৩৮ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা প্রস্তুতি
,
মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশ সম্পর্কের হালচাল জানতে নিচের লেখাটি পড়ুন।
—
মধ্যপ্রাচ্য একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল, পেট্রোলিয়াম সম্পদে ভরপুর। সেখানের অনেক দেশে গত চার দশক ধরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে এবং এজন্য বাংলাদেশসহ নানা দেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ইসলামী চরমপন্থিদের চারণভূমিতে পরিণত হওয়ার কারণেও আলোচিত। এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, যেখানে পবিত্র মক্কা ও মদিনা অবস্থিত। সৌদি আরব শাসন করছে যে রাজপরিবার তারা নিজেদের মনে করেন ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থানের একক হেফাজতকারী। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল বিন আহমেদ আল-জুবায়ের। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও তার কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি কর্মী নিয়োগের জন্য সৌদি আরবের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে। তারা সংস্কৃতি, শিক্ষা, কৃষি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছেন। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শূন্য সহিষুষ্ণতার নীতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়েছেন এ ক্ষেত্রে যৌথ সহযোগিতার প্রতি।
.
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের ব্যাপারে বাংলাদেশের পত্রিকা-টেলিভিশনে যেভাবে খবর এসেছে তাতে যে বার্তা আমরা পাই সেটা গতানুগতিক। কূটনীতির অঙ্গনে বহু বছর সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার কারণে সফর শেষে এ ধরনের অনেক বার্তা দেখার সুযোগ হয়েছে। অনেকগুলোর সঙ্গে নিজেও যুক্ত থেকেছি। কিন্তু সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকায় ঝটিকা সফরের তাৎপর্য কেবল এতেই সীমাবদ্ধ বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে আঞ্চলিক ও বিশ্ব কূটনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের কাছে এ সফর ‘হাইপ্রোফাইল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তারা এ সফরকে মূল্যায়ন করছেন সার্বিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশেষভাবে সৌদি আরবের অভ্যন্তরে চলমান পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে।
.
সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফর ঘটেছে প্রায় দুই দশক পর। ওই দেশটির সঙ্গে আলোচনার অনেক ইস্যু রয়েছে বাংলাদেশের। এর কোনোটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি মনোযোগ দাবি করে। তবে সে কারণে নয়, এবারের সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে সৌদি আরবের আগ্রহে। বাংলাদেশ তাদের কাছে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে শুরু করেছে। তিনি কেবল তার প্রতিপক্ষ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে নয়, আলোচনায় বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি নিশ্চয়ই এমন কিছু বিষয় আলোচনা করতে চেয়েছেন, যেটি নীতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে প্রধানমন্ত্রীই পারেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে। আগেই বলেছি, মধ্যপ্রাচ্যে এখন বিবর্তনকালীন সময় চলছে। সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষিত যুবরাজ সালমান আল সাউদের বয়স মাত্র ৩১ বছর। বলা যায়, একটি নতুন প্রজন্মের হাতে দেশের শাসনভার ক্রমে তুলে দেওয়ার আয়োজন চলছে। নতুন প্রজন্মের হাতে নেতৃত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় আমরা লক্ষ্য করছি যে, সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। দশকের পর দশক সৌদি শাসকরা যুক্তরাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন লাভ করেছেন। কিন্তু এখন একাধিক কারণে আমরা যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মনোভাবে পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। এ ক্ষেত্রে যেসব কারণ গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয় তার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেলের দাম বিপুলভাবে কমে যাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি রাজপরিবারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের সক্রিয়তা বৃদ্ধিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের টানাপড়েন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না। গত নভেম্বর মাসে সৌদি আরব অনেকটা আকস্মিকভাবেই ৩৪টি দেশের একটি জোট গঠনের ঘোষণা দেয়, যাকে আন্তর্জাতিক সমাজ সামরিক জোট হিসেবে গণ্য করছে। জোটের সব সদস্য দেশ এ বিষয়ে আগেভাগে অবহিত ছিল না- এমন খবর গণমাধ্যমে এসেছে। কোনো কোনো দেশ এমনকি তাদেরকে না জানিয়ে একটি সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করার খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এ জোট কাজ করবে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায়। প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপও গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ এ জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় আগেভাগে সবটা জানত না বলেই জানা গেছে। সরকারের তরফে অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রদত্ত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কোনো সামরিক তৎপরতায় অংশ নেবে না। সম্প্রতি সৌদি আরবের উদ্যোগে গঠিত জোটের ১২টি দেশ একটি যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশ তাতে শরিক ছিল না। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার ঢাকায় অবস্থানকালে জোটের সামরিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, সেটা জানা-বোঝার চেষ্টা করে থাকতে পারেন। বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতার প্রসঙ্গ এসেছে; কিন্তু এখানেই কি শেষ?
সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কয়েকটি অংশ রয়েছে।
.
প্রথমত, বলা যায় ধর্মীয় যোগাযোগ। প্রতি বছর হজ ও ওমরাহ পালন করতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি নারী-পুরুষ ওই দেশে যায়। এ যোগাযোগ আছে এবং থাকবে। সম্প্রতি একটি বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে- ধর্মর্কে সন্ত্রাসবাদীদের হাতিয়ার হতে না দেওয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
.
দ্বিতীয়ত, জনশক্তি রফতানি। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির প্রধান দেশ সৌদি আরব। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্সও আসে ওই দেশ থেকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রবাসীদের মাধ্যমে এসেছে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছে ৩৩৪ কোটি ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ২৮২ কোটি ডলার। সৌদি আরবে যেন অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের কর্মীরা কাজের জন্য যেতে পারেন, সে চেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি তেলের মূল্য অব্যাহতভাবে পড়ে যেতে থাকায় জনশক্তির এই বড় বাজার নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তেল রফতানিই তাদের প্রধান রাজস্ব উৎস। এ আর্ন থেকেই তৈরি হয় তাদের বাজেট ও উন্নয়ন প্রকল্প। গত বছর সৌদি আরবের বাজেট ঘাটতি ছিল প্রায় এক হাজার কোটি ডলার। এ বছরও ঘাটতি কাছাকাছি থাকবে। তেলের দাম যদি আগামী ৪-৫ বছর বর্তমানের নিম্ন পর্যায়ে থাকে, তাহলে এ ধরনের বাজেট ঘাটতি অব্যাহত থাকবে এবং তার প্রভাব পড়বে সৌদি অর্থনীতিতে। এ কারণে তারা বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নেওয়া কমিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ যেন এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হয় এবং নতুন কর্মী গ্রহণের সময় বিবেচনার বাইরে না পড়ে সেজন্য আমাদের সতর্ক হতে হবে। আমরা চাইলেই যে এটা হবে তা নয়। কিন্তু আমরা যেন না ভাবি যে সবকিছু থাকবে আগের মতোই। সৌদি অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিলে আমাদের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেব, সে বিষয়ে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সময় নিশ্চয়ই এ ধরনের শঙ্কা প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় ছিল। মালয়েশিয়ার বাজারেও এখন অশনিসংকেত। ‘১৫ লাখ লোক যাবে’- সে প্রত্যাশা কত দ্রুতই না হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
.
তৃতীয় এটি হচ্ছে, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশের ভূমিকা। বাংলাদেশ সামরিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে না, কেবল তথ্য আদান-প্রদান করবে। এটাও বলেছে যে জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের বাইরে কোনো সামরিক ভূমিকায় শরিক থাকবে না বাংলাদেশ। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি-কূটনীতিতে পরিবর্তন ঘটছে। সৌদি আরবের ভেতরেই ধর্মীয় উগ্রবাদ সক্রিয়। সৌদি শাসকরা ওহাবি মতবাদের সমর্থক এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে এ মতের সমর্থকদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে. ইরানের শাসকরা হচ্ছে শিয়া মতবাদের সমর্থক। সম্প্রতি এ দেশটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করায় মনোযোগী হয়েছে। এর সুবাদে তারা তেলসম্পদ রফতানি বাড়াবে। বাংলাদেশ ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের এটি গুরুত্ব দেয়। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা তাতে আমাদের সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলা চাই। আমরা দুটি দেশের সঙ্গেই সম্পর্কোন্নয়ন চাই। কিন্তু অন্যপক্ষ ভিন্নভাবে আমাদের না নিয়ে ভাবতেই পারে। আমাদের চলতে হবে ভারসাম্য বজায় রেখে। কারও প্রতি ঝুঁকে পড়লে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা। আমাদের কূটনৈতিক পদক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্যের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রতিফলন থাকতেই হবে। গবেষক-বিশ্লেষকদেরও এ নিয়ে আরও মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে।
হুমায়ুন কবির
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক
সূত্র >> সমকাল , ১৪মার্চ ২০১৬।