জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম, কলেজ র্যাংকিংয়ের নামে দুর্নীতি, ফলাফল কেলেঙ্কারিসহ কয়েকডজন অভিযোগ তদন্ত করতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতি চালু আছে। দুই পরীক্ষকের মধ্যে ২০ নম্বরের বেশি হলে তৃতীয় পরীক্ষক দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু ক্র্যাশ প্রোগ্রামের নামে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একক পদ্ধতি চালু করা হয়েছে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। এতে ২৫০-৩০০ খাতা মূল্যায়নে জন্য একজন পরীক্ষককে সময় দেয়া হয় ১০-১২ দিন। এভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সবাইকে পরীক্ষার্থী বানিয়ে ফেলেছে। আর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে সেশন জট কমানোর।
২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কেনাকাটা, ফলাফল জালিয়াতির তদন্ত রিপোর্ট, নিয়োগ, অনুষ্ঠানের খরচ, বোনাস ও সিটিং অ্যালাউন্স ভাউচার, অনার্স, মাস্টার্স কোর্স চালু ও কলেজ র্যাংকিং নীতিমালাসহ আরও অনেক তথ্য চেয়েছে দুদক। ১২ ক্যাটাগরিতে চাওয়া প্রায় শতাধিক তথ্য কার্টন ভর্তি করে ইতোমধ্যে দুদকের কাছে জমা দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম, শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সরকারের রাজস্ব ক্ষতির প্রমাণ পায় রাজস্ব হিসাব নিরীক্ষা অধিদপ্তর। সরকারের বার্ষিক অডিটে ধরা পড়ে ১০৪ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি, অনিয়ম ও হিসাবের গরমিল। অডিট রিপোর্টে আপত্তি তোলা হয়েছে অন্তত ৪১টি আর্থিক খাতে।
যেখানে ভিসিসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের ক্যাম্পাসের বাইরে বাড়ি ভাড়া, অতিরিক্ত গাড়ির জ্বালানি খরচ, ক্যাম্পাসবহির্ভূত স্থানে গবেষণা কেন্দ্রের ব্যয়, ভূমি রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত আর্থিক ক্ষতি, আইন লঙ্ঘন করে গাড়ি কেনা, অনিয়ম, জমির অনিয়মিত নামজারিতে অস্বাভাবিক অর্থ ব্যয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আপত্তি তোলা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ৭ই জানুয়ারি দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এসব তথ্য চাওয়া হয়। আর দুদকের সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান টিমের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ১লা ফেব্রুয়ারি কয়েকটি কার্টন ভর্তি করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুদকে তথ্য দিয়েছে।
অপরদিকে গত ডিসেম্বর মাসে ১০৪ কোটি টাকার অডিট আপত্তির তদন্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি টিম। কমিশনের সদস্য প্রফেসর শাহনেওয়াজ আলীর নেতৃত্বে এই টিম ইউজিসি’র চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। ইউজিসি’র চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তদন্ত প্রতিবেদন আমার কাছে জমা পড়েছে। কিন্তু সেখানে কী আছে তা বলা যাবে না।
দুদকের কাছে দেয়া অভিযোগের মধ্যে আছে, প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা না মানা, ফলাফল কেলেঙ্কারি, বিভিন্ন ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় পুকুরচুরি, ধানমন্ডিতে বাড়ি কেনায় অনিয়ম, বিভিন্ন সিটিং অ্যালাউন্স, বোনাসের অর্থ অপচয়, বিভিন্ন কমিটি, উপ-কমিটির জন্য ব্যয়কৃত অর্থের হিসাবে গরমিল, কলেজ র্যাংকিং, অনার্স-মাস্টার্স কোস খোলার নামে বাণিজ্য।
দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সব ধরণের কেনাকাটা, ভবন নির্মাণসহ আর্থিক সংশ্লিষ্ট সব ধরণের তথ্য নেয়া হবে। সেখান থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সামনে এনে তদন্তে নামবে সংস্থাটি। এসব অভিযোগ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক অডিটে ১০৪ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি, অনিয়ম ও হিসাবের গরমিল পাওয়ার সরকারি অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনটি আমলে নিবে দুদক।
দুদকে আসা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ধানমন্ডিতে প্রায় ১০০ কোটি টাকায় কেনা বাড়ি নিয়ে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। বাড়িটি প্রথমে ৭০ কোটি টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত হলেও ভিসি’র নিকটাত্মীয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার এবং প্রকৌশল দপ্তরের পরিচালক মিলে সেটি ৯০ কোটি টাকায় দলিল করেন। সেখান থেকে বড় অংকের একটি কমিশন চলে যায় সংশ্লিষ্টদের পকেটে। রেজিস্ট্রি বাবদ ৫ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি করা হয় ২৫ লাখ টাকায়। এছাড়াও এই বাড়িতে চারতলায় উঠার জন্য বাড়ির ডিজাইনের বাইরে নতুন করে ক্যাপসুল টাইপের লিফট বসানো হয়। এই লিফটের বাজার মূল্য ২৫ লাখ টাকা হলেও খরচ দেখানো হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। বাড়ি সংস্কারের নামে বড় অংকের টাকা খরচ দেখানো হয়েছে যেটি অপচয় হিসেবে দেখছেন সরকারি অডিট বিভাগ। রাজধানীর আগারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের জায়গায় টুইন টাওয়ার নির্মাণের জন্য ১০ কোটি টাকায় কনসালটেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এই কনসালটেন্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি বর্তমানে ওআইসি পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মুনাজ আহমেদ নূরের সম্পর্কিত একটি ফার্মকে দিয়ে।
বোনাস ও সিটিং অ্যালাউন্সে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এসেছে দুদকের কাছে। সেখানে বলা হয়, অফিস সময়ে ভিসিসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা মিটিং করার নামে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত সিটিং অ্যালাউন্স নেন। দিনে গড়ে ৪টা পর্যন্ত মিটিং এ অ্যালাউন্স নেয়ার নজির আছে। মূনাজ আহমেদ থাকাকালীন এই প্র্যাকটিস শুরু হয় যেটি এখন চলছে। তাছাড়া অনুষ্ঠান-নির্ভর হয়ে পড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বাবদ খরচ, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের বরাদ্দ ভাউচার ও পরিশোধের সব কাগজপত্র দুদকের পক্ষ থেকে চাওয়া হয়েছে। দুদকের কাছে অভিযোগে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের ভাড়াবিহীন হলেও শুধু কমিশন খাওয়ার জন্য প্রতিবারই ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে বলে ভাউচার দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে তার বেশির ভাগ কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। বাকি কিছু তথ্য প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রাম থাকায় তারা সময় নিয়েছেন। আমাদের হাতে আসা তথ্যগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বাকি তথ্য পেলে এটা নিয়ে কাজ শুরু করবো।
সারাদেশে ৬টি আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণের বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি অভিযোগ উঠেছে। সেই আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণের তথ্য চাওয়া হয়েছে দুদকের পক্ষ থেকে। দুদকের কাছে অভিযোগে বলা হয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে ৩/৪ গুণ বেশি দেখিয়ে টাকা লোপাটের হিড়িক চলছে। ব্যান্ডউইথ কেনার নামে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, টিএন্ডটি থেকে ৪০ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ দিয়ে চলছিল। কিন্তু তৎকালীন একজন প্রো-ভিসি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ কেনা হয়। এটা কেনার পেছনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ডিজিটাল এবং অনলাইন কার্যক্রম জোরদারের কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি ১০০ ব্যন্ডউইথের ডাটার জন্য টিএন্ডটির মেইন সার্ভার দিয়ে ইন-আউট করে। এতে ৪০ ব্যান্ডউইথের বেশি খরচ হয় না। বাকিটা ব্যান্ডউইথ দিয়ে আইটি শাখার লোকজন বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে। কম্পিউার কেনাকাটা, ডাটা রিকভারি সেন্টার নির্মান, ইন্টিগ্রেটেড সফ্টওয়ার, ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স মেশিন, আর্চওয়ে ও সিসিটিভি, ইন্টারনেট ওয়াইফাই, লিফ্ট কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে। এসব জিনিসপত্র কেনাকাটায় সব ভাউচার চাওয়া হয়েছে দুদকের পক্ষ থেকে। অভিযোগে আরো বলা হয়, রাজধানীর ৭টি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলেও নানাভাবে অসহযোগিতা করার অভিযোগ ওঠে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র বিরুদ্ধে। তার অনুমতি ব্যতীত কোনো তথ্য ঢাবিকে না দেয়ার কথা বলা হয় সব শাখাকে।
সেশনজট দূর করতে নেয়া ক্র্যাশ প্রোগ্রামে দ্রুত সময়ে পরীক্ষা ও ফল প্রকাশের অন্তরালে চলে অন্য বাণিজ্য। এই ফল প্রকাশের বিভিন্ন সময় জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা খায় কর্মকর্তারা। দেশের বিভিন্ন কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালুর নামে টাকা খাওয়ার হিড়িক উঠেছে। ক্লাস না করেও টিউটোরিয়াল ২০ নম্বরের মধ্যে ১৮-১৯ নম্বর দেয়া হচ্ছে। এটির সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিন্ডিকেট জড়িত। কলেজ র্যাংকিং নামে নতুন পদ্ধতিতে প্রায় সব বড় কলেজগুলোতে নম্বর বেশি দেয়ার এক ধরনের অসৎ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যারা যত নম্বর বেশি দিবে তারাই র্যাংকিং-এ এগিয়ে থাকবে। এভাবে সিদ্ধেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ কয়েকটি নামহীন কলেজকে তালিকাভুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে। কলেজগুলো ওই তালিকা ভাঙ্গিয়ে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়, ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করে।
আরো পড়ুন:
0 responses on "জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম তদন্ত করতে মাঠে নেমেছে দুদক"