ভাষাঃ
চর্যাপদের ভাষা বাংলা কি-না সে বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তীতে যার অবসান হয়েছে। এটি বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। চর্যাপদের রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সংস্কৃতে পারদর্শী হলেও তাঁরা তৎকালীন অপরিণত বাংলাতেই পদগুলি রচনা করেছিলেন। চর্যাপদের
ভাষা বাংলা ভাষার অদ্যাবধি আবিষ্কৃত আদিতম রূপ। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর “Origin and Development of the Bengali language” (ODBL) _ গ্রন্থে বলেছেন__ “বাংলা নিশ্চয়ই,বাংলার মূর্তি অবহটঠের সদ্যোনির্মোক মুক্ত রূপ”।
তবে ডঃ মুঃ শহীদুল্লাহ চর্যার ভাষাকে প্রাচীন বাংলা কিংবা প্রাচীন বঙ্গকামরুপী ভাষা বলাই সঙ্গত মনে করেন। ম্যাক্সমুলারের মতে “চর্যাপদের ভাষা হলো প্রচ্ছন্ন ভাষা”। নির্দিষ্ট কোন রুপ নাই বিধায় অনেকে চর্যার ভাষাকে সান্ধ্যাভাষা বা আলো আধারির ভাষা বলেছেন।
চর্যাপদ শুধু প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, প্রাচীন বাংলা গানেরও নিদর্শন। প্রতিটি পদের শুরুতে রাগ-তাল ও প্রতি জোড়-পদে ‘ধ্রুব’ শব্দের উল্লেখ থাকায় নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, এগুলি তখন গাওয়া হতো। এ ছাড়া পদগুলি থেকে তৎকালীন বাঙালি জীবনের আচার-আচরণ
ও সমাজের বাস্তবঘন পরিচয়ও পাওয়া যায়। যেমন তখনকার মানুষ হরিণ শিকার, নৌকা চালনা, চেঙারি তৈরি, শুঁড়ির কাজ ইত্যাদি করত। কাড়া-নাকাড়া ও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর-কনেকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হতো। সমাজে যৌতুক প্রথা প্রচলিত ছিল। গরু ছিল গৃহপালিত
পশু; হাতিরও উল্লেখ আছে। মেয়েরা পরিধানে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা এবং কর্ণে কুন্ডল পরত। টাঙ্গি, কুঠার, নখলি বা খন্তা ছিল উল্লেখযোগ্য অস্ত্র। তবে সমকালীন সমাজের এসব চিত্র অঙ্কন করলেও চর্যাকারেরা প্রধানত ছিলেন বৈরাগ্যপন্থি, জগৎমুখী ননড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহর মতে, প্রাচীনতম চর্যাকার শবরপা এবং আধুনিকতম চর্যাকার সরহ বা ভুসুকুপা
কাহ্নপা সর্বাধিক ১৩টি পদ রচনা করেন
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ লেখেন-ভুসুকুপা: ৮টি।
শবরপাকে চর্যাপদের বাঙালি কবি মনে করা হয়
চর্যাপদ মাত্রাবিত্ত ছন্দে রচিত
চর্যাপদ গ্রন্থে মোট কয়টি পদ পাওয়া গেছে-সাড়ে ছেচল্লিশটি (একটি পদের ছেঁড়া বা খন্ডিত অংশসহ)।
চর্যার পদগুলো সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষায় রচিত।
সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা-যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায় নি, যে ভাষার অর্থও একাধিক অর্থাৎ আলো-আঁধারের মত,সে ভাষাকে পন্ডিতগণ সন্ধ্যা বা সান্ধ্যভাষা বলেছেন।
চর্যাপদ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রথম পদটি লেখা-লুইপার।
চর্যাপদের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
নেপালের রয়েল লাইব্রেরি থেকে, ১৯০৭সালে চর্যাপদ আবিষ্কার করা হয়।
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে চর্যাপদ আধুনিক লিপিতে প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদনা করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০খ্রিস্টাব্দ থেকে, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পদগুলো রচিত। সুকুমার সেন সহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব পন্ডিতই সুনীতিকুমারকে সমর্থন করেন।
চর্যাপদের নাম নিয়ে প্রস্তাবগুলো -কারো মতে গ্রন্থটির নাম, ‘আশ্চর্যচর্যাচয়’, সুকুমার সেনের মতে ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়, আধুনিক পন্ডিতদের মতে এর নাম ‘চর্যাগীতিকোষ’ আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ‘চর্য্যার্চয্যবিনিশ্চয়’।
তবে ‘চর্যাপদ’ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাম।
চর্যার কবিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বলে মনে করা হয়-শবরপা (৬৮০ থেকে ৭৬০ খ্রিস্টাব্দ)।
চর্যাপদের সর্বাধিক পদরচয়িতা -কাহ্নপা।
চর্যাপদে যে পদগুলো পাওয়া যায় নি তার মধ্যে কাহ্নপার রচনা বলে মনে করা হয়-২৪ নং পদটি।
চর্যাপদে কাহ্নপা আর কি কি নাম পাওয়া যায়-কাহ্নু, কাহ্নি, কাহ্নিল, কৃষ্ণচর্য,কৃষ্ণবজ্রপাদ।
অনেকের মতে কুক্কুরীপা নারী ছিলেন।
কুক্কুরীপা রচিত অতিপরিচিত দুটি পংক্তি -দিবসহি বহূড়ী কাউহি ডর ভাই।রাতি ভইলে কামরু জাই। (পদ:২) (অর্থাৎদিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় কিন্তু রাত হলেইসে কামরূপ যায়।)
লুইপা ছিলেন-প্রবীণ বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদেরকবি।
তিববতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে লুইপা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে লুইপা রাঢ়অঞ্চলের লোক।
চর্যাপদের প্রথম পদটি রচনা লুইপার।
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল\ (পদ: ১) ( অর্থাৎ দেহগাছের মত, এর পাঁচটি ডাল। চঞ্চল মনে কালপ্রবেশ করে।)
লুইপা রচিত সংস্কৃতগ্রন্থের নাম পাওয়া যায়, – ৫টি। অভিসময় বিভঙ্গ, বজ্রস্বত্ব সাধন, বুদ্ধোদয়, ভগবদাভসার, তত্ত্ব সভাব।
শবরপা -তার জীবনকাল ৬৮০ থেকে ৭৬০খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। সেই সূত্রে শবরপা চর্যারকবিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। মুহুম্মদ শহীদুল্লাহর মতে তিনি ‘বাংলা দেশে’র লোক।
শবরপা গুরু ছিলেন-লুইপার।
ভূমিকাঃ
১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবে ধরা হয়। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি কতৃক নদীয়া বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ ছিল ধর্মকেন্দ্রিক।অর্থাৎ ধর্মীয় আবেশে মধ্যযুগে সাহিত্য রচনা হত।
আবার মুধ্যযুগের ১২০১-১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে ভাষাবিজ্ঞানীরা অন্ধকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।কারন এ যুগে রামাই “পণ্ডিত কতৃক” ‘শূন্যপুরাণ’ এবং হলায়ুধ মিশ্র কতৃক “সেক শুভোদয়া” ছাড়া তেমন কোন প্রধান সাহিত্য রচিত হয় নি।
সাহিত্যকর্মঃ
ধর্মকেন্দ্রিক সাহিত্যকর্মের এই যুগে মূলত দেব-দেবীর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়েছে,তবে মানুষের কথাও অস্বীকৃত হয় নি। সাহিত্য ছিল প্রধানত পদ্য ও গীতি নির্ভর। গদ্য সাহিত্য তখনও প্রসারিত ও পরিচিতি পায় নি।
অন্ধকার যুগ পরবর্তী মধ্যযুগের সাহিত্য কর্ম গুলোকে ভাষাবিদেরা দুটি ভাগে ভাগ করেছেন।তা হল-
১) মৌলিক সাহিত্যঃ
মৌলিক সাহিত্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন,বৈষ্ণব পদাবলী,মঙ্গল কাব্য।
২) অনুবাদ সাহিত্যঃ
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে রামায়ণ, মহাভারত, ভগবত ইত্যাদি।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যর প্রধান দুটি শাখা হল — ১.কাহিনীমূলক ও ২.গীতিমূলক।
মঙ্গল কাব্য
মঙ্গল কাব্যের কয়েকজন বিখ্যাত কবি- কানাহরি দত্ত, নারায়ন দেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, মাধব আচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী,ঘনরাম চক্রবর্তী, শ্রীশ্যাম পন্ডিত, ভরতচন্দ্র রায় গুনাকর, ক্ষেমানন্দ, কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ মাধব, আদি রূপরাম, মানিক রাম, ময়ূর ভট্ট, খেলারাম, রূপরাম, সীতারাম দাস, শ্যামপন্ডিত, দ্বিজ বংশী দাস, দ্বিজ প্রভারাম।
বিভিন্ন দেবদেবীর গুনগান মঙ্গল কাব্যর উপজীব্য। তন্মধ্যে স্ত্রী দেবীদের প্রধান্যই বেশী এবং মনসা ও চন্ডীই এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুররত্বপূর্ণ।
মঙ্গল কাব্য প্রধানত দু’প্রকার। যথা- (ক) পৌরাণিক মঙ্গল কাব্য ও (খ) লৌকিক মঙ্গল কাব্য।
পৌরাণিক মঙ্গল কাব্য -অন্নদামঙ্গল, কমলামঙ্গল, দূর্গামঙ্গল।
উল্লেখযোগ্য লৌকিক মঙ্গল কাব্য- মনসা মঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, কালিমঙ্গল, গৌরীমঙ্গল (বিদ্যাসুন্দরী), সারদামঙ্গল প্রভৃতি।
মনসামঙ্গল
সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম মঙ্গল কাব্য ধারা -মনসামঙ্গল
সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় মনসামঙ্গল কাহিনী চাঁদ সাগরের বিদ্রোহ ও বেহুলার সতীত্ব কাহিনী।
মনসামঙ্গল কাব্য দেবী মানসা’র কাহিনী নিয়ে রচিত
মনসামঙ্গলের উল্লেখযোগ্য চরিত্র- মনসাদেবী, চাঁদ সুন্দর, বেহুলা, লক্ষ্মীন্দর
আদি কবি কানা হরিদত্ত।
মনসা মঙ্গল কাব্য রচিত হয় সুলতান হুসেন শাহের সময়ে।
মনসামঙ্গলের অন্যতম কবি নারায়ন দেবের জন্মস্থান বর্তমান কিশোরগঞ্জ ও তাঁর কাব্যের নাম পদ্মপুরাণ
মনসামঙ্গলের অন্যতম কবি বিজয় গুপ্তের জন্ম স্থান বরিশাল জেলার বর্তমান গৈলা গ্রামে এবং প্রাচীন নাম ফুলশ্রী।
‘মনসা বিজয়’ কাব্যগ্রন্থের রচিয়তা বিপ্রদাস পিপিলাই, ১৪৯৫ সালে প্রকাশিত হয়।
এই লেকচারের পরের পেইজে যেতে নিচের …. তে ক্লিক কর।