যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক
.
সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হোক
.
১৯২৮ সালে ক্যালভিন কুলিজের কিউবা সফরের পর এবারই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কিউবা সফর করলেন বারাক ওবামা। এরপর হয়তো মার্কিন বিনিয়োগকারী, প্রবাসী কিউবান, পণ্ডিতেরা তাঁকে অনুসরণ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এলে তা যেমন কিউবার জন্য নানা সুযোগ সৃষ্টি করবে, তেমনি নানা ঝুঁকিও সৃষ্টি করবে। এটা হবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিপক্বতা প্রমাণের বড় বড় পরীক্ষা।
৫৭ বছর আগে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব ছিল মার্কিন মনস্তত্ত্বের প্রতি বড় ধাক্কা। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এর নেতারা দাবি করছেন, এই দেশটি ব্যতিক্রম। আর মার্কিন মডেল এতই ভালো যে পৃথিবীর প্রতিটি শিষ্টাচারসম্পন্ন দেশ তার নজির অনুসরণ করবে। কোনো বিদেশি রাষ্ট্র যদি তাকে অনুসরণ না করার মতো বোকামি করে, তাহলে মার্কিন স্বার্থের হানি করার জন্য তাকে উচিত শাস্তি পেতে হবে, যার কারণে মার্কিন নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
হাভানা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে, ফলে কিউবার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই মাথা ঘামিয়ে আসছে। সেই ১৮২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘প্রথম সুযোগেই কিউবা অধিগ্রহণ করতে হবে’। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৮ সালে তারা সেটা করেও ফেলে। সেবার তারা স্পেনের বিরুদ্ধে কিউবার বিদ্রোহে হস্তক্ষেপ করে, সেখানে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে।
এর ফলে যে যুদ্ধ লাগে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র গুয়ানতানামো দখল করে নৌঘাঁটি স্থাপন করে। ফলে তারা ভবিষ্যতেও কিউবার ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকারের ভিত স্থাপন করে। এরপর মার্কিন মেরিন সেনারা বারবার কিউবা দখল করে সেখানকার লাভজনক চিনিশিল্পের মালিকানা নিয়ে নেয়, আসলে এটাই ছিল মার্কিন দখলদারির উদ্দেশ্য। এরপর যুক্তরাষ্ট্র সেখানে নিপীড়ক ও তাঁবেদার সরকার বসায়, যার সর্বশেষ প্রতিনিধি ছিলেন বাতিস্তা, ফিদেল কাস্ত্রো যাঁকে উৎখাত করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে নিজের করতলে রেখেছিল। আর মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে দেশটির রপ্তানি শিল্প স্রেফ চিনি ও তামাকের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে। ২০ শতকের শুরুর দিকে ব্যাপারটা এমনই ছিল। বাতিস্তাকে উৎখাত করে কাস্ত্রো যে বিপ্লব করলেন, তার লক্ষ্য ছিল একটি আধুনিক ও বহুমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলা। কিন্তু তাঁদের পরিষ্কার কৌশল না থাকায় এই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
কাস্ত্রোর কৃষি সংস্কার ও জাতীয়করণ শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক হয়ে যায়। চিনির ব্যবসা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে, সে কারণে তারা নতুন বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে কিউবার চিনি রপ্তানির পরিমাণ কমে যায়, আর কিউবাতে মার্কিন তেল ও খাদ্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। তখন কাস্ত্রো সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারস্থ হলে আইজেনহাওয়ার সিআইএকে এক গোপন নির্দেশ দেন, কিউবার নতুন সরকারকে উৎখাত করতে হবে। ফলে ১৯৬১ সালে জন এফ কেনেডির প্রশাসনের শুরুর দিকে বে অব পিগস হামলা হয়, যার পরিণতি হয়েছিল বিপর্যয়কর।
পরবর্তীকালে কাস্ত্রোকে হত্যা করার জন্য সিআইএকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে রুশ নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ আরেকটি মার্কিন অভিযান বন্ধ করে তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য গোপনে কিউবায় একটি পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেন, ফলে সেই ক্ষেপণাস্ত্র সংকট সৃষ্টি হয়। যার কারণে পারমাণবিক যুদ্ধে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
তবে কেনেডি ও ক্রুশ্চেভের অসাধারণ সংযমের কারণে মানবতা বেঁচে যায়।
সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেওয়া হয়, আর যুক্তরাষ্ট্রও প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা আর আক্রমণ করবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এর বদলে কিউবার ওপর বাণিজ্য অবরোধ দ্বিগুণ করে দেয়, আর কিউবাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। কিউবার চিনি চাষ বহাল থাকল, কিন্তু তার গন্তব্য হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র নয়।
আধা শতক ধরে সোভিয়েত স্টাইলের অর্থনীতি ও মার্কিন বাণিজ্য অবরোধের কারণে কিউবাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ক্রয়ক্ষমতার বিচারে কিউবার মাথাপিছু আর্ন দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এক-পঞ্চমাংশ। তারপরও শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যে কিউবা যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। কিউবার মানুষের গড় আয়ু যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড় আয়ুর সমান, যেটি লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই বেশি। অন্যদিকে কিউবার চিকিৎসকেরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকার রোগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার মাধ্যমে মার্কিন-কিউবা সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র তার সেই পুরোনো বাজে পন্থায় ফেরত গেল, তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে চাইছে কিউবা যেন কঠোর নীতি গ্রহণ করে। যেমন বলা যায়, কংগ্রেস হয়তো দাবি করবে, মানুষকে সম্পত্তির মালিকানা ফেরত দিতে হবে, বিপ্লবের সময় যেটি জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এমনকি তারা হয়তো বলবে, মার্কিনদের কিউবার জমি ও সম্পত্তি কেনার অবাধ অধিকার দিতে হবে, পানির দামে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিতে হবে এবং জনস্বাস্থ্যের মতো প্রগতিশীল সামাজিক নীতির অবসান ঘটাতে হবে। ব্যাপারটা খুবই কদর্য হতে পারে।
দ্বিতীয় চিত্রটি এমন হতে পারে যাতে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের ব্যত্যয় ঘটাবে, তারা হয়তো আত্মসংযমী হবে। কংগ্রেস হয়তো কিউবার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করবে, কিন্তু তার জন্য শর্ত দেবে না যে তাকে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কিউবাকে হয়তো রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত স্বাস্থ্য খাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হবে না, এই খাতকে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য ছেড়ে দিতে বলা হবে না। কিউবার নাগরিকেরা এমন একটা শ্রদ্ধাশীল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আবার নতুন অধীনতার আশঙ্কায় ক্রোধান্বিতও হচ্ছে।
এটা বলছি না যে কিউবা ধীরে ধীরে সংস্কার প্রক্রিয়া জারি রাখুক। কিউবাকে দ্রুত তার মুদ্রা বাণিজ্যের জন্য রূপান্তরযোগ্য করতে হবে, সম্পত্তির অধিকার সম্প্রসারিত করতে হবে, আর কিছু প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি (যথেষ্ট স্বচ্ছতা ও যত্নের সঙ্গে) করতে হবে।
এ ধরনের বাজারভিত্তিক সংস্কারের সঙ্গে বিপুল সরকারি বিনিয়োগ হলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, অর্থনীতি বহুমুখী হবে, যেটি একই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবায় কিউবার অর্জন ধরে রাখবে। কিউবার উচিত হবে, কোস্টারিকার আদলে সামাজিক গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের মতো এ রকম স্থূল পুঁজিবাদের দিকে নয় (প্রথম লেখক মনে করেন, ২৫ বছর আগে পোল্যান্ডেরও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ধাঁচের সামাজিক-গণতন্ত্রের দিকে যাওয়া উচিত ছিল, রোনাল্ড রিগ্যান ও মার্গারেট থ্যাচারের ঘরানার নব্য উদার নীতিবাদের দিকে নয়)।
ফলে এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারটা দুই দেশের জন্যই পরীক্ষা। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কিউবাকে যথেষ্ট সংস্কার করতে হবে, তবে সেটা তার মহান সামাজিক অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই। যুক্তরাষ্ট্রকে অভূতপূর্ব সংযম দেখাতে হবে, যেটা হয়তো ঠিক তার সঙ্গে যায় না। কিউবাকে তার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ দিতে হবে, যাতে সে একটি আধুনিক ও বহুমুখী অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে, যার মালিকানা থাকতে হবে কিউবার জনগণের হাতেই, তাদের উত্তরের প্রতিবেশীদের হাতে নয়।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের পরিচালক।
হানা স্যাকস: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিউবার ইতিহাস অধ্যয়নরত
সূত্র >>> প্রথম আলো , ২৫.০৩.১৬
0 responses on "৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকে, পার্ট - ২৭"