কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক
ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিন প্রভাব
.
গত ২০ মার্চ কিউবার রাজধানী হাভানা সর্বত্র লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আগমন উপলক্ষে মাঙ্গলিক সংবর্ধনার উদ্দেশ্যে। ওবামা ও রাউল ক্যাস্ত্রোর যুগ্ম ছবি দুলছে কিউবার রাস্তায় রাস্তায়। গত ৮৮ বছরের ইতিহাসে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথম কিউবা সফর এটা, যেটি প্রায় শতাব্দী ধরে চির অকল্পনীয়। যুক্তরাষ্ট্র-কিউবার এ মাখামাখি তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বৈরিতা দূর করে বন্ধুত্বের যুগ সংযোজন করবে কিনা তা বলা যায় না। কারণ, এখনো পর্যন্ত কিউবার ওপর আরোপিত ৫৪ বছরের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দূর করা হয়নি রিপাবলিকানদের বাধার মুখে। তবে ওবামা কেবল বাণিজ্য ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করেছেন মাত্র। গুয়ানতানামো বের নৌঘাঁটিও এখনো মার্কিন দখল থেকে মুক্ত করা হয়নি। অধিকন্তু কিউবায় কম্যুনিস্ট সরকারের বিরোধীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও প্রত্যাহারের কোনো লক্ষণ নেই। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার একদলীয় শাসনের ঘোর বিরোধী এখনো। কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উষ্ণতা ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে ওবামার বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে যে, খুব কম কিছু পাওয়ার বিনিময়ে ওবামা প্রশাসন কিউবাকে বড় রকমের ছাড় দিতে যাচ্ছে। কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ যে বেশ সহজ নয় তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে দুটি বৈরী দেশের মধ্যকার নির্মীয়মাণ সম্পর্কের বাস্তবতায় একটি বিষয়ের সমাধান লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের অবসান হচ্ছে এবং এ অঞ্চলসহ অন্যত্র যুক্তরাষ্ট্রে নীতি-পুনর্বিবেচনার মুহূর্ত এখন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদ্বয় তাদের শত্রুতার সম্পর্কের ইতি টানার ঘোষণা দেওয়ার প্রেক্ষিতে নির্মীয়মাণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটের ওপর কিঞ্চিত্ আলোচনা প্রয়োজন।
.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের দুয়ারের শত্রু হিসেবে পরিচিত কিউবার বিপ্লবী নেতা রাউল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে বারাক ওবামার ২০১৪ সালের মুখোমুখী বৈঠকের পর আন্তঃ আমেরিকার আঞ্চলিক সম্পর্কে স্বস্তি ফিরে আসছে বলে বিশ্লেষকগণ ভাবতে শুরু করেছিলেন। এখন থেকে ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর ইতি ঘটবে বলেও ওবামা ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিশ্চয়ই সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, সত্যিই কি অত্রাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের অবসান ঘটবে?
..
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনিদের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতি মতাদর্শিক এবং সামরিক শক্তির দুরন্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় কম্যুনিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠা নবীন রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে (axis powers) যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে মৈত্রী শক্তি (allied powers) গড়ে তোলে তা নিতান্তই ঠুনকো, ক্ষণস্থায়ী এবং কৌশলী ছিল বলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পর তাদের মধ্যে দূরাতিক্রম্য সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিযোগিতা থেকে সম্মুখ সমরের রূপও পরিগ্রহ করে। কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট, কোরিয়া সংকট ইত্যাদি বিশ্ব ইস্যু সম্পর্কে যারা একটু জ্ঞান রাখেন, তারা বুঝেন সেই প্রতিযোগিতা কত ভয়ঙ্কর ও কত সর্বগ্রাসী ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের এ বাস্তবতাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করলেও যুদ্ধোত্তর পৃথিবীকে সেই স্নায়ুযুদ্ধ যেভাবে খণ্ড-বিখণ্ড ও তছনছ করে দিয়েছে তাতে সেই স্নায়ুযুদ্ধকে স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা বোধহয় সঠিক নয়। এমন একটি ঐতিহাসিক বেদনা যুক্ত হয় ল্যাটিন আমেরিকার কপালে, অত্রাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকে এক এক করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তারা দমন নীতি, দলন নীতি এবং দখল নীতির বলে স্বীয় প্রভাব বলয়ে নেয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা চালায়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে নির্যাতিত ল্যাটিনিরা সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয়ে নিরাপত্তা লাভের সুযোগ খোঁজে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
..
বছরের পর বছর ধরে আমেরিকা দ্বারা শান্তি এবং শোষিত হয়ে ল্যাটিন আমেরিকানরা যখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়, তখন কম্যুনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের জন্য ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়। একে একে ল্যাটিন আমেরিকায় দেশগুলো সোভিয়েত কম্যুনিজমের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলে। স্নায়ুযুদ্ধের উত্তপ্ত রণাঙ্গনে গোটা ল্যাটিন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ বলয়ে যুক্ত হয়ে যায়। এ সময় দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে বিপ্লবী বীরদের আবির্ভাব ঘটে, যারা দক্ষিণ আমেরিকায় পুঁজিবাদী আমেরিকার জন্য দুরন্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এমন একজন বীর ছিলেন ফিডেল ক্যাস্ট্রো, যিনি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তাঁর দেশ কিউবার কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠিত রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন এবং শেষ পর্যন্ত সে লক্ষ্য পূরণ করতেও সক্ষম হন। কিউবার ক্ষমতায় আরোহণ করে কিউবাতে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠিত করে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করান তিনি। ১৯৫৯ সালের স্বৈরশাসক পুঁজিবাদের দেশের বাতিস্তাকে উত্খাত করে কিউবাতে কম্যুনিজমের পতাকা উড়ালে ১৯৬১ সালেই কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের যবনিকাপাত ঘটে।
..
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পাশাপাশি ১৯৬১ সালে পিগস উপসাগরে সিআইএর পৃষ্ঠপোষকতায় মর্মন্তুদ অভিযান পরিচালিত হয়। পরের বছর ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কিউবার ওপর বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করেন। এ বছর কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের ঘটনাও ঘটানো হয়। ১৯৯৩ সালের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণে কিউবা অবর্ণনীয় অর্থনৈতিক সংকটের শিকার হয়। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমেই ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কিউবার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ জোরদার করে দেশটিকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেন। ২০০৬ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে আপন ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্ব পর্যন্ত শত বাধা প্রতিবন্ধকতার মুখেও বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো কোনোভাবেই পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাম্যবাদী কিউবার আপোষ মেনে নেননি। এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। এতদিনে দক্ষিণ আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের শাসন-শোষণের অবসান হয়। ক্লান্ত-অবসন্ন যুক্তরাষ্ট্র নিখিল আমেরিকায় তার অভিযান শিথিল করে আনে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইরাক, আফগানিস্তানসহ অন্যত্র অভিযান চালিয়ে বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেক সামরিক বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রকে “ক্ষয়িষ্ণু শক্তি” হিসেবে অভিহিত করতে থাকেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ম্যাক্রো ব্যবস্থার বিশ্লেষক কুপচান তাঁর “আমেরিকা ধ্বংস তত্ত্ব (decline of America thesis) উপস্থাপন করে বিশ্বময় আলোড়ন তুলেন। তাঁর এ দর্শন ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার (Francis Fukuyama) “ইতিহাসের ইতি” তত্ত্বের (end of history thesis) ঠিক উল্টো। সাম্প্রতিক সময়ে কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক নির্ধারণে এমন একটি ব্যাখ্যা তৈরি হচ্ছে যে, আমেরিকা অপশাসনের কি অবসান ঘটতে যাচ্ছে?
..
ইতোমধ্যে অনেক বিশ্লেষক আমেরিকায় সামরিক শক্তির ক্ষয়িষ্ণুতা নিয়ে নতুন নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করছেন। তাদের যুক্তিতে দক্ষিণ আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-পরিবর্তন অত্রাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের অবসান ঘটাচ্ছে, একথা স্পষ্ট। গত ২০১৬ সালের ১০ এপ্রিল ৫০ বছরের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ে প্রথম বৈঠক করলো যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবা। পানামায় আয়োজিত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর দুইদিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলন সামিট অব দি এ্যামেরিকাস এ বার্তা দিয়েছিল যে, দক্ষিণ আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের দিন শেষ হয়েছে। সম্মেলনের শেষ দিন ১১ এপ্রিল বারাক ওবামা এবং কিউবার নেতা রাউল ক্যাস্ত্রোর ঐতিহাসিক বৈঠকের পর ওবামা ঘোষণা করেছিলেন এখন থেকে আর কখনো যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকার বিষয়ে নাক গলাবে না। গত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার শীর্ষ নেতাদের প্রথম মুখোমুখি বৈঠক। এ বৈঠক এ কথাটি প্রমাণ করে যে, একটি রাষ্ট্র যত ক্ষুদ্র হোক না কেন, তার আদর্শের জোরে সে রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি পরাশক্তিকেও কুপোকাত করতে সক্ষম হয়। সাম্প্রতিককালে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক চুক্তির প্রেক্ষিতেও একথাটি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুদিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ আমেরিকায় আরেক বিপ্লবী রাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী বীর নিকোলা মাদুরো ওবামার উদ্দেশে বলেন “আমি আপনাকে সম্মান করি। কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করি না। আন্তঃ আমেরিকার শীর্ষ সম্মেলনে এমন তেজস্বী বিপ্লবী বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্য ও সহ্য এ কথাই প্রমাণ করে যে, ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের অহংকার এখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে। সম্মেলনের ফাঁকে সুশীল সমাজের এক সমাবেশে ওবামা স্বীকার করেন যে, “একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো যে ল্যাটিন আমেরিকায় হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র দায়মুক্তি পাবে, কিন্তু এখন সে সব অতীত।” ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য অবসানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যত্র তার আধিপত্য বিস্তারের অভিযান সংকুচিত করবে কিনা, তা বিশ্লেষণের সময় এখন, এবং এখন-ই।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন :প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়