
এলিনা বারিলুন্ড শেরউইথের চাওয়া খুব বেশি নয়। এই বিজ্ঞানীর আশা, ‘প্রতিটি গর্ভধারণই নিয়ে আসুক আনন্দ।’ অর্থাৎ প্রতিটি গর্ভধারণই হোক পরিকল্পিত। অপরিকল্পিতভাবে কোনো প্রাণ যেন ধরণিতে না আসে, আর কোনো ভ্রূণ-হত্যা যেন দেখতে না হয় পৃথিবীকে, এ উদ্দেশ্যেই কাজ করছেন এই পরমাণুবিজ্ঞানী (নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট)। যে কারণে সৃষ্টি হয়েছে ‘ন্যাচারাল সাইকেলস’, এমন এক মোবাইল অ্যাপ, যেটি জন্মনিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে ব্যবহারকারীদের।
হাস্যকর ঠেকতে পারে। জন্মনিয়ন্ত্রণের মতো সম্পূর্ণ শারীরিক একটা বিষয়ে কীভাবে ভূমিকা রাখবে একটি মুঠোফোনের অ্যাপ্লিকেশন! গাণিতিক অ্যালগরিদমের পক্ষে সম্ভব প্রকৃতির সবচেয়ে রহস্যাবৃত, আদিম এক প্রক্রিয়ায় বাদ সাধতে? সম্ভব! এলিনা সেটাই করে দেখিয়েছেন!
শুধু করে দেখিয়েছেন বললে ভুল হবে, অন্যদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এক অপার সম্ভাবনা। ২০১৪ সালে বের হওয়ার পর থেকে তিন লাখের বেশি নারী ব্যবহার করছেন ন্যাচারাল সাইকেলস। বার্ষিক ৫০ পাউন্ডের (৫২০০ টাকা) বিনিময়ে একজন নারী ব্যবহার করছেন ন্যাচারাল সাইকেলস, যেটি তাঁকে নির্ভুলভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করছে। দুই বছরে ৬ মিলিয়ন ডলার আয়ের অঙ্কটাও বলছে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ অ্যাপ!
সবই শুরু হয়েছিল একটি শখ থেকে। ‘ঈশ্বর কণা’র অস্তিত্ব খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন এলিনা। ‘হিগস বোসন’ কণা, যার অস্তিত্বের প্রমাণ পদার্থবিজ্ঞানকে অন্য উচ্চতায় তুলে দিয়েছে, মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করেছে, সার্নের (সিইআরএন) সেই বিজ্ঞানীদের দলে ছিলেন এলিনা। কিন্তু টানা ব্যর্থতায় ক্লান্ত এলিনা অন্য কিছু করতে চাইছিলেন। তাঁর স্বামী রাউল শেরউইথও উৎসাহ দিলেন পদার্থবিজ্ঞানের এই কঠিন সমীকরণের বাইরে অন্য কোনো কিছু নিয়ে কাজ করতে। নিজেও পদার্থবিজ্ঞানী বলে রাউলও বুঝতে পারছিলেন, মনোযোগটা আপাতত অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া দরকার। তাতে মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি মিলবে।
ব্যক্তিগত কারণেও এলিনা চাইছিলেন জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করতে। একে প্রচলিত সব নিরোধব্যবস্থায় বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন তিনি। দুজনই গবেষণায় এত ব্যস্ত ছিলেন যে সন্তান নেওয়ার চিন্তা মাথায় আনতে পারছিলেন না। সে সময়ের কথা বিবিসিকে বলেন এলিনা, ‘অন্য নারীদের মতো বিভিন্ন নিরোধ ব্যবহার করেছি কিন্তু কোনোটাই আমার জন্য সঠিক মনে হয়নি। বিকল্প খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম, শরীরের তাপমাত্রা বলে দেয় আপনি গর্ভধারণ করতে উপযুক্ত কি না (ফার্টাইল)। আমার জন্য এটা ছিল নতুন পথের সন্ধান।’
এই একটি তথ্যই ভিত্তি হয়ে উঠল তাঁর অ্যাপের।
অ্যাপ জানিয়ে দিচ্ছে আজকের কর্তব্য। ছবি: ন্যাচারাল সাইকেলস।‘ন্যাচারাল সাইকেলস’-এর ব্যবহারবিধি খুব সহজ। অ্যাপটি নারীদের জন্য। ঘুম থেকে উঠেই একটি ব্যাসাল থার্মোমিটার (দশমিকের দুই ঘর পর্যন্ত মাপা যায় এতে) দিয়ে দেহের তাপমাত্রা মেপে নিয়ে সেটা অ্যাপে লিখবেন ব্যবহারকারী নারী। অ্যাপ সেটি পরিমাপ করে জানিয়ে দেবে, তিনি আজকের জন্য নিরাপদ কি না। যদি লাল চিহ্ন দেখায়, এর মানে তিনি সেদিন গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত। অর্থাৎ, সেদিন শারীরিক সম্পর্কে নিরোধ ব্যবহার করতে হবে। আর যদি সবুজ দেখায়, তবে নিরোধের ঝামেলায় আর যেতে হবে না। এভাবেই এটি কাজ করবে জন্মনিয়ন্ত্রণে।
এটি দিয়ে গর্ভধারণের উপযুক্ত সময় জেনে নিজেকে সে অনুযায়ী প্রস্তুত করা যায় শুধু। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্য সাশ্রয়ী পদ্ধতি খাওয়ার বড়ির (পিল) তুলনায় এটি ব্যবহার করা সহজ। কারণ পিল প্রতিদিন গ্রহণ করতে হয়, এ পিলগুলোর মাত্রার কারণে শারীরিক অসুবিধায় পড়তে হয় অনেককে। আর নারীদের জন্য প্রচলিত অন্য পদ্ধতিগুলো (ইন্ট্রামাসকুলার শট, ভ্যাজাইনাল রিং কিংবা আইইউডি) দীর্ঘমেয়াদি হলেও ব্যবহারকারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অস্বস্তি বোধ করেন।
এ কারণেই ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো কোনো অ্যাপ নিরোধ হিসেবে ব্যবহারের স্বীকৃতি পেয়েছে। আপাতত যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্যই সনদ জুটলেও ১৬০টি দেশের নারী এটি ব্যবহার করার আগ্রহ জানিয়েছে। এলিনা তাই নিজের কাজকে আরও এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন, ‘প্রথমে যেটি আশা করেছি, এর চেয়েও অনেক বেশি দূর এসেছি। কিন্তু আমাদের এখানে থামলে চলবে না।’
থার্মোমিটারের এই ছোট তথ্যই জীবন পালটে দিচ্ছে। ছবি: ন্যাচারাল সাইকেলস।এলিনার আশা শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ নয়, তাঁর ন্যাচারাল সাইকেলস দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে গর্ভধারণও করবেন ব্যবহারকারীরা। আপাতত এ নিয়েই কাজ করছেন তিনি।
আরো পড়ুন: