নতুন মোড় নিচ্ছে সিরীয় পরিস্থিতি!
মুহম্মদ রুহুল আমীন
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন। সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে জর্দান ও সৌদি আরবের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখানে আসার আগেই তিনি কথা বলেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভের সঙ্গে। জন কেরি আশা করছেন, সিরিয়ার পরিস্থিতি নতুন মোড় নিতে পারে। তার কিছু আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিতে সম্মত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সুরও কিছুটা নরম মনে হচ্ছে।
.
কয়েক বছর ধরে সিরিয়ায় অনুসৃত পাশ্চাত্য নীতির তালগোল পাকানো অবস্থা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের জবরদখলের লক্ষ্য ব্যর্থ হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো বাশারবিরোধী বিদ্রোহীদের সর্বমুখী সহায়তা দিয়ে বাশারকে উৎখাত করে তাদের তাঁবেদার গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ইরান ও রাশিয়ার মদদপুষ্ট সিরিয়ার লৌহমানব বাশার আল আসাদ পাশ্চাত্যের সে মহাপরিকল্পনা নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়েছেন। কয়েক দিন ধরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভা চলাকালে সংঘটিত আলাপ-আলোচনায় সিরীয় সংকট সমাধানের নতুন পরিকল্পনা আঁকা হচ্ছে। যাতে সবার অংশগ্রহণে সিরীয় সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
.
এ পরিপ্রেক্ষিতে এই নিবন্ধের মূল লক্ষ্য হলো সিরীয় সংকট সমাধানের লক্ষ্যে একটি মেগাপ্ল্যানের ধারণা তৈরি করা, যাতে আধিপত্যবাদ পরিহার করে কেবল কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়। প্রথমে আমরা বুঝতে চেষ্টা করব, কেন সিরিয়া সংকটটি এত ঘনীভূত হলো।
,
আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিক্ষার্থী হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, সিরীয় জনগণের স্বার্থে সিরীয় সংকট সমাধানে বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণের পরিবর্তে প্রবল ক্ষমতাধর কিছু পাশ্চাত্য রাষ্ট্র তাদের স্বার্থবিরোধী প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নগ্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সিরিয়ার জনগণের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করে কেবল দখলতত্ত্ব জিইয়ে রাখতেই বাশারকে উৎখাত করতে তারা তৎপর হয়। এমনকি সিরিয়ার প্রতিবেশী ও মৈত্রী রাষ্ট্র ইরান ও রাশিয়ার স্বার্থকেও পাশ কাটাতে চেষ্টা করে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিরীয় সংকট এতই জটিল হয়ে ওঠে, যার সমাধান করা হয়তো সম্ভব হবে না, এমন ধারণা জন্ম লাভ করে।
,
সিরিয়ায় কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে, তা শনাক্ত করা দুরূহ। কোনো যুদ্ধ বা দ্বন্দ্বে সাধারণত পরস্পরবিরোধী দুটি পক্ষ থাকে। কিন্তু সিরীয় সংকটে বহুপক্ষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো পক্ষগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও প্রকট। ফলে কোনো পক্ষ বা কোনো যোদ্ধা জানে না কোন পক্ষ বা কোন যোদ্ধার বুলেট তার বুক ঝাঁঝরা করে দিতে পারে।
,
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সিরিয়ানরা অস্ত্র তুলে নেয়। কিন্তু অচিরেই সেই বিদ্রোহীদের মধ্যে নানা মত, পথ ও ধারা গোচরীভূত হয়। তাদের কেউ আল-কায়েদার অনুসারী, কেউ তালেবানপন্থী, কেউ আবার সেক্যুলার, আবার কেউ তুর্কিপন্থী। সবাইকে চমকে দিয়ে আবির্ভূত হয় ইসলামী স্টেটের ভয়ংকর শক্তিশালী অ্যাগ্রেসিভ যোদ্ধারা। একদিকে এরা সবাই বাশারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে তারা পাশ্চাত্যের মিত্র। অন্যদিকে তারা পৃথকভাবে পাশ্চাত্যের দুশমন। তাহলে বাশারকে কি শুধু গদিচ্যুত করলেই পাশ্চাত্যের স্বার্থরক্ষা হবে? বাশারকে উৎখাত করা সম্ভব হলে বাশারবিরোধীরা শিগগিরই আরো অনেক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। প্রথমে তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়বে। এরপর শুরু হবে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে তাদের তৃতীয় পর্যায়ের সর্বাত্মক লড়াই। সেই ভয়ংকর যুদ্ধগুলোর পূর্বাভাস যখন মিলছে, তখন তা প্রতিহত করতে প্রয়োজন একটি বৃহৎ সিরীয় পরিকল্পনার। সেই মেগাপ্ল্যানের প্রকৃতি ও পরিধি কী হবে, তা জানা দরকার। আন্তর্জাতিক সমাজের প্রধান কর্তব্য হবে বিবদমান পক্ষগুলোর সবার প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়ার নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব তাদের এবং সে কারণে তাদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার সব উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
,
সিরীয় সংকট সমাধানে এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কারের ও সেই লক্ষ্যে বাশারসহ বিবদমান সব পক্ষকেই যত্নবান হতে হবে। বিবদমান পক্ষগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে বাশারবিরোধী কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেই সিরীয় সংকটের সমাধান হবে না। তাই আলোচনার টেবিলে বাশারের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি দরকার। যতটুকু জানা যায়, বাশার নিজেও সিরিয়ায় রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার সফল করতে হলে সিরিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী ইরান ও স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার রাশিয়ার ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা যাবে না। আশার কথা হলো জাতিসংঘের সাম্প্রতিক ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা করেছেন, ইরান বা রাশিয়া যেই হোক, সিরীয় সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র সবার সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
,
অর্থাৎ দেরিতে হলেও পাশ্চাত্য ও তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলো সিরীয় সংকট সমাধানে সবার অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। আগে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর ধারণা ছিল, এক ফুৎকারে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয় স্বার্থ জীবিত রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু সিরিয়া ইস্যুতে ইউরোপ এখন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর রয়টার্স ও যুক্তরাজ্যের সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকা জানিয়েছে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন স্বল্পমেয়াদে বাশারকে ক্ষমতায় থাকতে দেওয়ার পক্ষে। এ সময় সিরিয়ায় তাঁরা ঐকমত্যের সরকার গঠনে কাজ করতে আগ্রহী। বাশারের সঙ্গে সংলাপে না বসার মার্কিন নীতি থেকে ক্রমে সরে যাচ্ছে ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকরা। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলও বলেন, অনেক পক্ষের সঙ্গে কথা বলা উচিত, যার মধ্যে থাকবেন বাশার আল আসাদও। এরই মধ্যে জার্মানি এমন প্রস্তাবও দিয়েছে, যাতে সিরিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়।
,
সিরীয় সংকট সমাধানে যে বৈশ্বিক পরিকল্পনা উদীয়মান হচ্ছে, তার বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সমাজের দায়বদ্ধতা প্রচুর। বিশেষ করে পাশ্চাত্য বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্যবাদী নীতির কারণে সিরীয় সংকট ঘনীভূত হয়েছে। এ উপলব্ধি যখন সর্বত্র জেগে উঠেছে তখন সবার উচিত সিরীয় প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়েই ভূমিকা রাখা। সবার অংশগ্রহণে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সিরীয় সরকার গঠনে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর উচিত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সিরীয় সংকটের সমাধান হলে সিরিয়াসহ এ অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে, যেটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজন। তদুপরি ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের যে প্রীতি-সম্পর্কের যুগ উন্মোচিত হয়েছে তার স্থায়িত্বের স্বার্থেও সিরীয় সংকটের সমাধান জরুরি।
,
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২৮ অক্টোবর, ২০১৫ , ইত্তেফাক
আরো পড়ুন:
৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি , পার্ট – ৩
৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি , পার্ট – ৪
৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৫৪