ভূ রাজনীতি /অর্থনীতি
বিশ্বরাজনীতির নয়া মেরুকরণের সম্ভাবনা
মুহাম্মদ রুহুল আমীন
.
সংঘাত-সংঘর্ষময় ২০১৫ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এমন সুদূরপ্রসারী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যুক্ত করেছে, যার আন্তঃক্রিয়ার (interaction) উপর নির্ভর করছে ২০১৬ সালে নির্মীয়মাণ বিশ্বরাজনীতির রূপরেখা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর পৃথিবীর শান্তিকামী জনগণ জাতি-রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ শোষণ ও বৈশ্বিক প্রতারণার কারণে যুদ্ধোত্তরকালে নির্মিত শান্তির-সংগঠনগুলো থেকে তেমন উপকৃত হতে পারেনি। আফ্রো-এশিয়ার আরব এলাকায় সন্ত্রাস এবং প্রতি-সন্ত্রাসের আগুন জ্বলছে, সেই আগুনে পুড়ে যাওয়া মাটির নিচ থেকে শান্তির গন্ধও বের হচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে সম্ভাবনাময় এ বিশ্বশান্তিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে জায়গা করে দেয়াটা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
.
সংঘাত-সংঘর্ষময় ২০১৫ সালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা ইস্যু হলো আইএস উত্থান এবং আইএস বিরোধী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের বহুমুখী দমনাভিযান। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো মিত্ররা যে আইএসের বিরুদ্ধে এখন খড়গহস্ত, তারাই একসময় এ সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী করেছিলো। আফগান মুজাহিদদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একই নীতি অনুসরণ করে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য আল-কায়েদার নেটওয়ার্ক বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে হুমকি তৈরি করেছিল, তা পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের জন্য আন্তঃ তালাবদ্ধতার (Structural introlocking) পরিবেশ গড়ে তুলেছিল। পাশ্চাত্য-কর্তৃক গঠিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পুরো ন্যাটো জোটকে অভিযানে নামতে হয়েছিলো। বর্তমানের আইএসকে তাই তদানীন্তন আল-কায়েদার নীতি-কৌশলের সাথে তুলনা করা যায়। সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল আসাদকে হটাতে বাশার বিরোধীদেরকে এমন অসতর্কভাবে এবং ভ্রমনীতির অনুসরণ করে পাশ্চাত্য গড়ে তুলেছিলো, যারা পরবর্তীতে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে।
.
প্রথমদিকে বাশারকে উত্খাত করতেই পাশ্চাত্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আঞ্চলিক শক্তি ইরান এবং বিশ্বশক্তি রাশিয়ার গুরুত্বকে তখন খাটো করে দেখা হয়েছিল। এমনকি বাশারবিরোধীদের মধ্যে আইএসকে উত্খাতের জন্যও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একত্রে অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু তাতে বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার অবস্থানকে বিবেচনায় নিতে হয়। আইএস পাশ্চাত্যের জন্য আন্তঃতালাবদ্ধতার এমন জটিল জাল বিস্তার করেছে, যেটি থেকে মুক্তি পেতে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যে রাশিয়ার অংশগ্রহণ বৈশ্বিক উদ্যোগে অংশ নিয়েছে। আইএসকে হটাতে এখন বৈশ্বিক ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে, যেটি আইএস থেকে উত্সাহিত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ঝুঁকিকে স্তিমিত করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্লেষকগণের ধারণা।
.
আন্তর্জাতিক রাজনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো ইরান-পাশ্চাত্যের পারমাণবিক বিবাদ। বছরের পর বছর ধরে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রায়নকে ঘিরে ইরান-পাশ্চাত্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ধূমায়িত হচ্ছিল। ২০১৫ সালে সেই সংঘাত বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় উপনীত হয়। ইরানের চিরশত্রু ইসরাইল যেকোন সময় ইরান আক্রমণ করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা তছনছ করে দিতে পারে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অনেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরান-পাশ্চাত্যের পারমাণবিক দ্বন্দ্ব নিরসনের আশীর্বাদ নিয়ে এলো ২০১৫ সাল। পঞ্চশক্তিযোগ এক (P5Plus one) নামক যে ছয়টি বিশ্বশক্তিধর রাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, শেষ পর্যন্ত বিশ্বশান্তির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ পারমাণবিক ইস্যুটি সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিল।
.
বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের বৈরীসম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালে ইরান-পাশ্চাত্যের সম্পর্কে বরফ গলতে শরু করে। অনেক বিশ্লেষক ২০১৫ সালকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধুচন্দ্রিমার বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পারমাণবিক সমঝোতার পর ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্মিত শান্তিময় সম্পর্ক আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বিশ্বরাজনীতির জন্য অনেক ইতিবাচক অবদান রাখতে পারবে বলে অনুমান করা যায়। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে ২০১৬ সালে বিশ্বরাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমাধানের উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে ২০১৫ সালে নির্মিত ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাঝে।
,
বিশ্বরাজনীতির গতি পরিবর্তনে ২০১৫ সালে রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়ানো এবং পুতিনের ইউ-টার্ন ২০১৬ সালে বিশ্বশান্তি রক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারবে। গর্বাচেভের মুক্ততা (glastnost) এবং পুনঃগঠন (perestroika) নীতির ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলে একমেরু (unipolar) বিশ্বের ধারণা জন্মলাভ করে। জাপানি আমেরিকান ফুকুইয়ামার ইতিহাসের ইতি (end of history) তত্ত্ব যাঁরা জানেন, তাঁরা শিউরে উঠবেন কিভাবে তিনি একমেরু শাসিত পৃথিবীতে উদার গণতন্ত্রের ধারক যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আদর্শ পৃথিবীময় বিস্তৃতির কল্প-চিত্র অঙ্কন করেছেন। তিনি পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী বিজয়ী (triumphant ideology) বৈশিষ্ট্যে এমন বিশ্বাস করেন, যাতে তাঁর ধারণা পৃথিবীর সবাই এ মতাদর্শ গোগ্রাসে গিলবে। কিন্তু ২০১৫ সাল সেই একমেরু বিশ্বের ধারণা পাল্টে দিয়ে ২০১৬ সালে নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রই শেষ কথা নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকগণের অনেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথাও বলছেন। অর্থাত্ বিশ্ব এখন একমেরু নয়, বিশ্বে এখন বহুমেরু। বহুমেরুময় বিশ্বকে নতুন করে সাজাতে ২০১৬ নবতর সওগাত নিয়ে আগত।
.
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির রোমাঞ্চকর খবর হলো মিয়ানমারে গণতন্ত্র কন্যা অং সান সু চির গণতান্ত্রিক বিজয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর পিতা অং সান দেশটির গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার জন্য স্বীয় জীবন উত্সর্গ করলে তখন থেকে দেশটিতে সামরিক এবং ছায়া সামরিক শাসন চলতে থাকে। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বহ্নি জ্বালিয়ে রাখেন সু চি। দীর্ঘ কারাবরণের পর ২০১৫ সালের নির্বাচনে তার এন এল ডি শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ ভোট পেয়ে সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত হয়। ২০১৬ সালের সুবর্ণ সময়ে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক যাত্রা বিশ্বরাজনীতির জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণীর বছর হিসেবে বিবেচিত হবে।
.
উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, সংঘাত-সংঘর্ষময় বিশ্বরাজনীতি ২০১৫ সালে নতুন বৈশিষ্ট্যে আবির্ভূত হয়। শত সংঘাত-সংঘর্ষের মাঝেও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ঝুঁকি কমানোর বীজ রোপিত হয় ২০১৫ সালে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুসমূহ সমাধানের নতুন পথে পা রাখে ২০১৫ সালে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি নির্ধারক রাষ্ট্রসমূহ যদি এ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে ২০১৬ সাল থেকে সৃজনশীল ধারায় বিশ্বরাজনীতির নেতৃত্ব দিতে পারে, তাহলে ২০১৬ সাল বয়ে আনবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঞ্জীবনী বার্তা।
আরো পড়ুন:
৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি , পার্ট – ৫
৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৫৫