৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৩৯

৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট – ৩৯

আমেরিকার নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো ওষুধ ও অস্ত্র শিল্পের মালিকদের ভূমিকা

——-
আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন? তা নিয়ে এখন পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলোতে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। মোটা অঙ্কের বাজি ধরা হচ্ছে বেটিং হাউসগুলোতে। এযাবত্ মনে করা হয়েছিল ডেমোক্রাট দলের মনোনয়ন হিলারি ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন ডোনাল্ড ট্রাম্প পাবেনই। প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এ দু’জনের মধ্যেই। কেউ কেউ মনে করতে শুরু করেছিলেন, হিলারি-ট্রাম্প যুদ্ধে ট্রাম্প জয়ী হবেনই। এই অসম্ভব দাম্ভিক এবং বিরাট ধনী মানুষটি মুসলমানদের আর আমেরিকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না এবং ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সাম্প্রতিক চুক্তি বাতিল করা হবে এই ঘোষণা দিয়ে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের এক বিরাট অংশ এবং অত্যন্ত শক্তিশালী মার্কিন ইহুদী গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ধরেই নেওয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানদের মনোনয়ন লাভ তার জন্য এখন এক প্রকার অবধারিত। আর মনোনয়ন পেলে তিনি জয়ী হবেনই।
.
এখন পরিস্থিতি একটু বদলেছে। নারীদের গর্ভপাতের বিরুদ্ধে এবং আরো কোনো কোনো বিষয়ে অসংলগ্ন কথা বলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ভাটা ধরেছে। রিপাবলিকান দলও তার অনেক কথাবার্তায় দায়িত্ব আর নিতে চান না। এক সাম্প্রতিক জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, মার্কিন মুল্লুকের শতকরা ৬২ জনই এখন ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে চান না। অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটনেরও ডেমোক্রাট দলের মনোনয়ন লাভ যে শতকরা শতভাগ নিশ্চিত তা নয়। ওবামা সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার কিছু কাজ ও কথাবার্তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এবং জনমত সমীক্ষায় বলা হয়েছে মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে শতকরা ৫২ ভাগ তাকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য যোগ্য প্রার্থী মনে করেন না।
.
এতো কিছু জল্পনা-কল্পনা সত্ত্বেও আমেরিকার ভাবী প্রেসিডেন্ট হিসেবে আলোচিত হচ্ছে দু’জনেই। হিলারি ক্লিনটন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সত্ অসত্ দু’পথেই প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। তার হাতে অসংখ্য সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের মালিকানা। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচারণায় তিনি কোনো প্রকার শালীনতার ধার ধারেন না। তার সমর্থক শিবিরের প্রচারণায় প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান দলের আরেক মনোনয়ন প্রার্থীর স্ত্রীকে সাবেক ‘কল গার্ল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিপক্ষ শিবিরও ট্রাম্পের বর্তমান তরুণী স্ত্রী সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচারণায় মান কখনো এতোটা নিচুস্তরে নেমে আসেনি।
.
লন্ডনের একটি দৈনিকে মার্কিন রাজনীতির পর্যবেক্ষক একজন কলামিস্ট সম্প্রতি লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন লাভে ট্রাম্পের সম্ভাবনা যদিও হ্রাস পাচ্ছে, তথাপি তিনি যদি মনোনয়ন পান এবং হোয়াইট হাউসে ঢোকেন তাহলে তিনি বিস্মিত হবেন না। কারণ, বহুকাল ধরে দেখা যাচ্ছে, যোগ্যতম প্রার্থীর বদলে অপেক্ষাকৃত অযোগ্য প্রার্থীকে ভোট দানে মার্কিন ভোটারদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে। রুজভেল্ট থেকে ওবামা পর্যন্ত এই ব্যাপারে কলামিস্ট একটা প্রবণতা আছে।”
.
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে অসাধারণ জনপ্রিয়তার অধিকারী হয়েছিলেন। তিনিই মার্কিন অর্থনীতিতে ঐতিহাসিক নিউ ডীলের (New Deal) প্রবর্তক। কিন্তু তার সঙ্গে যিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং রাজনীতিবিদ। তার ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ বইটি এখনো বিশ্বের একটি বহুল পঠিত বই। তিনি রুজভেল্টের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গিয়েছিলেন।
.
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বের প্রথম আণবিক ধ্বংসলীলার হোতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের মেয়াদ শেষ হলে নাটোর সেনাপ্রধান পদে ইস্তফা দিয়ে জেনারেল আইসেন হাওয়ার রিপাবলিকান দলের মনোনয়নে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ান। তার বিরুদ্ধে ডেমোক্রাট দলের প্রার্থী ছিলেন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ আডলাই স্টিভেনসন। মার্কিন ভোটদাতারা তাকে ভোট দেয়নি। ভোট দিয়েছিল খাকি পোশাকধারী আইসেন হাওয়ারকে। তার আমলেই বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ চরম বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছিল। পরবর্তীকালে ডেমোক্রাট প্রার্থী আল গোরের বদলে রিপাবলিকান দলের জর্জ বুশ জুনিয়রকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়ে মার্কিন ভোটদাতারা নিজেদের কপালে নিজেরা কুঠারাঘাত করেছে। বুশ জুনিয়র আমেরিকায় সর্ব নিকৃষ্ট প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত। তার দায়িত্বহীন কার্যকলাপে সারা বিশ্বে আজ সন্ত্রাসের আগুন জ্বলছে।
.
বারাক ওবামাকে আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে ঢুকতে দেওয়ার যে সুবুদ্ধির পরিচয় মার্কিন ভোটদাতারা বহুকাল পরে দেখিয়েছে তার মূল কারণ বুশ জুনিয়র। তার দুই দফার প্রেসিডেন্টগিরির আমলে আমেরিকার বিশ্ব-নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে এমন অবস্থায় টেনে নামিয়েছিলেন যে, তা থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র পথ ছিল ওবামার মতো অশ্বেতাঙ্গ কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী একজন প্রেসিডেন্ট। এই বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় মার্কিন ভোটদাতারা ওবামার পূর্ববর্তী একজন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের বেলায় দেখায়নি। তারা বুশ জুনিয়রের মতো “নিকৃষ্টতম” এক প্রেসিডেন্টকে দু’ দু’বার হোয়াইট হাউসে বসিয়েছে, কিন্তু জিমি কার্টারের মতো একজন মানবতাবাদী, যোগ্য প্রেসিডেন্টকে এক দফার বেশি হোয়াইট হাউসে থাকতে দেয়নি। এটি আমেরিকার সাম্প্রতিক কালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একটি ব্যতিক্রম।
.
লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় আরেক ফাইনান্সিয়াল কমেন্টেটার সম্প্রতি আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়া একটা অসম্ভব তামাশার বিষয় (Impossible Joke) থেকে সম্ভাব্য দুঃস্বপ্নে (possible night mere) পরিণত হতে পারে। অর্থাত্ তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন। এই সম্ভাবনা হিলারি ক্লিনটনের বেলাতেও রয়েছে।
.
এই ভাষ্যকারের মতে, হিলারি বা ট্রাম্প বা অন্য যে কেউ পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হোন, তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে শক্তিশালী গানস (অস্ত্র) অথবা ড্রাগস (ওষুধ) কোম্পানি। কারণ তারাই শক্তিশালী প্রোপাগান্ডা মেশিনারির অধিকারী এবং তারাই মার্কিন জনমত নিয়ন্ত্রণ করে। আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন, হিলারি অথবা ট্রাম্প অথবা আর কেউ, তা বহুলাংশে নির্ভর করে এই ড্রাগস এবং ওয়ার ইন্ডাস্ট্রির কর্পোরেট মালিকদের সমর্থনের উপর। এই মালিকদের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী জুয়িস গ্রুপ এবং ‘মেকিং এমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগানের সমর্থক উগ্র ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো। ট্রাম্প বুঝেশুনেই মেকিং এমেরিকা গ্রেট এগেইন শ্লোগানটি তার নির্বাচনী প্রচারণায় প্রধান শ্লোগান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে জার্মানির ফ্যাসিস্ট নেতা হিটলার শ্লোগান তুলেছিলেন, জার্মানরা হচ্ছে বিশ্বের সুপারয়েস (সেরা জাতি) এবং বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের একমাত্র অধিকার তাদের।
.
ডোনাল্ড ট্রাম্প ওষুধ ও অস্ত্র কোম্পানির মধ্যে অস্ত্র কোম্পানির সমর্থনকেই নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন। তিনি দেশের ওষুধ তৈরিকারক (Pharmaceutical) কোম্পানিগুলোর তীব্র সমালোচনা করে অস্ত্র তৈরির কোম্পানিগুলোর প্রশংসা করেছেন। তার মতে অস্ত্র শিল্পই আমেরিকাকে আবার শক্তিশালী হতে সাহায্য করবে। আমেরিকার মেডিসিন ইন্ডাস্ট্রির এক কর্মকর্তার মতে, ট্রাম্পের প্রচারণার গুপ্তমন্ত্র হচ্ছে, Sell Pfizer and buy smith @ wessson অর্থাত্ ওষুধ কোম্পানি ফাইজারের শেয়ার বিক্রি করে দাও এবং অস্ত্রনির্মাতা কোম্পানি স্মিথ এন্ড ওয়েসনের শেয়ার কেনো।
.
আমেরিকার শক্তিশালী গান লবির পক্ষে ট্রাম্পের এই শক্ত অবস্থান গ্রহণ হিলারী ক্লিনটনকে বিচলিত করেছে। তিনি তার হেল্থ কেয়ার বা স্বাস্থ্য সেবা পরিকল্পনার জন্য জনসমর্থন পাবেন আশা করেন। কিন্তু গান লবিকে তিনি চটাতে চান না। তিনি তাদের খুশি করার জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়িয়ে চলার নীতিকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। হিলারির এক সমর্থক তাকে উপদেশ দিয়েছেন, তিনি যেন গান লবির সমর্থনের লোভে ড্রাগস লবির সমর্থন না হারান। কারণ, “we will need more drugs as we get older.” (আমাদের যতোই বয়স বাড়বে, ততোই বেশি ওষুধের দরকার হবে।)
.
আমার নিজস্ব একটি ধারণা, রিপাবলিকান দল যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেয় (না দেওয়ার সম্ভাবনাই বাড়ছে) তাহলে নির্বাচনে তার জেতার সম্ভাবনাই বেশি। মার্কিন ভোটদাতারা বুশ আমলের এতো বিপর্যয় সত্ত্বেও বিভ্রান্ত হতে পারেন। গান লবির প্রোপাগান্ডায় প্রভাবিত হতে পারেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে বিশ্ববাসীর জন্য অধিকতর বিপর্যয় নেমে আসবে। আমেরিকাও সেই বিপর্যয় থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবে না। হিলারি বা অন্য কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও আমেরিকার বিশ্বনীতির ক্ষেত্রে সামান্য হেরফের ঘটবে, বড় পরিবর্তন ঘটবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে হিলারি ক্লিনটনের স্বামী বিল ক্লিনটনই প্রেসিডেন্ট থাকাকালে লিবিয়ায় অবৈধভাবে বোমা বর্ষণ করে গাদ্দাফির ছয় মাসের শিশুকন্যাকে হত্যা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তো গাদ্দাফিকেই বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।
.
আমেরিকার রাষ্ট্রনীতি এখন আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট অথবা হোয়াইট হাউস নির্ধারণ করে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারের ভাষায় নির্ধারণ করে একটি ইনভিজিবল গভরমেন্ট (অদৃশ্য সরকার)। এই অদৃশ্য সরকারের কর্তৃত্ব ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি, ড্রাগস ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি বড় বড় কার্টেলের হাতে। ওবামার মতো প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ এড়াতে পারেননি। তথাপি বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আশা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন বিপজ্জনক মানুষ পৃথিবীর সুপার পাওয়ারের নেতা নির্বাচিত হবেন না। সেই সম্ভাবনাটাই হালে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমেরিকায় একজন নমনীয় মেজাজের এবং দূরদৃষ্টির অধিকারী ব্যক্তি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন এবং বিশ্বের বর্তমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটুক এটাই এখন শান্তিকামী বিশ্ববাসীর কামনা।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ইত্তেফাক, ২ এপ্রিল, শনিবার, ২০১৬

 

মন্তব্য করুন

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline