
কাঙ্খিত ফল পেয়েও এবার পছন্দের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন না অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনের চেয়েও অনেক বেশি মেধাবী শিক্ষার্থী থাকায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে বিত্তশালীদের অনেকে ছুটবেন বিদেশে। বাধ্য হয়ে অনেকে ভর্তি হবেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা ও কোচিং বাণিজ্য আরও রমরমা হবে। পাচার হয়ে যাবে মেধা।
এদিকে রাষ্ট্রপতির নির্দেশের পর এবারও সমন্বিত পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না। এজন্য শিক্ষার্থীদের ছুটতে হবে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। পড়তে হবে ভোগান্তিতে। গুনতে হবে অতিরিক্ত অর্থ। সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি না হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে ভিসিসহ শিক্ষকদের অতিরিক্ত উপার্জন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদের কাছে কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৫ পেশ করেন। এ সময় উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতি কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবের জন্য সমন্বিত পদ্ধতিতে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। এটি নিশ্চিত করে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেছিলেন, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে সমন্বিত পদ্ধতি প্রচলনের বিষয়ে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় ব্যক্ত করা মানেই নির্দেশ।
সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের জন্য ইউজিসি ১৬ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। এরপর মন্ত্রণালয় ভিসিদের নিয়ে একটি বৈঠকও ডেকেছিল। কিন্তু ওই বৈঠক স্থগিত করা হয়। বৈঠকের বিষয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈঠকের আগের দিন শিক্ষা সচিবকে ফোন করে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন বলে জানান। এরপর মন্ত্রীকে ফোন করলে তার শরীর খারাপের জন্য সভা স্থগিত করার এটি জানান। পরবর্তিতে বৈঠকের জন্য যোগাযোগ করা হলেও মন্ত্রী-সচিব কেউই আগ্রহ দেখাননি।
এর আগে গত ২ নভেম্বর ইউজিসি কর্তৃক অষ্টম ‘ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড’ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার দুর্ভোগ লাঘবে সমন্বিত পরীক্ষার প্রস্তাব করেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ওই সময়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা যে অবর্ণনীয় সমস্যা বিশেষ করে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার সমস্যায় পড়েছে, তা কল্পনাতীত। বিভিন্ন শহরে ছেলেমেয়েদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পাঠাতে অনেক অভিভাবকদের সামর্থ্য থাকে না। আবার সামর্থ্য থাকলেও এক দিনে এত সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভার নিতে বিভিন্ন শহরের অসামর্থ্যরে এটিও তুলে ধরেন তিনি। তাই উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে এই অবস্থার অবসান হওয়া একান্ত আবশ্যক। কেন্দ্রীয়ভাবে বা অঞ্চলভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারে বলেও মত দেন তিনি। এই বিষয়ে ইউজিসি ও শিক্ষামন্ত্রীর তৎপরতাও প্রত্যাশা করেন তিনি। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সেই নির্দেশনা বা প্রত্যাশা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে সাত বছর আগে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ) গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়ার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। সেটি এখন ইউজিসিতে ফাইলবন্দি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির তৎপরতা না থাকায় এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নেপথ্যের কারণ হিসেবে বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের অসহযোগিতা ও ভর্তিতে শিক্ষকের বাড়তি অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
ইউজিসি কর্মকর্তারা বলছেন, এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে একমাত্র বাধা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত কিছু শিক্ষকের লোভ। তারা এই জায়গা থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হন। ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে শুরু করে পরীক্ষা নেওয়া ও ফল প্রণয়ন এমনকি ভর্তি সম্পন্ন পর্যন্ত একটি ভিসির সমর্থনপুষ্ট একটি বিশেষ গ্রুপ জড়িত থাকেন। শুধু পরীক্ষা মৌসুমে ৭০ হাজার থেকে দেড় লাখ পর্যন্ত উপার্জন করেন তারা। এর বাইরে অবৈধ ভর্তির সিন্ডিকেট রয়েছে এখানে। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় আলাদা আলাদা কোচিং সেন্টারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জড়িত থাকেন। অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা হলে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে এমন শঙ্কায় তারা বাধা দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে এক ধরনের ভর্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস ওঠে। একজন শিক্ষার্থীকে পছন্দের বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক ক্ষেত্রেই গড়ে ১০ থেকে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে দেখা যায়। এতে করে ফরম কেনা, যাতায়াত, অবস্থানসহ নানাভাবে গড়ে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা প্রত্যেকের খরচ হয়। দেশের ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই গড়ে প্রায় তিন মাস ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে তাদের প্রচুর সময়, অর্থ, শ্রম দিতে হয়।
হেকেপের গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী, একই বৈশিষ্ট্যের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই গুচ্ছে এনে একটি পরীক্ষার আয়োজন করে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের তাতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। যেমন, যারা প্রকৌশল শিক্ষায় আগ্রহী তাদের জন্য বুয়েটসহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, যারা কৃষি শিক্ষায় আগ্রহী তাদের জন্য কৃষি, যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় আগ্রহী তাদের জন্য এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই গুচ্ছে এনে একটি অভিন্ন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেগুলো একই ধরনের, সেগুলোকে সাধারণ গুচ্ছে এনে একটি পরীক্ষার আয়োজন করা। এতে করে মাত্র চারটি পরীক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবে। ফলে ৩৪টি পরীক্ষায় যেমন আলাদা করে অংশ নিতে হবে না, তেমনি ৩৪টি আবেদনের জন্য আলাদা ফরম কেনার জন্য অর্থও ব্যয় করতে হবে না।
এদিকে এবারের এইচএসসি(HSC) বা উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে আট লাখ এক হাজার ৭১১ জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৭টি চালু রয়েছে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে আসন সংখ্যা ৪০ হাজার ৭২৭টি। এই হিসাবে জিপিএ-৫ পাওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থী আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ বঞ্চিত হবে। জিপিএ-৫ না পেলেও কাছা কাছি নম্বর পেয়েছেন প্রায় ২০ হাজার। এ ছাড়া গত বছর এইচএসসি(HSC) বা উচ্চ মাধ্যমিকতে জিপিএ-৫ প্রাপ্তসহ মেধাবী অনেক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়নি। এসব শিক্ষার্থীও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিবেন। এতে করে ভর্তিযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করবে। অনেক জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। তবে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য এরই মধ্যে লাখো শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংকটকে পুঁজি করে কোচিং সেন্টারগুলো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আসন সংখ্যা কোনো বাধা হবে না। পৃথিবীর কোথাও উচ্চশিক্ষা উন্মুক্ত নয়। পছন্দসই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অবশ্যই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংস্কার নিয়ে তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে বৈঠক করেন। তাতে ‘গুচ্ছ’ভিত্তিক ভর্তির প্রস্তাব দেন ভিসিদের। এরপর ২০০৯ সালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভিসিদের সঙ্গে বৈঠকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা নাকচ করে দেয়। এরপর ২০১০ সালে এটি নিয়ে ফের আলোচনা হলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক কমিটি এবং সিন্ডিকেটে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্তের কথা জানাতে সময় নেয়। একইভাবে ২০১১ এবং ২০১২ সালও কেটে যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়া না মেলায় ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ষষ্ঠবারের মতো ভিসিদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ফের বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দেয়। এরপর রাষ্ট্রপতির আগ্রহের পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভিসিদের নিয়ে বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত বৈঠক স্থগিত করা হয়।
আরো পড়ুন: