ডাচবাংলা ব্যাংকের উপবৃত্তি বিতরণে ব্যর্থতা।
ডাচবাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং রকেটের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে উপবৃত্তি বিতরণে ব্যর্থতা, পদ্ধতিগত ত্রুটি ও নানা অনিয়ম স্বচক্ষে দেখেছেন মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্পের পরিচালক শরীফ মোর্তজা মামুন। রকেটের কারিগরি ব্যর্থতা ও উপবৃত্তি বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দুর্নীতির মনোভাবের কারণে গত দুই বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থী উপবৃত্তিবঞ্চিত হয়েছে। ফলে ছাত্রীদের বাল্যবিয়ে ও ঝরে পড়া ঠেকাতে উপবৃত্তি দেয়ার উদ্দেশ্যই ব্যহত হচ্ছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এই উপবৃত্তি প্রকল্পটি চলছে। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা যায়, রকেটের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণের নানা অনিয়ম ও ব্যর্থতা স্বচক্ষে দেখে কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেন প্রকল্প পরিচালক শরীফ মামুনসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। কিন্তু প্রতিকারমূলক কোনো নির্দেশই আমলে নেননি সংশ্লিষ্টরা। গত ছয়মাসে প্রকল্প পরিচালক শরীফ মামুন দেশের বিভিন্ন উপজেলার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে স্বচক্ষে কয়েকটি অনিয়ম ও উপবৃত্তি বিতরণে রকেটের সমস্যা প্রত্যক্ষ করেছেন।
পরিদর্শনশেষে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো: মাহবুবুর রহমানের কাছে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন। প্রকল্প পরিচালকের লেখা কয়েকটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছে এই প্রতিবেদক। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার রেংগা হাজীগঞ্জ স্কুল এন্ড কলেজ, রেবতীরমন দ্বিপাক্ষিক উচ্চবিদ্যালয় ও রাজ চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় পরিদর্শন করেন শরীফ মামুন। পরিদর্শনের ২২ দিন পর অর্থাৎ চলতি বছরের ২ জানুয়ারি মহাপরিচালকের কাছে জমা দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ষ্ঠ, ৭ম ও নবম শ্রেণির শতাধিক শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়নি। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সত্যব্রত রায়ের কাছে উপবৃত্তি না পাওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়। ডাচবাংলা ব্যাংকের ১২ জানুয়ারি একটি চিঠিতে সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ২৫৯ জন শিক্ষার্থীর তিন লাখ তেইশ হাজার ৪৬০ টাকা অবিতরণ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ না করে দুই বছরের বেশি সময় যাবত এই টাকা ডাচবাংলার তহবিলে জমা রাখা হয়েছে। অবিতরণকৃত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার বিধান থাকলেও তা মানেনি রকেট তথা ডাচবাংলা।
আজ ৯ মে শরীফ মামুনের কাছে জানতে চাওয়া হয় উপবৃত্তি না পাওয়ার কোনো ব্যাখ্যা দক্ষিণ সুরমার উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তাঁকে [প্রকল্প পরিচালক] দিয়েছেন কি-না? জবাবে তিনি বলেন, ওদেরকে তো বলেছিলাম দেয়ার জন্য কিন্তু অদ্যাবধি দিয়েছে কিনা সেই খোঁজ নেয়া হয়নি। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ও কয়েকটি স্কুল সরেজমিন পরিদর্শন করে ১৮ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে জমা দেয়া পরিদর্শন প্রতিবেদনে শরীফ মামুন বলেন, কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী মোবাইলে মেসেজ পায়নি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানাতে বলা হয়। প্রকল্প পরিচালক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর ঢাকার দোহার উপজেলার ইকরাশি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ও নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা কোকিলপেরি উচ্চবিদ্যালয়ে মোবাইল ফোনে উপবৃত্তি বিতরণ হয়। প্রকল্প পরিচালকের অনুরোধে্ ঐদিন ডাচবাংলা ব্যাংক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে উপবৃত্তি বিতরণ করে। মোবাইল ফোনসহ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত স্কুলে উপস্থিত ছিলো। প্রকল্প পরিচালক তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে দেখতে পান অনেক শিক্ষার্থীর মোবাইলে মেসেজই যায়নি। তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিলেও অদ্যাবধি ৩৮৮ শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা পায়নি বলে অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছে। মোট অবিতরণকৃত টাকার পরিমান ৪ লাখ ১২ হাজার ৮০০।
২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার ফুলতলা রি-ইউনিয়ন স্কুল এন্ড কলেজ এবং আলকা মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন শরীফ মামুন। উপস্থিত অভিভাবকদের মোবাইল চেক করে তিনি দেখেন যে, অনেক শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা পায়না কিন্তু বিষয়টি যাচাই করে দেখেন না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। এই উপজেলার ১২৮ জন শিক্ষার্থীর ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ডাচাবাংলার অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে। চলতি বছরের ৭ এপ্রিল ঝালকাঠী সদর উপজেলার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে মোবাইল ফোনে উপবৃত্তি বিতরণে অনিয়ম চিহ্নিত করেন তিনি। উপবৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীরা পেল কি-না তা যাচাই করে দেখেন না প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। ৬ মে মহাপরিচালকের কাছে জমা দেয়া প্রতিবেদনে প্রকল্প পরিচালক এসব তথ্য উল্লেখ করেন। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি যশোরের অভয়নগর উপজেলার উপবৃত্তি বিতরণ পরিদর্শনকালে প্রকল্প পরিচালক দেখতে পান প্রায় ৫০ জন অভিভাবকের মোবাইল ফোন চেক করে দেখতে পান যে উপবৃত্তির টাকা পৌঁছায়নি। উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার, কয়েকজন প্রধান শিক্ষককে উপবৃত্তির টাকা বিতরণ নিশ্চিত করতে যথারীতি কঠোর নির্দেশ দেন পরিচালক। নির্দেশ পালনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
আরো পড়ুন:
ডাচবাংলা ব্যাংকের বিরুদ্ধে ৮৮ হাজার শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা গোপন রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে
গোপন রাখা সেই উপবৃত্তির টাকা ১৬ মে’র মধ্যে বিতরণের নির্দেশ ডাচবাংলা ব্যাংকের
0 responses on "ডাচবাংলা ব্যাংকের উপবৃত্তি বিতরণে ব্যর্থতা"