৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি
……….
ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকার প্রশ্নে উভয় সংকটে ব্রিটেন
==
‘রোম ঘোষণা’র মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলো নিয়ে একদিন যে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)’ গঠন করা হয়েছিল, তা আজ বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে যেটি করা হয়েছিল, তা এখন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক স্বার্থের প্রশ্নেই বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছে। ইইউয়ের প্রভাবশালী সদস্য জার্মানি ও ফ্রান্স অন্যান্য দেশের মধ্যে যতই বৃহত্তর ঐক্য, সমঝোতা ও সংহতির কথা বলুক না কেন, ব্রিটেন কিন্তু এখনো ইইউয়ের অর্থনৈতিক মুদ্রাব্যবস্থার বাইরেই রয়ে গেছে। ইইউয়ের সদস্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য মুদ্রাব্যবস্থা ইউরো ব্রিটেনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ব্রিটেন তাদের মুদ্রা পাউন্ড-স্টার্লিং, জাতীয় পতাকা ও ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টে প্রণীত আইনের মধ্যে কোনো হস্তক্ষেপ চায় না। ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষ মনে করে, এগুলো তাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। তারা রাজনৈতিকভাবে এক ইউরোপে রূপান্তরের কথা ভাবতে পারে না। শুধু উন্নত অর্থনীতিই নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিকিৎসাবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাসহ বহু ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা প্রকাশ্যেই তাদের অগ্রবর্তী ভাবে। ইইউয়ের আইনকানুন সব ক্ষেত্রে ব্রিটেনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কিংবা সমগামী নয়। তা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে ব্রিটেন তার জাতীয় ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য হারাতে চায় না। সে ক্ষেত্রে কেউ কেউ ব্রিটিশ মনোভাবকে সাম্প্রদায়িক কিংবা আধিপত্যবাদী মনে করলেও বিভিন্ন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষতাদের নাগরিকদের স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধাকেই বড় করে দেখে। তারা চায় না ব্রিটিশ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা কোনোভাবে বিঘ্নিত হোক; ইউরোপের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র থেকে অগণিত মানুষ কর্মসংস্থানের সন্ধানে এসে ব্রিটিশ নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা এবং বহু যুগ ধরে অর্জিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিক। ব্রিটিশরা ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করতে চায়, কিন্তু এর বেশি কিছু নয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধান অনুযায়ী সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিকরা অবাধে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মতে, কর্মহীন ব্রিটিশ নাগরিকরা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার কারণে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেয়ে থাকে। তা ছাড়া আবাসিক সুযোগ-সুবিধা, বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তানদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অনুদান ও ঋণ গ্রহণ করতে পারে, যেটি অন্যান্য দেশের নাগরিকদের বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে না। এ বক্তব্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের। তাঁর মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য দেশের নাগরিকরা ব্রিটেনে এসেই স্থানীয় নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধার অংশীদার হতে পারে না। তার জন্য ব্রিটিশ নাগরিকদের কর্মরত অবস্থায় ইন্স্যুরেন্সের অর্থ প্রদান করতে হয়। এগুলো আইনি ব্যবস্থা। এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্রিটিশ সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রটি ভেঙে পড়বে। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ইউরোপীয় সদস্য দেশের কোনো নাগরিক ব্রিটেনে এসে বসবাস কিংবা কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণ করলেও প্রথম চার বছর তার জন্য ব্রিটিশ সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো প্রযোজ্য হবে না। একটানা ব্রিটেনে চার বছর কর্মরত থাকার পর বহিরাগতদের জন্যও প্রচলিত সুযোগ-সুবিধা কার্যকর হতে পারে। এগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইউনিয়নের সভাপতি ইয়েংকারের সঙ্গে সম্প্রতি বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করেছেন। তা ছাড়া ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী (চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার) জর্জ অসবর্ন তাঁর জার্মান ও ফ্রেঞ্চ প্রতিপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। কিন্তু আসন্ন ২৩ জুন ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা বা না থাকা নিয়ে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তা রাষ্ট্রীয় বা জাতীয়ভাবে একটি মৌলিক বিষয়। বহু আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হলেও ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ রক্ষণশীল দলের প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথের আমলে ব্রিটেন ইইউতে যোগ দেয়। কিন্তু জার্মানি বা ফ্রান্সের মতো পূর্ণাঙ্গভাবে নয়। তা ছাড়া নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড এখনো ইইউতে যোগই দেয়নি কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। তুরস্ক ইইউতে যোগদানের ব্যাপারে প্রথম দিকে হন্যে হয়ে উঠলেও এখন মনে করে ইউনিয়নের বাইরে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করাই তার জন্য অধিক লাভজনক। তুরস্কের সদস্য পদের জন্য আগে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নানাভাবে তদবির করলেও এখন অনেকটা নিরুত্তাপ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার ব্যাপারে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা-নেত্রী ও সদস্যরা মোটামুটি একমত এবং না থাকার বিষয়ে রক্ষণশীল দলের নেতা-নেত্রী ও সদস্যরা বিভক্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার ব্যাপারে লন্ডন মহানগরীর নাগরিকরা মোটামুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ বলা চলে।
তবে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের কান্ট্রি সাইডের নাগরিকরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত বিরূপ মনোভাবাপন্ন। তারা চায় না ইউরোপীয় হলেও ভিন্নভাষী ও ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ক্রমাগতভাবে ব্রিটেনে এসে তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করুক। এ ক্ষেত্রে তারা বরং উপমহাদেশের মানুষ অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশিদের (কমনওয়েলথের নাগরিক) বেশি পছন্দ করে। কারণ উপমহাদেশের মানুষ ইংরেজী জানে। তা ছাড়া তাদের খাদ্য ব্রিটেনে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পোশাক ও সংস্কৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। তদুপরি ক্রিকেটের বেলায় সবাই একাট্টা। এমন বহু ধরনের বাদানুবাদ, তর্ক-বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে ২৩ জুন। সেদিনই ব্রিটেনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। মতামতের বিষয় একটিই। ইইউতে ‘থাকব’ কি ‘থাকব না’। তাই এখন সবাই ভাবছে শেষ বিবেচনায়, থাকলে লাভ কতটুকু আর না থাকলে ক্ষতির পরিমাণ কী হবে? তার পরও সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে যায় ইউরোপকে বাদ দিয়ে ব্রিটেন নয়। এমনকি যে স্কটল্যান্ড গত বছর ব্রিটেন ত্যাগ করে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীন হতে চেয়েছিল, তারাও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষে নয়। তাদের অধিকাংশ মানুষই ইউনিয়নে থাকার পক্ষপাতী। অর্থনৈতিক অবস্থানের কথা বাদ দিলে ব্রিটেন এখনো ইউরোপের মধ্যমণি। শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবনবৈচিত্র্যের দিক থেকে ব্রিটেন সবাইকে টানে। এ অবস্থায় আলোচনা ও বিতর্কের ক্ষেত্রে কোথায় যেন একটা নীরব পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। ইউরোপে থাকার ব্যাপারে যে লন্ডন, বিশেষ করে তরুণ সমাজ, গত সপ্তাহেও ছিল উদাসী, এ সপ্তাহে তারাই আবার ৬০-৪০ সংখ্যাগরিষ্ঠ। ক্রমে ক্রমে পরিবর্তন ঘটছে সরকারি দলের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর মধ্যেও। রক্ষণশীল দলীয় ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবর্ন বলেছেন, ব্রিটিশ ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা গেছে, ইউনিয়ন ত্যাগের কারণে প্রথম দুই বছরে লন্ডনে ৭৩ হাজার চাকরি চলে যাবে এবং ঘরবাড়ির মূল্য ক্ষেত্র বিশেষে প্রায় ৬২ হাজার পাউন্ড-স্টার্লিং পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইইউ ত্যাগ করার ফলে প্রতিটি কর্মজীবী ব্রিটিশ পরিবার দুই বছর পর বছরে গড়ে ৮০০ পাউন্ড-স্টার্লিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে ১৮-২৪ বছর বয়সের আট হাজারের মতো তরুণ-তরুণী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া ব্রিটেনের ব্যবসা-বাণিজ্য ইইউ ত্যাগ করার কারণে শুরুতেই যে ধাক্কা খাবে তা কাটিয়ে উঠতে ব্রিটেনের অন্তত দুই বছর সময় প্রয়োজন হবে। সে সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মেনে নিতে রাজি নয়।
ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবর্ন সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সম্প্রতি প্রকাশ্যেই বলেছেন, লন্ডনের শক্তিশালী অর্থনীতি ইইউ ত্যাগ করার ফলে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তা ছাড়া এ নগরীতে চাকরি হারাতে পারে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। এ ঘটনা এক দিনে না ঘটলেও ক্রমে ক্রমে ঘটবে। সে কারণেই ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএম) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, ইউনিয়ন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলে ব্রিটেন আবার বছরব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনবে। তা ছাড়া ইউনিয়ন ত্যাগের ফলে বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে লন্ডনের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর বহু মিলিয়ন পাউন্ড-স্টার্লিং অনুদান হারাবে। বিশ্বখ্যাত ইমপেরিয়াল কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়), ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএস), কিংস কলেজ, গ্রিনউইচ ও ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট লন্ডনের প্রতিটি ১০ বছর যাবৎ বহু মিলিয়ন পাউন্ড-স্টার্লিং ইইউ থেকে অনুদান লাভ করেছে। গত ১০ বছরে ইমপেরিয়াল কলেজ (লন্ডন) একাই ইইউ থেকে ৩৪২ মিলিয়ন পাউন্ড-স্টার্লিং লাভ করেছে, যেটি তার মোট তহবিলের ২০ শতাংশেরও বেশি। ইউনিয়ন ত্যাগ করার ফলে লন্ডন বা ব্রিটেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা কিংবা গবেষণার কাজ অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে বলে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ধারণা। কিন্তু ইউনিয়নবিরোধী মহল বলছে, লন্ডনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া অনুদানের অর্থ মূলত ব্রিটিশ সরকারেরই বার্ষিক প্রদত্ত অর্থের অংশ। এ সময়ে তর্ক-বিতর্কের পর প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবর্ন এখন প্রকাশ্যেই নিজেদের মতামত জানিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। তবে সরকারের ভেতরেই ইইউ ত্যাগের ব্যাপারে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। সাবেক কর্মসংস্থান ও পেনশনবিষয়ক মন্ত্রী ইয়ান ডানকান স্মিথ বলেছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্তে যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রয়েছে। সেসব তথ্য-উপাত্ত মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় এবং প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ হিলটন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের ব্যাপারে অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ইইউতে অন্তর্ভুক্তি ব্রিটেনকে শাসনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুঃসাধ্য করে তুলেছে। কারণ ওয়েস্টমিনস্টারে প্রণীত বিধান ইইউয়ের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইইউ বা ব্রাসেলসের আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ অনেক সময় জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তের পরিপন্থী বলে মনে হয়। উল্লিখিত বিভিন্ন কারণেই বেশ কিছু বিরোধ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। এসব বিরোধ ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উত্থাপন করে মেটানো যাবে না তা নয়। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থও সংরক্ষিত হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ইইউকে নেহাত একটি ইউরোপীয় ক্লাবে পরিণত করতে পারে, যার কোনো সম্মিলিত ভূমিকা থাকবে না। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের ভাগ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটবে না। তাতে ২৮ সদস্যবিশিষ্ট বর্তমান ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐতিহাসিক ‘রোম ঘোষণা’র ভিত্তিতে একটি সমন্বিত ইউরোপিয়ান শক্তিতে পরিণত হওয়ার পথে পদে পদে হোঁচট খাবে।
এ মুহূর্তে, যখন ব্রিটেনে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন গ্রিস, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালসহ কয়েকটি ইইউ সদস্য রাষ্ট্র অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ সংকট নিরসনে জার্মানি ও কয়েকটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলেও অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না। ইইউয়ের সব সদস্যের লোকসংখ্যা, সম্পদের পরিমাণ ও অর্থনৈতিক অবস্থা এক নয়। সব সদস্য আবার ইউরোপীয় মুদ্রা ব্যবস্থার অধীনেও পরিচালিত হয় না। এ ক্ষেত্রে সমস্যা অনেক। সবাই ইইউ থেকে লাভবান হতে চায়, ত্যাগ স্বীকার করতে চায় না। তা ছাড়া ইইউয়ের সব সদস্য রাষ্ট্রের সরকারগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় নীতি এক নয়। তদুপরি একমাত্র জার্মানি ছাড়া সব সদস্য রাষ্ট্রেরই কমবেশি রয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা। নিজেদের অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করতে প্রায় সবাই হিমশিম খাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা এবং থাকার ব্যাপারে ব্রিটেনের নাগরিকদের বিভিন্ন মতামত ও অভিব্যক্তিতে এখন প্রতিনিয়ত তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তবে শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার ব্যাপারেই অধিকাংশ ব্রিটিশ নাগরিক মত দেবে বলে অনেকের বিশ্বাস। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করলে ব্রিটেনের লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে অনেক বেশি। তা ছাড়া এরই মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উত্থাপিত আইনি বিষয়গুলো ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সুরাহা হলেই উত্তম হবে। কারণ ব্রিটেন, জার্মানি কিংবা ফ্রান্সে শুধু ইইউয়ের সদস্য দেশের নাগরিকরাই নয়, বরং যেসব দেশ ইউরোপীয় নয়, এমন বহু দেশের আশ্রিত মানুষ এখন ব্রিটেনসহ অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চলে আসছে। প্রতিবছর তিন লাখের অধিক মানুষ এখন ব্রিটেনে আসছে। এদের সবাই ইউরোপীয় নয়। ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা ছিল প্রতিবছর তারা এক থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ মানুষের সংস্থান করবে। কারণ যাদের ব্রিটেনে এসে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে, তাদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও ক্ষেত্র বিশেষে বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধাও সরকারকে দিতে হবে। বর্ধিত বহিরাগত মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি না করা হলে প্রকৃত ব্রিটিশ নাগরিক ও তাদের ছেলেমেয়েরা দুর্ভোগের শিকার হবে। কারণ প্রকৃত ব্রিটিশ ছেলেমেয়েরা তখন স্কুলে স্থান পাবে না, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দেখানো কিংবা হাসপাতালে জায়গা পাবে না। এ বিষয়গুলোই বয়স্ক ব্রিটিশ নাগরিকদের অত্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছে। অপরিকল্পিত অভিবাসন কিংবা বহিরাগতদের আগমনের ফলে ব্রিটেনের জনসংখ্যা এখন বেশ কিছু বেড়ে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অপরিকল্পিত জনসংখ্যা শিগগিরই ব্রিটেনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে কারণেই ব্রিটিশ সরকার ও সচেতন নাগরিকদের একটি বিশাল অংশের এত উদ্বেগ। ব্রিটেনের বসতি সংকট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে ডাক্তার ও নার্সের অভাব ও শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা শুধু সরকারের নয়, নাগরিকদেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গণভোট। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে ব্রিটেন এখন সরগরম।
লন্ডন থেকে
গাজীউল হাসান খান
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
কালের কণ্ঠ,৩০ মে, ২০১৬