BCS ভাইভা/ রিটেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
.
জিকা ভাইরাস
/
বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর এক আতঙ্কের নাম এখন জিকা ভাইরাস। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, জ্যামাইকাসহ বিশ্বের ৩০টির মতো দেশ ও বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে জিকা। গত মে মাস থেকে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। এই ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েরা গত কয়েক মাসে সেখানে এমন চার হাজার শিশু জন্ম নিয়েছে, যাদের মাথা শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক ছোট। কলম্বিয়ায় প্রায় ১৩ হাজার নবজাতক জিকার শিকার। এল সালভাদরের মতো ছোট দেশেও পাঁচ হাজার নবজাতক জিকার প্রকোপে শারীরিক বৈকল্য নিয়ে জন্মেছে।
/
জিকা সংক্রমণ ক্রমেই মহামারির দিকে এগোতে থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে বার্বাডোজ, বলিভিয়া, গুয়াতেমালা ও পুয়ের্তোরিকোর সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) সাহায্য চেয়েছে। জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না বলে বেশ কয়েকটি দেশ নমুনা পরীক্ষার জন্য আমেরিকার দ্বারস্থ হচ্ছে।
/
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে জিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ব্রাজিল সরকার দুই লাখ ২০ হাজার সেনা মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনগণকে করণীয় জানাবে। এ ভাইরাস মোকাবিলায় লাতিন আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন জানিয়েছে, ক্যারিবিয়ান এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ বিশ্বের ৩০টি দেশে জিকা ভাইরাস সনাক্ত হয়েছে। এই ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা ও চিকিৎসাব্যবস্থা আবিষ্কারের কাজ দ্রুত করার নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মার্কিন বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই ভাইরাস বিশ্বজুড়ে বিস্ফোরকদ্রব্যের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চ্যান ২১ জানুয়ারি বলেছেন, এর ভয়াবহতা ও প্রভাব অত্যন্ত হূদয়বিদারক। ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ এ ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
/
/
কী এই জিকা ভাইরাস?
/
উগান্ডার জিকা নামক একটা বন থেকে ‘জিকা’ নামটির উত্পত্তি। ১৯৪৭ সালে হলুদ জ্বর নিয়ে গবেষণার সময় বিজ্ঞানীরা খাঁচায় বন্দি একটি বানর এই বনে নিয়ে রাখেন। পরে বানরটি জ্বরে ভোগে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বানরটির দেহে একটি সংক্রামক এজেন্টের উপস্থিতি পাওয়া যায়। অনেক গবেষণার পর ১৯৫২ সালে এর নাম দেওয়া হয় জিকা ভাইরাস। এরপর ১৯৫৪ সালে নাইজেরিয়ায় এক মানুষের দেহে এই ভাইরাস পাওয়া যায়।
/
বলা যায়, একেবারেই অচেনা একটি রোগ জিকা। এডিস ইজিপ্টি নামের মশার কামড় থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ফলে মশার কামড় এড়িয়ে চললেই এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে যথাসম্ভব বাঁচা যেতে পারে।
/
গর্ভবতী মহিলাদের ওপর প্রভাব বেশি
/
জিকা ভাইরাসে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে, তবে গর্ভবতী মহিলাদের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। গর্ভবতী মায়েরা আক্রান্ত হলে একই সঙ্গে আক্রান্ত হচ্ছে গর্ভে থাকা শিশুটিও। আক্রান্ত নবজাতকের মাথা শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক ছোট হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় শিশুদের এ অবস্থাকে বলা হয় ‘মাইক্রোসেফালি’। এতে আক্রান্ত শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন সম্পূর্ণ হয় না। ফলে ওই শিশুরা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হতে পারে, বিলম্বিত হতে পারে শারীরিক বৃদ্ধি, এমনকি শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। চিকিৎসকরা বলেছেন, জিকায় আক্রান্ত হয়ে অসম্পূর্ণ মস্তিষ্ক নিয়ে কোনো শিশু জন্ম নিলে বাকি জীবন তাকে সেই অস্বাভাবিকতা নিয়েই বাঁচতে হবে। তবে এর সঙ্গে একমত পোষণ না করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান মার্গারেট চ্যান বলেছেন, জিকা ভাইরাসের সঙ্গে জন্মগত ত্রুটি ও স্নায়ুবিক বিভিন্ন রোগের সম্পর্ক এখনো স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়নি।
/
প্রকৃতপক্ষে ৮০ শতাংশ সংক্রমিত ব্যক্তিই আঁচ করতে পারেন না যে তাঁদের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি রয়েছে। ভাইরাসটি ক্রমান্বয়ে এবং নিঃশব্দে মস্তিষ্কে আক্রমণ করে। আস্তে আস্তে মস্তিষ্ক বা ব্রেনকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যাতে রোগীর আর কিছুতেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা সম্ভব হয় না।
/
জিকার লক্ষণ
/
জিকাকে চিনে নেওয়ার উপায় এখনো খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। এই পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাস মহিলাদের গর্ভধারণ না করতে বলেছে লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়া, এল সালভাদরসহ অনেক দেশ। কোনো কোনো দেশ বলছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত মহিলারা যেন সন্তানের জন্ম না দেন। এই বার্তা প্রচারের পর, আমেরিকান দেশগুলোতে গর্ভপাতের প্রবণতা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেড়ে গেছে গর্ভনিরোধক ওষুধ বিক্রির পরিমাণ। গর্ভপাতের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় মহিলাদের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কাও বাড়ছে। তাই এমন সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে কলম্বিয়া ও এল সালভাদরের বেশ কিছু মানবাধিকার ও নারী সংগঠন।
/
জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মাঝারি মাত্রার জ্বর, চোখে প্রদাহ, গোড়ালিতে ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, পেশিতে ও মাথাব্যথা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যায়। শরীরে র্যা শও (চামড়ায় লাল ফুসকুড়ি) বেরোতে পারে। কিন্তু এই লক্ষণগুলো এতই মৃদু যে রোগী জিকা আক্রান্ত না সাধারণ জ্বরে আক্রান্ত, তা বোঝা খুব কঠিন। তবে ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্ট নাইল, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু যে গোত্রের সদস্য, জিকা ভাইরাসও একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি ফ্লাভিভাইরাস। তবে ওপরের ভাইরাসের কয়েকটির টিকা বা চিকিৎসা থাকলেও জিকার কোনো টিকা এমনকি কোনো প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে সতর্ক থাকাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। অবশ্য এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা বিরল।
/
/
বাংলাদেশ কি ঝুঁকির মধ্যে?
——
ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের দেশগুলোতেও জিকা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ এই ক্রান্তীয় অঞ্চলেই পড়ে। সে হিসেবে বলতে গেলে বাংলাদেশ জিকা ভাইরাসের হুমকির মধ্যে। তবে ভারত ও পাকিস্তানে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে এখনো কোনো খবর মেলেনি। এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ৩০ জানুয়ারি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, বাংলাদেশে এই ভাইরাস নিয়ে আপাতত উদ্বেগের কারণ নেই। জিকা মোকাবিলায় তারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলেও জানিয়েছে।
আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাময়িকীতে বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল আর লুসি এবং লরেন্স ও গোস্টিন বলেন, সাম্প্রতিক এবোলা সংকটের সময় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ডাব্লিউএইচওর ব্যর্থতার কারণে সম্ভবত হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, জিকা ভাইরাস এমন নিঃশব্দে সংক্রমিত হচ্ছে যে তার প্রকোপ থামানো না গেলে আগামী প্রজন্মের বিরাট অংশ শারীরিক বৈকল্য বা অপরিণত মস্তিষ্ক নিয়ে জন্ম নিতে পারে। একটা গোটা প্রজন্ম এমন ভয়ংকর রোগের শিকার হলে, ভবিষ্যৎও সংকটে পড়বে।
/
সূত্র >> কালের কণ্ঠ।