
ষাট বছর আগে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বলিষ্ঠ অভিব্যক্তি, শান্তি, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সাধনের অঙ্গীকার নিয়ে একটি নতুন সংগঠন জন্মলাভ করে। ১৯৪৫ সাল থেকে এই সংগঠন অর্থাৎ জাতিসংঘ বহু চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করেছে। তবে সংস্থাটি এর সনদে সন্নিবেশিত প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হাসিল করেছেথআর এই সাফল্যের মাত্রা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতাদের আশা আকাঙ্ক্ষার গন্ডিকে বহুদূর ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের সমস্ত সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত নীতিবোধ নিংড়ে নিয়ে জাতিসংঘ সর্বজনস্বীকৃত মানবাধিকার সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। ইতিহাসের আর কোনো অধ্যায়েই রাজনৈতিক, নাগরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিধিবিধান নির্ধারণে অতখানি যত্ন ও মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয়নি।
.
জাতিসংঘের অন্যতম প্রণিধানযোগ্য সাফল্য হচ্ছেথএক ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন। ইতিহাসে জাতিসংঘই প্রথমবারের মতো সর্বজনীন মানবাধিকার বিধিমালা প্রণয়ন করেছেথযে বিধিমালায় প্রতিফলিত অধিকারসমূহের প্রতি বিশ্বের সব জাতি তাদের সমর্থন জানাতে পারে এবং বিশ্বের সব মানুষ সে অধিকারের আকাঙ্ক্ষা করতে পারে।
.
জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নাগরিক অধিকারের ব্যাপকভিত্তিক রূপরেখাই শুধু নির্ধারণ করেনি, বরং এইসব অধিকার সংরক্ষণ ও তা উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তন, তা সংরক্ষণ ও জোরদারকরণের প্রক্রিয়া এবং সরকারসমূহকে এ বিষয়ে সহায়তাদানের কার্যপ্রণালী বিধিও রূপায়িত করে দিয়েছে।
১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা গ্রহণের পর থেকে মানবাধিকার প্রসঙ্গটি সারাবিশ্বের নজিরবিহীন ধরনের মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণ করেছে। নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী, শ্রমিক, উদ্বাস্তু এবং অন্যান্য দুস্থ জনগোষ্ঠী আজ এমন কিছু বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে অব্যাহতি পেয়েছে, যেটি বহু সমাজে সাধারণভাবে বদ্ধমূল ছিল।
.
.
:: মানবাধিকার : প্রাথমিক বছরগুলো
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিপুঞ্জ (লীগ অব নেশনস) কর্তৃক প্রণীত কোভেনেন্ট বা সনদে মানবাধিকার প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ নিরুক্ত থাকে। এতে মানবাধিকার প্রশ্নটি আদৌ কোনো স্থান পায়নি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল এই সংঘাতকে ‘মজবুত ভিতের ওপর ব্যক্তি অধিকারের প্রতিষ্ঠা’ বলে আখ্যায়িত করেন। ১৯৪১ সালে মিত্রপক্ষের দেশগুলো কর্তৃক চারটি ‘স্বাধীনতার’ ঘোষণা দেয়া হয় : তা হচ্ছে, বক্তব্য প্রকাশ, উপাসনা, অভাব এবং ভয়ভীতি থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা। মিত্রপক্ষের এই অঙ্গীকার ১৯৪২ সালের আটলান্টিক সনদ এবং ১৯৪২ সালের জাতিসংঘ-ঘোষণায় পুনর্ব্যক্ত করা হয়। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতাগণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং জঘন্য হত্যাযজ্ঞের প্রতিবন্ধক হিসেবে সংস্থার সনদে মানবাধিকার প্রসঙ্গের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
.
১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিস্কো সম্মেলনে প্রধানত ছোট দেশের প্রতিনিধি দলের সাথে গির্জা, মহিলা, ট্রেড ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রায় ৪০টি বেসরকারি (এনজিও) সংগঠনের প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে আরো সুনির্দিষ্টরূপে মানবাধিকারের রূপরেখা নির্ধারণে ব্রতী হন। অনেকে এমনকি সনদের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক ‘বিল অব রাইটস’ অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি উত্থাপন করেন। এই জোরালো উদ্যোগ প্রচেষ্টা সনদে সুস্পষ্ট অধিকারনামার সন্নিবেশ ঘটানো সম্ভব করে তোলেথযা পর্যায়ক্রমে ১৯৪৫ সাল পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বহু আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন সম্ভব করে তুলেছে।
.
.
:: জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন :
মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব জাতিসংঘের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিষদকে ন্যস্ত করা হয়েছে। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব অনুসারে ১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিষদের একটি কার্যকমিশন রূপে মানবাধিকার সম্পর্কিত কমিশন গঠিত হয়। জেনিভায় এর সদরদপ্তর অবস্থিত। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এই কমিশনের সদস্যসংখ্যা ছিল ৫৩। ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ফিনল্যান্ড, গিনি বিসাউ, মালয়েশিয়া, মরিশাস, পোল্যান্ড, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া, সুদান এবং টোগো এই কমিশনের নতুন সদস্যপদ অর্জন করেছে। এছাড়াও সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধ এবং সুরক্ষার জন্য একটি সাব-কমিশন (Sub-Commission on the Prevention on Discrimination and the Protection of Minorities) গঠিত হয়েছে।
.
মানবাধিকার কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হল : মানুষের মৌল অধিকারগুলিকে আরও বেশি মর্যাদাপ্রদর্শন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অবসান এবং তাদের সংরক্ষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তদন্ত করা, নীতি-সম্পর্কিত নির্দেশনা দান, অধিকার-বিষয়ক বিভিন্ন ঘোষণা এবং সম্মেলন আহবান করা। প্রতিবছর এই কমিশনের সম্মেলন আহবান করা হয়। প্রায় সপ্তাহব্যাপী এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মানবাধিকার কমিশন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয় তদন্ত এবং পর্যালোচনা করে। এর ফলে মানবাধিকার কমিশন এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধ এবং তাদের সুরক্ষা উপ-কমিশন, মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণের বক্তব্য-সম্বলিত দলিল প্রস্তুত করে।
.
.
:: সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা :
মানবাধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘের দ্বারা প্রকাশিত এবং ঘোষিত সকল দলিলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হল মানবাধিকার সম্পর্কে সর্বজনীন ঘোষণা (Universal Declaration of Human Rights)। এই ঘোষণার বিষয়বস্তু আলোচনার পূর্বে সংক্ষেপে তার পটভূমি আলোচনা করা প্রয়োজন।
মানবাধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘে বক্তব্য পেশের জন্য ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের পত্নী ও মানবতাবাদের প্রবক্তা এলিনর রুজভেল্টের সভানেত্রীত্বে মানবাধিকার-সংক্রান্ত একটি কমিশন গঠিত হয়। ঐ কমিশনের মুখ্য দায়িত্ব ছিল মানবাধিকার-সম্পর্কিত ঘোষণার একটি খসড়া প্রস্তুত করা। এই কমিশনকে পৌর ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কে দুটি স্বতন্ত্র চুক্তিপত্রের খসড়া রচনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। প্রায় আড়াই বছরের অধিককাল পরিশ্রমের পর মানবাধিকার-সম্পর্কিত ঘোষণার খসড়া প্রস্তুত করা হয়।
.
খসড়াটি ১৯৪৮ সালে সাধারণ পরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে বিবেচনা এবং অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। ঐ বছর ১০ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ ঐ প্রস্তাব অনুমোদন করে। সাধারণ পরিষদের উক্ত অধিবেশনে ৫৮টি সদস্যরাষ্ট্র অংশগ্রহণ করে। ৪৮টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ৮টি সদস্যরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। ২টি সদস্যরাষ্ট্র ভোটদানের সময়ে অনুপস্থিত ছিল।
.
ঘোষণার ৩০টি ধারায় প্রধান প্রধান অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংযোজন করা হয়েছে। কোনোপ্রকার বৈষম্য ছাড়াই পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের মানুষ ঐ অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। ঘোষণায় যেসব অধিকার যুক্ত হয়েছে তার মধ্যে আছে : জীবন, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার, দাসত্ব থেকে মুক্তি, স্বৈরাচারী আটক ও গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক সুষ্ঠু বিচারের অধিকার, দোষী সাব্যস্ত না-হওয়া পর্যন্ত নিরপরাধ হিসেবে গণ্য করার অধিকার, আবাসস্থলের অলঙ্ঘনীয়তা ও পত্রালাপের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার, চলাচল ও বসবাসের অধিকার, বিবাহ ও পরিবার গঠনের স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত হবার ও সংগঠন গড়ার স্বাধীনতা, ভোটদান এবং সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মের ও উপযুক্ত জীবনযাত্রার মানের নিশ্চয়তা বিধান, শিক্ষা ও সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকার।
.
মানবাধিকার সম্বন্ধে সার্বজনীন ঘোষণায় সংগঠন, প্রত্যক্ষভাবে বা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকারে অংশগ্রহণ, সরকারি চাকরি লাভের ক্ষেত্রে সমানাধিকার, বিশ্রাম ও অবসর যাপনের অধিকার, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বাস্থ্যরক্ষার অধিকার; রোগ, অক্ষমতা এবং বৃদ্ধবয়স ও বৈষম্যে নিরাপত্তা এবং অভাব থেকে মুক্তির অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তাছাড়া সাধারণভাবে অভাব থেকে মুক্তি এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অধিকার স্বীকার করা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সাম্য এবং আইনের দ্বারা সমানভাবে সংরক্ষিত হবার আধিকারও ঘোষিত হয়েছে।
.
সাধারণ পরিষদ ঐ ঘোষণাকে সকল মানুষ ও জাতির পক্ষে সাফল্যের সাধারণ মান হিসাবে উল্লেখ করেছে। ঐ সকল জাতির অধিকার ও স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং তাদের প্রয়োজনের জন্য সাধারণ মানুষ ও সকল জাতির কাছে আবেদন করেছে।
১৯৫০ সালের ৪ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ঐ প্রস্তাবে সকল জাতি ও উৎসাহী সংগঠনকে প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর ‘মানবাধিকার দিবস’ পালনের জন্য আহবান জানানো হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর ‘মানবাধিকার দিবস’রূপে উদ্যাপিত হয়।
.
‘মানব অধিকার’-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। বহু দেশের সংবিধানের ওপর ঐ ঘোষণার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। ঐ ঘোষণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জাতিসংঘ এবং তার বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বহু আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, উদ্বাস্তুদের মর্যাদা, রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের মর্যাদা, নারীসমাজের রাজনৈতিক অধিকার, বিবাহিতা মহিলাদের নাগরিকতা, দাসপ্রথা ও দাস ব্যবসায় কনভেনশন, বেকার শ্রমিকপ্রথা বিলোপ ইত্যাদি বিষয়-সংক্রান্ত বিভিন্ন কনভেনশনের নাম উল্লেখ করা যায়।
.
১৯৫১ সালে সানফ্রান্সিসকোতে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের প্রাক্কালে ‘মানবাধিকার সম্পর্কে সর্বজনীন ঘোষণার’ লক্ষ্য পূরণে উদ্যোগ গ্রহণের বিষয় আলোচিত হয়। ১৯৫৪ সালে ইতালি ও যুগোশ্লাভিয়া ঐ ঘোষণায় সংযোজিত নীতি অনুযায়ী স্ব স্ব অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালনার অঙ্গীকার ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার সংরক্ষণ ও মৌলিক স্বাধীনতা-সম্পর্কিত ইউরোপিয়ান কনভেনশনেও ঐ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল।
.
মানবাধিকার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ঘোষণাকে একটি নীতি-সম্বলিত ঘোষণা বলা যায়। মানবাধিকার সম্পর্কে সর্বজনীন ঘোষণায় ব্যক্তির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আইনগত অধিকারের নানাদিক উল্লেখিত হয়েছে। এখানে ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ এবং সর্বোচ্চ বিকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানবাধিকারের এই ঘোষণাকে রূপায়ণের দায়িত্ব প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের। আন্তর্জাতিক স্তরে এই দায়িত্ব বর্তায় মানবাধিকার কমিশনের ওপর। একমাত্র এই কমিশনই এই বিষয়ে অধিকার-লঙ্ঘনকারী কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারে। কমিশন এবং সামগ্রিকভাবে জাতিসংঘ নির্দেশ অমান্য করলে একমাত্র এই সংগঠনের তরফ থেকে নিরাপত্তা পরিষদ শাস্তিমূলক ব্যবস্থারূপে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
.
মানবাধিকার-সম্পর্কিত ঘোষণার আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সমাজের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্যবিষয়ক নির্দেশ। ঘোষণার ২৯ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, সমাজের প্রতি প্রতিটি ব্যক্তির কর্তব্য আছে। কারণ, একমাত্র সমাজের মধ্যেই প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ এবং পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব। স্বাধীনতা এবং অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যক্তির অধিকারেই একমাত্র আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাধানিষেধ আরোপিত হতে পারে। অন্যের অধিকার এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং তার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের জন্যই এই বাধানিষেধ আরোপ করা যাবে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে নৈতিকতা, জনকল্যাণ এবং জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই কেবল অধিকার ও স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যাবে। তাছাড়া আর-একটি শর্তও আরোপ করা হয়েছে। জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এবং নীতির বিরোধিতা করে এই অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করা যাবে না। সুতরাং ঘোষণায় স্বীকৃত অধিকার এবং স্বাধীনতা কর্তব্যবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
.
মানবাধিকার সম্পর্কে ঘোষণার সময়ে শিশুদের অধিকার জাতিসংঘ বিস্মৃত হয়নি। ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদ শিশুদের সাধারণ অধিকার সম্পর্কে একটি ঘোষণাপত্র সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। তাছাড়া কোনো জাতির অস্তিত্ব বিলোপের চক্রান্ত প্রতিরোধ, উদ্বাস্তু ও রাষ্ট্রহীন নাগরিক, রাজনৈতিক আশ্রয়গ্রহণ, শ্রমিকসংঘের অধিকার, বেগার-শ্রমের বিলোপ, দাসপ্রথা বিলোপ, যুদ্ধবন্দি, নারীসমাজের মর্যাদা রক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সম্মেলন আহবান, কমিশন গঠন ও প্রস্তাব অনুমোদনের মাধ্যমে জাতিসংঘ মানবাধিকার রক্ষার চেষ্টা করেছে। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সম্মেলন আহবান, চুক্তিপত্রের খসড়া প্রণয়ন এবং প্রচারকার্যে এই আন্তর্জাতিক সংগঠন সাফল্য অর্জন করেছে। লক্ষ্য করা গেছে যে, মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনকে নেতৃত্ব না দিয়ে সাধারণ পরিষদ নির্জোট কোনো চুক্তির খসড়া রচনা করেছে। সাধারণ পরিষদ জাতি, জাতিগোষ্ঠী, বর্ণ এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিলোপসাধনের বিরোধী চুক্তিপত্র রচনা করেছে। ১৯৫৭ সালে দাসপ্রথা, দাসব্যবসা এবং দাসপ্রথার মতো প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসা নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৬০ সালে মানবাধিকার কমিশন রাজনৈতিক আশ্রয়দানের অধিকারের বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করেছে। মানবাধিকার কমিশনের সাব-কমিশন শিক্ষা, নিয়োগ, ধর্মীয় অধিকার ও ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে, ন্যায়নীতি রূপায়ণে বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে একটি সমীক্ষা করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সম্বন্ধে সাব-কমিশন কর্তৃক প্রণীত একটি চুক্তি ১৯৬০ সালে ইউনেস্কো গ্রহণ করেছে।
.
এছাড়াও জাতিসংঘের তরফ থেকে অধিকার রক্ষার জন্য অনেক ঘোষণা জারি করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ১৯৫৯ সালে শিশুদের অধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণা (Declaration of the Rights of the Child)-এর নাম উল্লেখ করা যায়। ১৯৮৮ সালে এই বিষয়ে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এছাড়াও প্রতিটি ব্যক্তিকে স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে গ্রেপ্তার, আটক, নির্বাসনদন্ড প্রদান অথবা তথ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে ঘোষণা জারি করা হয়েছে।
সাধারণ পরিষদ কর্তৃক মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণায় উচ্চকিত কণ্ঠে অনুরণিত হয়েছে যে, এই ঘোষণাটি সকল মানুষ এবং জাতির অধিকারের একটি মানদন্ডরূপে বিবেচিত হবে। এই ঘোষণাকে স্থায়ীভাবে স্মরণ রেখে প্রতিটি ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অধিকার, স্বাধীনতা এবং প্রগতিশীল পদক্ষেপগুলিকে সকল সদস্যরাষ্ট্রের জনগণের এবং তাদের অধীনস্থ ভূখন্ডের জনগণের জন্য সর্বজনীনভাবে সুরক্ষিত, স্বীকৃতি প্রদান এবং রূপায়ণের জন্য সচেষ্ট থাকবে।
.
.
:: দুটি চুক্তি :
জাতিসংঘের আলাপ-আলোচনার ফলশ্রুতিতে আইনত পালনীয় ব্যাপকভিত্তিক যে দুটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, এর একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি আর অন্যটি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সম্বলিত আন্তর্জাতিক চুক্তি। ১৯৬৬ সালে গৃহীত এই চুক্তিদ্বয় মেনে চলার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোর ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে জাতিসংঘ-সনদের বিধানগুলোকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রবর্গ এই চুক্তিদ্বয়ের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। ফলে মানবাধিকার হালচাল পর্যবেক্ষণের মতো আন্তর্জাতিক দোর উন্মুক্ত হয়েছে। এই দুটি দলিল জাতিসংঘ সনদের সাথে যুক্ত হয়ে ‘আন্তর্জাতিক বিল অব রাইটস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতিসংঘের এখতিয়ারাধীনে মানবাধিকারের ব্যাপক ক্ষেত্র প্রসঙ্গে আরো ৮০টি কনভেনশন ও ঘোষণা সম্পাদিত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি কনভেনশন ও ঘোষণার কথা নিম্নে উল্লেখ করা হল :
* গণহত্যার শাস্তিবিষয়ক ১৯৪৮ সালের কনভেনশন। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট জবাবস্বরূপ। এতে গণহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলা হয়, গণহত্যা হচ্ছে কোনো জাতি, জাতিসত্তা অথবা কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নির্মূলের উদ্দেশ্যে পরিচালিত নির্বিচার হত্যাকান্ড।
* বর্ণবৈষম্যের বিলোপসাধন-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন। ১৯৬৬ সালে সম্পাদিত এই চুক্তিটি বিপুলসংখ্যক রাষ্ট্রের অনুমোদন লাভ করেছে। ১৯৯৫ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বের ১৪৩টি রাষ্ট্র এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তিতে বর্ণবৈষম্যভিত্তিক যে-কোনো আচরণকে আইনত নিন্দনীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
* উদ্বাস্তুদের মর্যাদা ও অধিকারবিষয়ক ১৯৬১ সালের কনভেনশন। এই চুক্তিতে উদ্বাস্তুদের কাজ করার, শিক্ষালাভের, ভ্রমণের কাগজপত্র পাবার এবং সরকারি সহায়তা লাভের অধিকারসমেত দায়িত্ব ও কর্তব্যের বর্ণনা বিধৃত হয়েছে।
* মহিলাদের বিরুদ্ধে যে-কোনো ধরনের বৈষম্য বিরোধী ১৯৭৯ সালের কনভেনশন। এতে নারীর রাজনৈতিক, জাতীয়তা, শিক্ষা, বিবাহ এবং পরিবার-সংশ্লিষ্ট যে-কোনো বৈষম্য নিরসনের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার উল্লেখ রয়েছে।
* যে-কোনো ধরনের অসহিষ্ণুতা এবং ধর্ম ও বিশ্বাসভিত্তিক বৈষম্যের অপনোদন-সংক্রান্ত ঘোষণা। ১৯৮১ সালে গৃহীত এ ঘোষণায় প্রত্যেকের চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং নিজস্ব ধর্ম অনুশীলনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার কথা বিধৃত হয়েছে।
* ১৯৮৬ সালের উন্নয়নে অংশগ্রহণের অধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণা। এতে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং এ থেকে সুফল লাভের অবিসংবাদিত অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে।
* শিশু-অধিকার-সম্পর্কিত ১৯৮৯ সালের কনভেনশন। এতে বিভিন্ন দলিলপত্রে বিক্ষিপ্ত শিশু-অধিকারের বিষয়গুলো একত্রে সন্নিবেশ করে একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি বিশ্বের সবচাইতে বেশি দেশ অনুমোদিত একটি দলিল। ১৯৯৫-এর জুন পর্যন্ত পৃথিবীর ১৭৫টি দেশ এই শিশু-অধিকার কনভেনশন অনুমোদন করেছে এবং চুক্তিটি প্রায় সর্বজনীন অনুমোদন লাভ করতে যাচ্ছে।
* জাতীয়, উপজাতীয়, ধর্মীয় ও ভাষাভাষী গোষ্ঠীর সংখ্যালঘুদের অধিকারবিষয়ক ১৯৯২ সালের ঘোষণা। এই ঘোষণায় তাদের নিজস্ব ধর্মচর্চা, নিজভাষায় কথা বলা, নিজগোষ্ঠীর অন্যান্যের সাথে সংযোগ রক্ষা, নিজ দেশসহ যে-কোনো দেশত্যাগ এবং সে-দেশে ফিরে আসার অধিকার স্বীকৃত ও ঘোষিত হয়েছে।
.
.
:: মানবাধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের ভূমিকা ও পদ্ধতি
মানবাধিকার উন্নয়নে জাতিসংঘের ভূমিকা ও এর তৎপরতার পরিধি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে যে জনগণের নামে জাতিসংঘের সনদ উৎসর্গীকৃত, সেই জনগণের সার্বিক অধিকার সমুন্নত রাখাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। জাতিসংঘ যেসব পদ্ধতিতে মানবাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াস পাচ্ছে, এখানে তার কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হল :
* বিশ্ববিবেক হিসেবে-জাতিসংঘ বিভিন্ন জাতির মানবাধিকার বিষয়ক আচরণের সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য মান তুলে ধরেছে এবং ঐ মানের প্রতি হুমকিস্বরূপ আচার-আচরণের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগ নিবদ্ধ রাখার প্রক্রিয়া বিন্যাস করেছে।
* আইনপ্রণেতা হিসেবে-জাতিসংঘের তৎপরতায় মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের সমাবেশ ঘটানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শ্রমিক, মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী, গণহত্যা, বর্ণবৈষম্য এবং নির্যাতনবিরোধী আইনসমূহ আন্তর্জাতিক আইনের চৌহদ্দিতে স্থান পেয়েছে।
* পর্যবেক্ষক হিসেবে-মানবাধিকারের শুধুমাত্র সংজ্ঞাই নির্ধারিত হয়নি, বরং তার বাস্তবায়নও অগ্রসর হয়ে চলেছে, এ ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ পরিচালনায় জাতিসংঘের বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রসমূহ মানবাধিকার সংরক্ষণে কী ভূমিকা পালন করছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এ-ব্যাপারে তদন্ত অনুষ্ঠানের এখতিয়ার রয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এ-সম্পর্কে তদন্ত অনুষ্ঠানের নিজস্ব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের ভাষ্য খুব কম দেশই অগ্রাহ্য করা সমীচীন বলে মনে করে।
* তথ্যানুসন্ধানী হিসেবে-শুরুতে মানবাধিকার কমিশনের কোনো দেশে মানবাধিকারের বড়রকম বরখেলাফ হলে সেখানে তদন্ত অনুষ্ঠানের যে ম্যান্ডেট ছিল, তা নতুন কিছু দায়িত্বের সমন্বয়ে আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। এসব দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে মানবাধিকারের লঙ্ঘন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও সংকলিত করা। প্রয়োজনবোধে কমিশনের প্রতিনিধিগণ সরজমিনে তদন্ত করেন এবং কীভাবে তার নিরসন সম্ভব হতে পারে, সে-ব্যাপারে সুপারিশ পেশ করেন।
* প্রচ্ছন্ন কূটনীতিক হিসেবে-কোনো দেশকর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় তদন্তের জন্য মানবাধিকার কমিশন জাতিসংঘের মহাসচিব অথবা তাঁর প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাতে পারেন। এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অনেক সময় বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠানো হয় অথবা মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ হাইকমিশনার কৌশলে এটি সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে উত্থাপন করেন।
* সার্বিক সমন্বয়সাধকরূপে এই তৎপরতা আরো জোরদার করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের পদ সৃষ্টি করেছে। চার বছর মেয়াদি এই পদাধিকারীর পদটি সৃষ্টি করা হয়েছে ১৯৯৩ সালে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কেন্দ্রের কর্মতৎপরতার তত্ত্বাবধান তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তিনি জাতিসংঘের পক্ষে যে-কোনো সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন।
* উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষকরূপে-জাতিসংঘের মানবাধিকার কেন্দ্র কোনো দেশ তার মানবাধিকার তৎপরতার উন্নয়নসাধনে শলাপরামর্শ চাইলে তা দিয়ে থাকে। দেশের সংবিধান প্রণয়ন, নির্বাচনী আইনের উৎকর্ষসাধন, মানবাধিকার সংগঠন প্রতিষ্ঠা বা তার উন্নয়নসাধন, নয়া দন্ডবিধি আইনের খসড়া প্রণয়ন অথবা বিচারব্যবস্থার সংস্কারে সহায়তা করে এই সাহায্য দেয়া হয়।
.
.
:: প্রথম মানবাধিকার সম্মেলন
সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ গৃহীত হওয়ায় ২০তম বার্ষিকীথ১৯৬৪ সালকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বর্ষ হিসাবে উদ্যাপন করা হয়। এ বছরের কর্মকান্ডের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ইরানের তেহরানে প্রথম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠান। মানবাধিকার-সম্পর্কিত এটি হচ্ছে বিশ্ব-সরকারসমূহের প্রথম সম্মেলন। এই সম্মেলনের সুপারিশের সূত্র ধরেই ১৯৭১ সাল বর্ণবৈষম্যবাদ ও বর্ণবৈষম্য নিরসনের কর্মবর্ষ হিসেবে উদ্যাপিত হয়।
.
.
:: মানবাধিকারবিষয়ক বিশ্বসম্মেলন
১৯৬৮ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের পর বিশ্বমানবাধিকার সম্মেলন হচ্ছে মানবাধিকার পর্যালোচনামূলক প্রথম বিশ্বসম্মেলন। ১৯৯৩ সালের ১৪ থেকে ২৫ জুন ভিয়েনার এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নজিরবিহীন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিদল যোগদান করে। ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা গ্রহণের পর বিশ্বব্যাপী এক্ষেত্রে কী অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, ভিয়েনা সম্মেলনে তা পর্যালোচনা করা হয় এবং প্রতিবন্ধক ক্ষেত্রগুলো শনাক্ত ও তার প্রতিকারের পন্থা নির্ধারণ করা হয়। ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণায় উল্লেখ করা হয় যে, গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং মৌলিক স্বাধীনতা পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য এবং একে অন্যের সম্পূরক ও পরিপূরক। জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব বুট্রোস বুট্রোস ঘালি ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, ‘এটি একটি নিশ্চিত বিষয় যে, গণতন্ত্রের উন্নয়নসাধন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় আর সেজন্যেই মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অপরিহার্য।’
.
.
:: নারীপ্রগতি সাধন
ছয় দশকেরও বেশিদিন আগে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে নারীর প্রগতি সাধন এই সংস্থার কর্মতৎপরতায় অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। সর্বজনীন নারী-অধিকার অর্জন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নারীসমাজের সমঅধিকার অর্জনের উদ্যোগপ্রয়াসে জাতিসংঘ বিরাট এক সহায়ক শক্তি হিসেবে বরাবর সক্রিয় রয়েছে। জাতিসংঘের ধারাবাহিক বিশ্বসম্মেলন যথা শিক্ষা, শিশু, পরিবেশ, মানবাধিকার, জনসংখ্যা এবং সামাজিক উন্নয়ন শীর্ষক সম্মেলনের সূত্র ধরে ১৯৯৫ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বেইজিং-এ বিশ্বনারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সবকটি সম্মেলনে বিশেষ করে বেইজিং সম্মেলনে সমাজ ও উন্নয়নে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়। মানবাধিকার সম্পর্কিত বিশ্বসম্মেলনে এ-ব্যাপারে বিশেষ এক গ্রন্থি উন্মোচিত হয়। এতে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয় যে, ‘মানবাধিকারের অর্থ নারীর অধিকারও বটে’। সম্মেলনে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নারীর অধিকার প্রসঙ্গটি সমন্বিত করারও আহবান জানানো হয়। সনাতন আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি যাতে নারীর অধিকার-অর্জনে কোনোরূপ প্রতিবন্ধক না হয়, সে-ব্যাপারে ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্যও সম্মেলনে প্রস্তাব রাখা হয়। নারী-অধিকার ছাড়াও শিশু, প্রতিবন্ধী এবং আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণেও জাতিসংঘ সুস্পষ্ট বক্তব্য ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
.
.
:: উপসংহার
যদিও বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত এখনো বিরল নয়, তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মূলত জাতিসংঘের বদৌলতে ঐ সমস্ত লঙ্ঘন বিশ্বসমাজের কাছে তুলে ধরার মতো সংগঠন ও পদ্ধতি এখন বিদ্যমান রয়েছেথযেমনি বিদ্যমান রয়েছে শিক্ষা এবং অবহিতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তোলার ঐকান্তিক প্রয়াস। মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মান মেনে নেয়ার ব্যাপারে এখন ইচ্ছা ও আগ্রহ অতীতের যে-কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি।
.
মানবাধিকারের প্রতি জাতিসংঘের শ্রদ্ধাবোধের বদৌলতে এখন এসব অধিকারকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রগতি এবং উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও বিশ্বের সর্বত্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জসমূহের মোকাবেলায় জাতিসংঘ ও এর সদস্যরাষ্ট্রসমূহকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
0 responses on "লিখিত প্রস্তুতি : আন্তর্জার্তিক বিষয়াবলি + বাংলাদেশ বিষয়াবলি"