৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি
.
আরব বসন্তের একটি চমৎকার মূল্যায়ন, আশা করি কাজে দেবে
আরব বসন্ত কি কেবলই রোদন ভরা
মু. আব্দুল্লাহ আল আমিন
২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিউনিসিয়ার রাজধানীর বাসিন্দারা সব বাড়ি থেকে রাজপথে নেমে এসেছিল। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন ঠিকমতো সংগঠিত হওয়ার আগেই ধুলোয় লুটিয়ে পড়লো দীর্ঘদিনের একনায়ক জাইন আল আবেদিন বেন আলীর তখতে তাউস । বিপ্লবের ঢেউ দ্রুত ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। যেটি পরে আরব বসন্ত নামে পরিচিতি অর্জন করে।
পাঁচ বছর পর, দেখা যাচ্ছে তিউনিসিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যে সব দেশ গণ অভ্যুত্থানের পথে হাঁটে আখেরে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। বরং জুটেছে গৃহযুদ্ধ, গোষ্ঠীসংঘাত, জিহাদী তত্পরতা। তাছাড়া ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো চরমপন্থিদের উত্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া অভিবাসী সঙ্কট পেয়েছে নতুন মাত্রা। আইওএমের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে ১০ লাখের ওপর অভিবাসী ইউরোপে পৌঁছেছে।
‘দিনগুলো ছিল উত্তেজনায় পরিপূর্ণ, গণতন্ত্র জ্বর ছড়িয়ে পড়ছিল সবখানে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য যে দেশে অনুপস্থিত, প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে খুবই দুর্বল সেখানে কি রাতারাতি গণতন্ত্র পুরোদমে চালু হতে বা মানুষের জীবনমান উন্নত হতে পারে ? স্পষ্টতই এর জবাব হলো না।’ বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিসরের হাফেজ গানিম আরব বসন্ত নিয়ে লেখা তার একটি বইতে এই কথাগুলো উল্লেখ করেছেন।
তিউনিসিয়ার রাজপথে শুরু হওয়া ওই গণআন্দোলনের কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই পতন ঘটে ২৩ বছর ক্ষমতায় থাকা একনায়ক বেন আলীর। তিউনিসিয়া থেকেই আরব বসন্তের সূত্রপাত ঘটে। তিউনিসিয়াই একমাত্র আরব দেশ যেখানে সবচেয়ে কম রক্তপাতের মাধ্যমে কিছুটা হলেও জনগণের আশা পূর্ণ হয়েছে। এই ঘটনার একমাস আগে চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত মোহাম্মদ বুআযিযি নামে রাস্তার একজন ফল বিক্রেতা সবার সামনে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মাহুতি দেন। প্রতীকী অর্থে নিজের শরীরে লাগানো এই আগুন মধ্যপ্রাচ্যের আনাচে কানাচে ধিকি ধিকি করে জ্বলছে।
তিউনিসিয়া কেবল আরব বসন্তের সুতিকাগারই নয় বরং দেশটি গণতন্ত্রে উত্তরণের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফলতা দেখাতে পেরেছে। যদিও দেশটি জঙ্গি হামলা থেকে একদম মুক্ত ছিল না। গত বছর বার্দো জাদুঘর ও ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্র সৈকতে হামলায় ৬০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নিহতদের বেশিভাগই ছিলেন বিদেশী পর্যটক। এসব সত্ত্বেও তিউনিসিয়ার অপেক্ষাকৃত সমুজ্জ্বল। দেশটিতে বর্তমানে একটি নির্বাচিত সরকার আছে। আছে চারটি গ্রুপের সমম্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় চতুর্পক্ষ। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী এ চতুর্পক্ষটি ইতোমধ্যে শান্তির জন্য জয় করেছে নোবেল পুরস্কার। তাছাড়া এই অঞ্চলের অন্যত্র গণআন্দোলনে বসন্ত আসা দূরে থাক কঠিন শীতকালই যেন ভাল করে জেঁকে বসেছে।
মিসরে গণআন্দোলন শুরুর মাত্র ১৮ দিনের মাথায় এক নায়ক হোসনি মোবারকের পতন ঘটে। এর ফলে দেশটিতে টানা ছয় দশকের সামরিক আধিপত্য বন্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু জনগণে সেই আশা ছিল যেন গুড়েবালি। ফের সামরিক বাহিনীরই শাসন ফিরে এসেছে। এর জন্য দেশটির ইসলামপন্থি ও ধর্ম নিরপেক্ষ উভয়পক্ষকেই দিতে হয়েছে চড়া মূল্য। বিশেষ করে ইসলামপন্থি দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে। মোবারকের পতনের পর দেশটির ইতিহাসে প্রথম অবাধ ভোটে নির্বাচিত ব্রাদারহুড সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাশাসক আবদেল ফাত্তাহ আসসিসি দলটিকে দমনের জন্য সম্ভব সবকিছুই করেন। ফলে সেনাবাহিনী বনাম জনগণ এবং ইসলামপন্থি ও ধর্ম নিরপেক্ষদের মধ্যে বিভাজন শুধুই বেড়েছে।
লিবিয়ায় গণআন্দোলন এবং এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ন্যাটো বিমান অভিযানে দেশটির শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন ২০১১ সালের অক্টোবরে। কিন্তু আজ অবধি দেশটিতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। গাদ্দাফি ৪২ বছর লৌহ কঠিন হাতে দেশটি শাসন করেন। বর্তমানে কার্যত ত্রিপোলি ও বেনগাজি ভিত্তিক দুটো প্রশাসন দেশ চালাচ্ছে। দক্ষিণের বিস্তীর্ণ এলাকা বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে লিবিয়ায় একটি ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বারবার হোঁচট খেয়েছে। গাদ্দাফির নিজ শহর সির্ত এখন আইএসের অন্যতম ঘাঁটি।
ইয়েমেনে বহু চড়াই উত্রাইয়ের পর বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন ৩২ বছর ধরে দেশ শাসনকারী আলী আব্দুল্লাহ সালেহ। ক্ষমতাসীন হন আবদ রাব্বো মানসুর হাদি। কিন্তু শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের সশস্ত্র আন্দোলনের মুখে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে সৌদি আরব হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করলে হাদি আবারও দেশে ফিরে এসে সরকার গঠন করেন। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। গত মার্চে শুরু হওয়া সৌদি সেনা অভিযান এখনও বন্ধ হয়নি। এতে এ পর্যন্ত ৬ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে। একে কেন্দ্র করে ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। এ মাসের গোড়ার দিকে শিয়া নেতা নিমর বাকের আল নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে।
আরব বসন্তের জন্য সিরিয়ার চেয়ে আর কোনো দেশের জনগণকে বেশি মাশুল দিতে হয়নি। আসাদ পরিবারের চার দশকের শাসনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের মার্চে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। আরব বসন্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিরিয়ার জনগণ এ লড়াই শুরু করেছিল। এতে এ পর্যন্ত দুই লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং ১০ লাখের বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আসাদ বিরোধীদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় আন্দোলন সফল হচ্ছে না বলে অনেকে মনে করেন। এর মধ্যে এখন যুক্ত হয়েছে আইএস বা আইসিস। ফলে আসাদ দেখাতে পারছেন তার এ যুদ্ধ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলো এখন আইএস নির্মূলের নামে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এ লড়াই শতাব্দীর প্রাচীন শিয়া-সুন্নি বিবাদকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। জন্ম দিয়েছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কটের।
গবেষণা সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক মাইকেল আয়ারির মতে, আরব বসন্ত অনেকটা বার্লিন প্রাচীর পতনের ঐতিহাসিক ঘটনার মতো। ওই ঘটনা ১৯৯০ এর দশকের ভূরাজনীতির মানচিত্র বদলে দিয়েছিল। তিনি মনে করেন, আরব বসন্ত যে প্রক্রিয়ার সূচনা করেছে তার জের কয়েক দশক ধরে চলবে। আবারও ফিরে আসি গানিমের কথায়। গত মাসে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন ‘দ্য অ্যারাব স্প্রিং ফাইভ ইয়ার্স লেটার:টুওয়ার্ড গ্রেটার ইনক্লুসিভনেস’ শীর্ষক যে বইটি প্রকাশ করেছে তাতে তিনি লেখেন,‘স্পষ্টতই আরব বসন্ত সহিংসতা ডেকে এনেছে। কিন্তু এটি যে ইতিবাচক পরিবর্তনও আনতে পারে এমন আশা করাটা খুব অবাস্তব হবে না। জনগণের আশা আকঙ্ক্ষার মূল্য দেয়া যে জরুরি আরব সরকারগুলো দেরিতে হলেও তা বুঝতে পারবে। চরম কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি বেশিদিন স্থায়ী হবে না। আরব বসন্ত কেবল একটি ঋতু নয়। এটি নতুন ধারার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দীর্ঘপথ পরিক্রমার প্রথম পদক্ষেপ।’
আরব বসন্ত সফল হোক, ন্যায়বিচার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাক
(দৈনিক ইত্তেফাক)১৭ জানুয়ারী, ২০১৬ ইং