৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি
গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সিরিয়ার শান্তি আনতে যুক্তরাষ্ট্র
জেনেভা শান্তি আলোচনার ফল
ফেডারেশন নাকি যুদ্ধ?
গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সিরিয়ার শান্তি আনতে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সমর্থনে জাতিসংঘ কর্তৃক জেনেভা শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছে ১৪ মার্চ সোমবার। প্রশ্ন হলো এ শান্তি আলোচনার ফলে সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, নাকি দেশমাটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অতল গহবরে হারিয়ে যাবে? কোন কোন বিশ্লেষক মনে করছেন, শান্তি আলোচনা সিরিয়াকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করবে। কেউবা ভাবছেন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে দেশটি। আাামাদের মনে হয়, পৃথিবীর বৃহত্ শক্তিসমূহ যথা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সিরিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠার একনিষ্ঠ বলেই কেবল দেশটির গৃহযুদ্ধের অবসান হবে এবং সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
.
২০১১ সালে সরকার বিরোধী আরব বসন্তের বাতাস ঝিরঝির করে বইতে শুরু করে। এরপর গত কয়েক বছরে তা বৃহত্তর, সর্বব্যাপী গৃহযুদ্ধের চৈতী দাবদাহে পরিণত হয়। প্রায় তিন লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এ পর্যন্ত, উদ্বাস্তু হয়েছে কোটি মানুষের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম শরণার্থী সংকট মুকাবিলা করছে ইউরোপ এবং অন্যান্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহ। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া তাদের আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী নীতি বাস্তবায়নে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সরকার ও সরকার বিরোধীরা রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সিযুদ্ধের বলী হয়ে উঠে। এমতাবস্থায়, এ দুটি বৃহত্ শক্তিকেই সিরিয়া শান্তি আনায়নে অকৃত্রিম ভূমিকা নিতে হবে। বিবদমান পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে স্থায়ী রেখে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা পেশ করতে পারলে এ শান্তি আলোচনা সফল হবে। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ। সে কারণেই বলছিলাম সিরিয়া ইস্যুকে কেন্দ্র করে যদি অত্রাঞ্চলে বড় কোনো যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে আমরা অবাক হবো না। এমনকি সিরিয়ায় রাশিয়া, ফ্রান্স এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তির সামরিক অভিযানের কারণে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছি না এ মুহূর্তে।
.
আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রের মত সিরিয়ায়ও সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়। তবে সিরিয়ার সরকার বিরোধীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আল্ আসাদের উত্খাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। বাসার বিরোধী বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে দেশটিকে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত স্বার্থ সিদ্ধিই ছিল বাশার বিরোধিতার মূল লক্ষ্য। স্পষ্ট যে সিরিয়ায় দেশটির চিরায়ত মিত্র রাশিয়া ও প্রতিবেশী বন্ধু ইরান—এ দুটি রাষ্ট্রের আধিপত্য খর্ব করতে পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট বিদ্রোহীরা মরিয়া হয়ে উঠে। সংগত কারণে বাশার বিদ্রোহীরা সিরিয়া এবং সিরিয়ার বাইরে তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। তদুপরি বাসার বিরোধীরা এতটাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে যে বাশার বিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্য ও চেতনা ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। আরব দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদী আরব এবং উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো সিরিয়ার মতই স্বৈরতান্ত্রিক। রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের চারণভূমি মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলোর প্রতি সমর্থন অক্ষুণ্ন রেখে সিরিয়ার সরকারকে দোষারোপ করে সেই সরকারকে সরিয়ে দেয়ার পাশ্চাত্য উদ্যোগ তাই বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। গত কয়েক বছর বাশার বিরোধী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেছে রাশিয়া ও ইরানসহ তার উপসাগরীয় মিত্রদেশগুলো। সিরিয়ায় যুদ্ধরত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পাশ্চত্যের দমননীতির প্রতি তারা বাহ্যিকভাবে সমর্থনও দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশন চলাকালে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ওবামা ও পুতিন সিরিয়ার সন্ত্রাসী দমনে একযোগে কাজ করার ‘গঠনমূলক আলোচনা’ সম্পন্ন করেছেন। বুঝা যাচ্ছে, রাশিয়া সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরু করার যৌক্তিকতা অনুসন্ধান করছিলো। যৌথ আলোচনার মাত্র দুদিন পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়া তারতুজ নৌঘাটি ও কাসপিয়ান সাগর থেকে সিরিয়ায় বিমান হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সূচনা করে। ওবামা-পুতিনের আলোচনায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি লাভ হয়েছে। রাশিয়া তাই আইএসসহ সিরিয়ায় যুদ্ধরত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। তবে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসীদের চিহ্নিতকরণে পার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আইএস এবং বাশার বিরোধী বিপ্লবীদেরও সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করছে।
.
মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়ার আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সহযোগিতা করা রাশিয়ার নৈতিক দায়িত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনে মিত্ররাষ্ট্রের প্রতি এমন সহযোগিতা অন্যায় নয়। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র-পরিচালিত যৌথ বাহিনীর অভিযানের পক্ষে না আছে জাতিসংঘের সমর্থন, না আছে সিরিয়া সরকারের আহ্বান। পুতিনের কাছে তাই সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের সামরিক অভিযান অন্যরাষ্ট্রে আগ্রাসনের শামিল এবং অন্যদেশের আভ্যন্তীণ ব্যাপারে অন্যায় হস্তক্ষেপ এবং সেকারণে সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপ বেআইনী ও অন্যায় এবং আন্তর্জাতিক রীতি-বিরোধী।
.
সিরিয়ায় রাশিয়ান অভিযান আরেকটি কারণে যুক্তিযুক্ত হতে পারে যে, ইউরোপে সিরিয়ায় শরণার্থীদের ব্যাপারে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিরিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন প্রয়োজন। গত চার বছর ধরে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে পুঁজি করে ঐ দেশের জনগণকে বিতাড়িত করেছে, বেসামরিক এলাকায় বোমা বর্ষণ করে নিরীহ জনগণের হত্যার ফাঁদ পেতেছে এবং সর্বোপরি সিরিয়াকে রাষ্ট্র হিসেবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে। সিরিয়ার অভিজাত জনগণ দলে দলে ভূমধ্য সাগরের বিশাল জলরাশি অতিক্রম করে মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনেও ইউরোপে শরণার্থী হিসেবে পাড়ি দিচ্ছে এবং জীবন-যন্ত্রণার সকল অভিশাপ ভোগ করছে। রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রধান লক্ষ্য হলো ভেঙ্গে খান খান হওয়া সিরিয়া রাষ্ট্রের পুনঃগঠনে ভূমিকা রাখা, বাশারের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সহযোগিতা করে স্থিতিশীল রাষ্ট্র ও সরকার গঠনে ভূমিকা রাখা এবং সিরীয়দের মরণ যন্ত্রণার অবসান ঘটানো। ইরাক আফগানিস্তানসহ অন্যত্র গণতন্ত্র রক্ষার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘মানবিক হস্তক্ষেপের’ নামে পাশ্চাত্যের সামরিক অভিযানের কোন নৈতিক ও আইনী ভিত্তি নেই। কিন্তু সিরিয়ায় রাশিয়ার অভিযানের মানবিক তাত্পর্য অনস্বীকার্য।
.
পুতিনের সিরিয়া অভিযানের আরেকটি কারণ হলো সাবেক পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ায় রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি যে এখনো তাত্পর্যপূর্ণ, তা পাশ্চাত্যকে জানানো। ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার প্রতি পাশ্চাত্য- নীতির প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে সিরিয়া অভিযানের
.
মাধ্যমে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার সিরিয়া নীতির সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করেছে এবং সে কারণে আকাশ নিরাপত্তা (air safety) বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার জন্য রাশিয়াকে আহ্বান করেছে। অধিকন্তু সিরীয় বিদ্রোহীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত বিতর্কিত ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ কর্মসূচীতে আপাতত ধীরগতি আনয়ন করা হয়েছে। সিরিয়া চায় পাশ্চাত্য অনুধাবন করুক যে, রাশিয়া সাবেক পরাশক্তি এবং পাশ্চাত্যকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তার আছে। ইউক্রেন ইসুকে পুঁজি করে রাশিয়ার প্রতি পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার অবসান চায় রাশিয়া, জি-৮ (এ৮) গ্রুপের সদস্যপদও ফেরত চায় রাশিয়া সর্বোপরি, মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেখানোর যুগ শেষ হয়েছে, এ বার্তাও পৌঁছে দিতে চায় রাশিয়া।
.
এ মুহূর্তে ভাববার বিষয় হলো সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানের ফলে সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হবে না কি সিরিয়াসহ অত্রাঞ্চলে বৃহত্ যুদ্ধ শুরু হবে। এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে’ রুশ সামরিক অভিযানের প্রতি পাশ্চাত্যের নীতির প্রকৃতি ও পরিধি জুড়ে। গত চার বছরের ক্রমাগত আক্রমণ এবং সাত হাজার বিমান হামলার পরও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো আই,এসসহ সিরীয় সন্ত্রাসীদেরকে কুপোকাত্ করতে যখন হিমশিম খেয়েছে, গত দশদিনের রুশ অভিযানে সেখানে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। রাকা, হামা, দামেস্ক ও আলেপ্পোসহ অন্যান্য প্রদেশে অবস্থিত আই, এস সন্ত্রাসীদের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, অস্ত্র গুদাম এবং ট্রেনিং কেন্দ্রগুলোর ব্যাপক ধ্বংস সাধন হয়েছে বলে বিশ্ব মিডিয়ায খবর প্রচারিত হয়েছে। রাশিয়ার একক এ সামরিক অভিযানের সঠিক মূল্যায়ন করে পাশ্চাত্য দেশগুলো যদি সিরিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে রাশিয়ার সাথে একত্রে কাজ করে তাহলে সিরীয় জনগণের দুর্ভাগ্যের অবসান ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে ‘গঠনমূলক আলোচনা’ শুরুর সময় এখন এবং এখনি। জাতিসংঘের উপর গুরু-দায়িত্ব বৃহত্ শক্তিগুলোকে আলোচনায় নিয়ে আসা। আর যদি পাশ্চাত্য রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে ফ্রান্সের মত অন্যরাও বিমান আক্রমণ চালায়, তাহলে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। অত্র এলাকায় ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে যেকোন সময়। এখানে কেবল একটি গুলিও যদি ভুল বুঝাবুঝির পরিবেশ তৈরি করে, তাহলে বৃহত্শক্তির মধ্যে বৃহত্ যুদ্ধ শুরু হতে পারে। সিরিয়ার জনগণ এখন বাস্তুচ্যুত, পড়ে রয়েছে কেবল সিরিয়ায় যুদ্ধ-বিক্ষত পোড়ামাটি। সিরিয়ায় এ পতিত ভূমি বৃহত্ শক্তির মহড়া দেখানোর জন্যও ব্যবহূত হতে পারে। ভূমধ্যসাগর থেকে উড়ে আসতে পারে ইউরোপের বোমারু বিমান, আটলান্টিক মহাসাগরের বুক চিরে ধেয়ে আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী, উড়তে পারে আমেরিকার ড্রোন বিমান, কাসপিয়ান সাগর থেকে সজোরে আঘাত হানতে পারে রাশিয়ার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ভূমধ্যসাগর থেকে নিক্ষিপ্ত হতে পারে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র, ভারত মহাসাগর এবং উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে উড়ে আসতে পারে ভারতের অগ্নি, পারস্য উপসাগর অতিক্রম করতে পারে ইরানের যুদ্ধজাহাজ, ধেয়ে আসতে পারে ইরানি স্কাড মিসাইল, যুক্ত হতে পারে পাকিস্তানি শিহাবের বহ্নিশিখা, অগ্নিঝরা ধ্বংসের সয়লাব বয়ে দিতে পারে ইসরাইলের রাসায়নিক ও পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ। বৃহত্ শক্তিবর্গের বিন্দুমাত্র ভুলের জন্য বিশ্বকে হয়ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের তর্জন-গর্জনও শুনতে হতে পারে।
.
লেখক: প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিন, স্কুল অব বিজনেস ‘এন্ড সোস্যাল সাইন্সেস, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি