৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৫৩

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৫৩

ট্রাম্প যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন

———-
জর্জ ডব্লিউ বুশ যেদিন (২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন, সেদিনই আমার তখনকার কর্মস্থলের সহকর্মীদের বলেছিলাম, এই প্রেসিডেন্টের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি হবে। এটি কোনো জ্যোতিষী-ভবিষ্যদ্বাণী ছিল না, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থী হিসেবে অতি সাধারণ একটি অনুমান ছিল মাত্র। সে সময় রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন দৌড়ে এবং নির্বাচনী প্রচার অভিযানে বুশের দেয়া বক্তৃতাগুলোই বলে দিচ্ছিল, বিল ক্লিনটন যুগের নমনীয় পররাষ্ট্রনীতির অবসানের পর যুক্তরাষ্ট্র একটি আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। যদিও সরকার পরিবর্তনে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির হেরফের সাধারণভাবে তেমন একটা হয় না।
সেই প্রেডিকশন এতটা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে, এটি অবশ্য তখন কল্পনাও করিনি। ওই বছরেরই ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির টুইন টাওয়ারে এবং ভার্জিনিয়ায় পেন্টাগন ভবনের ওপর ‘সন্ত্রাসী হামলা’ হয়। একে অজুহাত করে যুক্তরাষ্ট্র ‘ওয়ার অন টেরর’ নামে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। প্রথমে তারা আফগানিস্তানে সর্বাত্মক অভিযানসহ দখলদারিত্ব কায়েম করে। এরপর জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করে মিথ্যা অজুহাতে ইরাকের ওপর সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে দেশটি দখল করে নেয়। উৎখাত করে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে। এসব ঘটনা বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটায়। বিশ্বজুড়ে মার্কিনবিরোধী মনোভাব দানা বেঁধে ওঠে। অন্যদিকে নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণ ও অভিবাসন নীতিতে আসে বড় পরিবর্তন। এর শিকার হয় বাকি বিশ্বের মানুষ, বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠী। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানরাও নানাভাবে নিগৃহীত হয়। এসব ঘটনাও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। একই সঙ্গে তা উসকে দেয় জঙ্গিবাদকে। শুধু মুসলিম বিশ্ব নয়, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ অনেক পশ্চিমা দেশের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রেসিডেন্সি সম্পর্কে এতকিছু বলার কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান মনোনয়ন প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। অপরদিকে ডেমোক্র্যাট মনোনয়ন দৌড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন হিলারি ক্লিনটন। এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষ হিলারিকেই আগামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করছেন। জনমত জরিপে এমনটিই প্রকাশ পাচ্ছে এখনও। তবে নির্বাচন পর্যন্ত এ অবস্থা বজায় থাকবে কি-না সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। মনে রাখতে হবে- এক. যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে পরপর তিন মেয়াদ ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর জয়ের রেকর্ড নেই। দুই. যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ারও রেকর্ড নেই। অর্থাৎ ট্রাম্পের বিজয় ঠেকাতে হলে দু’-দুটি রেকর্ড গড়তে হবে হিলারিকে। তাছাড়া ট্রাম্পের কিছু ‘গোপন’ সমর্থক রয়েছেন, যারা প্রকাশ্যে তার প্রতি সমর্থন দেখাতে চান না; ভোটের সময় তা দেখিয়ে দিতে চান। উপরন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের আগে মার্কিন অর্থনীতিতে খারাপ কিছু ঘটলে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে বা বাইরে বড় কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে এর ‘সুফল’ পাবেন ট্রাম্প। সেদিক থেকে বলা যায়, কিছুদিন আগেও যাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কল্পনা করা যায়নি, যিনি নারীদের এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিষয়ে বিভিন্ন অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন আর উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আসলে বর্তমান বিশ্বে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। চরম সাম্প্রদায়িকতা ও গোদরা হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন, নির্বাচনের এক বছর আগেও কি কেউ তা কল্পনা করেছিল?
বুশ আর ট্রাম্প এক নন। দু’জনই রিপাবলিকান হলেও তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে। বুশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ঐতিহ্য থাকলেও রাজনীতিতে ট্রাম্পের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তবে অনেক পর্যবেক্ষক ট্রাম্পকে জর্জ ডব্লিউ বুশের যথার্থ মতাদর্শিক উত্তরাধিকারী মনে করছেন। এ মতাদর্শের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্ন জড়িত। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তার আচরণ কেমন হবে, এ প্রশ্ন অনেকেরই। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অথবা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প যেসব বক্তব্য রেখেছেন তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট- তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অনেকটাই অজ্ঞ। গত বছর সিরিয়া প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি সিরিয়া সরকারকে ধ্বংস করার জন্য দায়েশকে (আইএস) লেলিয়ে দেবেন। এটা করা হলে তা হবে স্রেফ একটি পাগলামো। কারণ আইএস খ্রিস্টান, ইয়াজিদি ও অন্য সংখ্যালঘুদের হত্যা করছে, নয়তো পরিণত করছে তাদের দাসে। ধ্বংস করছে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। নির্যাতন করছে নারীদের। অথচ ট্রাম্প চান আইএস দামেস্ক দখল করুক!
আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয় হল, তিনি একটি বাণিজ্য যুদ্ধ অথবা প্রকৃত যুদ্ধ বাধাতে চান। গত জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমসকে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি চীনা পণ্যের ওপর ৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পক্ষপাতী। এ বক্তব্যের মধ্যে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে।
ট্রাম্প ইরাকে আরও মার্কিন সৈন্য মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছেন এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কেন্দ্রে বোমা হামলার প্রস্তাব দিয়েছেন। এমন একজন ক্ষ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট কোনো উত্তেজনাকর আন্তর্জাতিক সংকটে ক্ষুব্ধ ও অধৈর্য হয়ে যদি পারমাণবিক সুইচে তার আঙুল রাখেন, তাহলে এর চেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন আর কী হতে পারে! খোদ মার্কিন বুদ্ধিজীবীরাও এজন্য চিন্তিত। তারা মনে করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন অজ্ঞ, অসহিষ্ণু ও যুদ্ধপ্রিয় নেতা যুক্তরাষ্ট্রের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের অধীনে পররাষ্ট্র বিভাগের আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জন বি. বেলিংগার এক সতর্কবার্তায় বলেছেন, ‘ট্রাম্প আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।’ যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় রক্ষণশীল চিন্তাবিদ কয়েক দিন আগে এক খোলা চিঠিতে জানিয়েছেন, তারা ট্রাম্পকে সমর্থন করতে পারেন না। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী মাইকেল শেরটফ, সাবেক উপমন্ত্রী রবার্ট জোয়েলিকসহ শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। প্রেসিডেন্ট বুশ আর যা-ই হোন, তিনি বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলমানকে এ নিশ্চয়তা দিতে সচেষ্ট ছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত নয়। প্রেসিডেন্ট ওবামাও তা-ই। কিন্তু ট্রাম্প অনেকটা স্পষ্টভাবেই সব মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ফলে ইতিমধ্যেই তিনি মুসলিম বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। বস্তুত ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত নাও হন, বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির যথেষ্ট ক্ষতি করেছেন। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। তিনি বিশ্বের সব মুসলমানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলার পর হ্যারি পটারখ্যাত ব্রিটিশ লেখক জে কে রাউলিং বলেছেন, ট্রাম্প হ্যারি পটার সিরিজের খল চরিত্র ভোল্ডেমর্টের চেয়েও নিকৃষ্ট।
বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ যখন পারমাণবিক অস্ত্র পর্যায়ক্রমে কমিয়ে এর বিলোপ সাধনের কথা বলছে, তখন ট্রাম্প বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান শত্র“র হাত থেকে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে। ট্রাম্পের এ ধরনের ভাবনাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর বার্নার্ড গর্ডন ‘অবিশ্বাস্য বিপজ্জনক ও অপরিপক্ব’ বলে অভিহিত করেছেন। খ্যাতনামা জার্মান ম্যাগাজিন ডের স্পিগেলও ইতিপূর্বে ট্রাম্পকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করেছে।
এমন একজন ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশটির প্রেসিডেন্ট হলে বিশ্বে কী ঘটবে? তিনি এতদিন যে ভাষায় কথা বলেছেন, বাস্তবেও কি তার প্রতিফলন ঘটবে তখন? নাকি ক্ষমতার চেয়ার তাকে বদলে দেবে নরেন্দ্র মোদির মতো? মোদি বুঝেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাকি বিশ্বের সঙ্গে তার দায়িত্বহীন আচরণ করার সুযোগ নেই। যদিও গত দেড় বছরে ভারতে অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বেড়েছে, বেড়েছে সংখ্যালঘুদের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা, তবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তিনি এক ধরনের সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছেন। তাছাড়া মোদির রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, কখন কী আচরণ করা উচিত সেসব বিষয় তিনি ভালোই বোঝেন। সে তুলনায় ট্রাম্প রাজনীতিতে একেবারেই নবিস। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেলে তিনি কী করে বসেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। আমরা ট্রাম্পের মধ্যে জর্জ ডব্লিউ বুশের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। ভয়টা সেখানেই। এখন মার্কিন ভোটাররা কী করেন সেটা দেখার জন্য আমাদের আগামী নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
যুগান্তর , ২২, ৫.১৬

 

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline