৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি
মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কাজে দিবে।
.
সাইকস-পাইকট চুক্তির মৃত্যু
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৬ মে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স লন্ডনে এক গোপন চুক্তি করে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তিটি এশিয়া মাইনর চুক্তি হিসেবে পরিচিত। কূটনীতিক মার্ক সাইকস ও ফ্রাঁসোয়া জর্জ পাইকট ছিলেন এর মূল কারিগর। পরবর্তীকালে এই চুক্তিটিই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছে। কিন্তু খুব বেশি দিন তা কার্যকর থাকেনি।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে প্রথম মহাযুদ্ধের সম্ভাব্য বিজয়ী শক্তি এই অঞ্চলকে (তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ) ভাগাভাগি করতে গিয়ে ‘বালিতে একটি রেখা’ (লেখক জেমস বার এভাবেই বলেন) আঁকে, যার ব্যাপ্তি ছিল ভূমধ্যসাগরে উত্তর ফিলিস্তিনের বন্দর আক্কো থেকে শুরু করে ইরানের সীমান্তে উত্তর ইরাকের কিরকুক পর্যন্ত। ওই রেখার উত্তরের অংশ, বিশেষ করে লেবানন ও সিরিয়া গেল ফ্রান্সের ঘরে। আর তার দক্ষিণের ফিলিস্তিন, ট্রান্সজর্ডান ও ইরাক গেল গ্রেট ব্রিটেনের ঘরে। মূলত সুয়েজ খালের আশপাশের অঞ্চলে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই বন্দোবস্ত করা হয়, যেটা ছিল ব্রিটিশ ভারতে যাওয়ার প্রধান নৌপথ।
যুক্তরাজ্য আবার একই সঙ্গে সেই আরবদের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল, যারা অটোমান শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভ্যুত্থানে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পক্ষ নিয়েছিল। আলোচনা চলেছিলমক্কার শরিফওআমির হুসেন বিন আলীর সঙ্গে। হুসেনকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তুরস্কের বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় অর্জিত হলে তাঁকে সিরিয়া দেওয়া হবে। কিন্তু সেই সাইকস-পাইকট চুক্তিতে সিরিয়া গেল ফ্রান্সের ঘরে। ফলে এক পক্ষকে তো নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধজয়ের ফল লাভ থেকে বঞ্চিত হতে হতো। আর শুরু থেকেই এটা পরিষ্কার ছিল, কারা দুর্বল। অর্থাৎ স্বাধীনতাকামী আরবেরা।
সাইকস ও পাইকট গোপনে যে চুক্তি করেছিলেন, তা মূলত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির স্বার্থই সংরক্ষণ করেছে, এই অঞ্চলের সামাজিক, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক বাস্তবতার স্বার্থে তা করা হয়নি। মুসলমান অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ইউরোপীয় খ্রিষ্টানেরা একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিল, যেখানে ইউরোপীয়রা স্বাধীনতাকামী আরবদের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা ভঙ্গ করে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই ব্যবস্থার কারণেই এক শতক কাল ধরে মধ্যপ্রাচ্যে নানা বাদবিসংবাদ চলছে।
এই বিশ্বাসভঙ্গের ধাক্কা ও জাতীয় আন্দোলনের পরাজয়ের জের আরব দুনিয়ায় দীর্ঘায়িত হয়েছে। কিন্তু কথা হলো, সাইকস-পাইকট চুক্তির মাধ্যমে দুই বড় শক্তির মধ্যে এক সমঝোতা তৈরি হয় অটোমান শাসন-উত্তর যুগে, যেটা টিকেও যায়। অর্থাৎ ইউরোপীয় শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স অটোমান শাসকদের জায়গায় নিজেদের স্থান করে নেয়। তারা হয় সরাসরি, নাহয় প্রক্সির মাধ্যমে এই ব্যবস্থা কার্যকর রেখেছে।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যুক্তরাষ্ট্র এই সাইকস-পাইকট চুক্তির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে অভিজ্ঞতা হলো, তাতে তারা সেখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছে, যার রেশ ধরে বিভিন্ন জায়গায় বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। আর তার সঙ্গে সাইকস-পাইকট চুক্তি ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
আর সে কারণেই আজ সাইকস-পাইকট চুক্তির একদম কেন্দ্রস্থলই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুতর সংকটের ক্ষেত্রভূমি অর্থাৎ সিরিয়া, লেবানন ও ইরাক। ওদিকে ‘কুর্দি প্রশ্নও’ আবার সামনে আসতে শুরু করেছে। শুধু ইসরায়েল ও জর্ডানকেই কিছুটা স্থিতিশীল মনে হচ্ছে, তবে এ ক্ষেত্রে ‘দৃশ্যত’ শব্দটায় জোর দিতে হবে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সমঝোতা না হলে ফিলিস্তিনি বারুদ আবার জ্বলে উঠল বলে, যেটা স্রেফ সময়ের ব্যাপার। আর জর্ডানের স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে মূলত রাজপরিবারের প্রতি সেনাবাহিনী ও বেদুইনদের আনুগত্যের ওপর। সঙ্গে আছে খুবই দক্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থা, যাদের আনুগত্যও খুব জরুরি। কিন্তু প্রতিরোধের ভিত্তি হিসেবে এটা খুবই দুর্বল, বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায় যে বড় বড় পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে।
সাইকস-পাইকট চুক্তি উত্তর যুগে যে নতুন বন্দোবস্তের সন্ধান চলছে, তাতে এই দুটি দেশই প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দুটি দেশই বহুদিন ধরে অস্থিতিশীল। দুটি দেশেই ধর্মনিরপেক্ষ বাথ পার্টি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় ছিল, যারা একসময় প্রতিপক্ষ মুসলমান গোষ্ঠীগুলোর আন্দোলনের মুখে পড়ে, যে আন্দোলন আবার জনপ্রিয়তাও পায়। তার সঙ্গে আবার ছিল কুর্দিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, যাদের সংখ্যাটাও আবার কম নয়।
সাইকস-পাইকট চুক্তি উত্তরকালে মধ্যপ্রাচ্যে যে বন্দোবস্তটা হবে, সেটা মূলত আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে, যার সর্বাগ্রে থাকবে ইরান ও সৌদি আরব। আর থাকবে তাদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক সহযোগীরা, অর্থাৎ শিয়া হিজবুল্লাহ ও সুন্নি ইসলামিক স্টেট। সেখানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
এখন আর সেই যুগ নেই যে পশ্চিম সামরিক বলপ্রয়োগ করে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। আঞ্চলিক শক্তিগুলোই নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, বাইরের কেউ নয় (রাশিয়াসহ)। সিরিয়ায় যে প্রক্সি যুদ্ধ চলছে, তা শেষ হলেই সাইকস-পাইকট চুক্তি ইতিহাসের পাতায় ঢুকে যাবে। কিন্তু নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে সময় লাগতে পারে, কারণ এ অঞ্চলের কোনো শক্তিরই সে ক্ষমতা নেই যে তারা অন্যের ওপর নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করতে পারে। তারা যদি অনর্থক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে গুরুতর রাজনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে। শেষমেশ দেখা যাবে, সবাই ক্লান্ত হয়ে নিজেরাই একটি সমঝোতায় আসবে, যেটা হবে আঞ্চলিক শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ।
একটা বিষয় পরিষ্কার: নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে যত বেশি সময় লাগবে, ততই ব্যাপারটা সবার জন্য খারাপ হবে। বেশি সময় লাগলে ও মধ্যপ্রাচ্য টুকরা টুকরা হয়ে গেলে মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা কেবল বাড়বেই, যেটা বিশ্বশান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে। এ অঞ্চলের বাইরের মানুষের একমাত্র আশা হলো শান্তি ভঙ্গের ব্যাপারে এখানকার ভেতরের কারও তেমন একটা স্বার্থ থাকতে পারে না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
ইয়শকা ফিশার: জার্মানির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিষয়: মতামত আন্তর্জাতিক লেখকের কলাম প্রতীক বর্ধন
প্রথম আলো, ৩০ মে।