ভাইভা/ রিটেন জন্য গুরুত্বপূণ : মিয়ানমারের নির্বাচন ও অং সান সূচি.
.
মিয়ানমার : নতুন যুগের সূচনা
—————
.
৮ নভেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বহুল আলোচিত এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর ১ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করেছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মিয়ানমারের নতুন পার্লামেন্ট।
.
আপসহীন রাজনীতিবিদ সুচি
.
মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে অং সান সু চির জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তত্পর হয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে বিশ্বাসী অং সান সু চি। ওই বছর গঠন করেন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। দল গঠন করায় চক্ষুশূলে পরিণত হন সামরিকজান্তার। ১৯৮৯ সালের জুলাই থেকে তিনি গৃহবন্দি হন। পারিবারিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে তখন থেকেই। তাঁকে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে বলা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৯০ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করলে তাতে সু চির দল জয়ী হয়। দলের প্রধান হিসেবে তখন অং সান সু চিরই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা; কিন্তু তাঁর পরিবর্তে সামরিক সরকার নির্বাচনের ফল বাতিল ঘোষণা করে। ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে সু চিকে গৃহবন্দি করে এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের কারান্তরীণ করে।
.
১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান অং সান সু চি। তাঁর ছেলে আলেকজান্ডার এবং কিম তাঁর হয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। গৃহবন্দি অবস্থায় স্বামীর সঙ্গে ১৯৯৫ সালের বড়দিনে শেষ দেখা হলেও ছেলেদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। চার বছর পর স্বামী মারা যান। ২০১০ সালে ১২ বছরের মধ্যে প্রথম ছোট ছেলে কিমের সাক্ষাৎ পান। চাইলেই তিনি মুক্তি পেতে পারতেন; কিন্তু স্বামী-সন্তানকে দেখতে একবার দেশ ছাড়লে আর কখনোই তাঁকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না, তাই দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে বন্দিজীবনই বেছে নিয়েছিলেন।
.
১৯ বছর জেলে ছিলেন
.
সু চির বাবা অং সান ছিলেন মিয়ানমারের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রধান নেতা ও সমরনায়ক। তাঁর মেয়ে অং সান সু চির বন্দিদশার জন্যই মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি পড়ে। সু চিকে মুক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা। কিন্তু প্রতিবছরই তাঁর বন্দিত্বের মেয়াদ বাড়াচ্ছিল মিয়ানমার সরকার। পশ্চিমা দেশের চাপে ২০১০ সালে মিয়ানমারে রাজনৈতিক সংস্কারে হাত দেয় সেনা সমর্থিত সরকার। ১৯ বছরের বন্দিজীবন থেকে ওই বছরই সু চি মুক্ত হন।
.
ছিল পারস্পরিক স্বার্থ
.
২০১১ সালের মার্চ মাস থেকে মিয়ানমারের সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট তেইন সেইন দেশে গণতন্ত্রের বিকাশের ওপর জোর দেন। তিনি বেশ কিছু রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেন। দেশের সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন অধিকার আদায়েও সোচ্চার হন। ২৫ বছর পর মিয়ানমারে এই নির্বাচন ও পরিবর্তনের হাওয়ার পেছনে বর্তমান প্রেসিডেন্টের ভূমিকার কথা সুবিদিত। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংস্কারের পেছনে আসলে দুই পক্ষেরই স্বার্থ রয়েছে। একদিকে সু চি যেমন চেয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘ দুই দশকের রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে, অন্যদিকে বর্তমান সামরিক প্রশাসন চেষ্টা করছে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে। এই দুইয়ের মিশেলেই বলা যায় গণতন্ত্রের এই উত্তরণ।
.
২৫ বছর পর সাধারণ নির্বাচন
.
১৯৯০ সালে সর্বশেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছিল। তখন ভোটের ফল এনএলডির পক্ষে এলেও সামরিক সরকার ফল বাতিল করে। ২০১০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও নিষেধাজ্ঞার কারণে এতে অংশ নিতে পারেনি সু চির দল। সেনা নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাসীন ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ৩৩০টির মধ্যে ২৫৯টি আসনে কৌশলে জয়লাভ করে।
.
২৫ বছর পর গত বছরের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই ঐতিহাসিক নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল সু চির দল। ২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী, ৬৬৪ সদস্যের পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। জয় পেতে বাকি আসনের ৬৭ শতাংশে জিততে হবে তার দলকে। এখানে প্রধান প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন ইউএসডিপি হওয়ায়, লড়াইটা হয় সু চি বনাম সেনাবাহিনীর মধ্যেই। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে এই নির্বাচনে এনএলডি ৩২৯টিরও বেশি (৮০ শতাংশ) আসনে ঐতিহাসিকভাবে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে।
.
অবশেষে গণতন্ত্রে ফেরা
.
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট ছিল মিয়ানমারের শান্তিকামী মানুষ। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর ১ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মিয়ানমারের নতুন পার্লামেন্ট। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের উদ্বোধনী অধিবেশনে শপথ নিলেন কয়েক শ নতুন এমপি। এর বেশির ভাগই সু চির দলের হলেও কয়েকটি ছোট পার্টির এমপিরাও রয়েছেন। ১৯৬২ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর এবারই প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পার্লামেন্টে নেতৃত্বের আসনে বসলেন। নির্বাচিত সদস্যদের পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে বলা যায়, গণতন্ত্রের নতুন যুগের সূচনা হলো।
.
প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ নেই সু চির
.
মিয়ানমারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে আগামী মার্চের শেষের দিকে। সু চির সরকারের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এপ্রিলে। পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ ও সামরিক সরকার মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে একজন হবেন প্রেসিডেন্ট। এনএলডি সরকার গঠন করলেও সেনাবাহিনীর তৈরি করা সংবিধানের ৫৯(এফ) ধারা বলে বিদেশি নাগরিকত্বধারী স্বামী, স্ত্রী কিংবা সন্তানধারীর প্রেসিডেন্ট হওয়াতে বাধা থাকায় সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ নেই। তবে প্রচারের সময় সু চি বলেছিলেন, জিতলে প্রেসিডেন্টের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হবেন না তিনি। তবে ৫ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে বলেছে, নতুন সরকারের কাঠামো কেমন হবে তা নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু করেছে সু চির দল। সু চি যাতে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, সে বিষয় নিয়ে তাঁরা চেষ্টা করছেন বলে এনএলডির দুই নেতা জানিয়েছেন।
.
সামনে বন্ধুর পথ
.
সেনা সমর্থিত মিয়ানমারের বর্তমান প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের মেয়াদ মার্চ মাসে শেষ হবে। ওই মাস থেকেই আনুষ্ঠানিকভাব এনএলডি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। এনএলডি ক্ষমতায় এলেও সু চির প্রেসিডেন্ট না হতে পারা, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রের মতো মন্ত্রণালয়, সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতাসহ মিয়ানমারের মূল ক্ষমতা থেকে যাবে সেনাবাহিনীর হাতেই। ১৯৬২ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর এবারই প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পার্লামেন্টে নেতৃত্বের আসনে বসে মিয়ানমারের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবেন কি না, সেটা দেখার বিষয়। ৭০ বছর বয়সী গণতন্ত্রপন্থী সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিবন্ধকতা, নির্বাচিত এমপিদের অধিকাংশের অনভিজ্ঞতা এবং জান্তা সরকারের কবল থেকে পুুরোপুরি মুক্ত হতে না পারা—সব মিলিয়ে সু চির সামনে রয়েছে বন্ধুর ও কঠিন পথ। জনগণের কাছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে ওয়াদা তিনি করেছেন, সেটি পূরণ করতে পারবেন কি না, এনএলডি বিজয়ী হওয়ার পরও যদি কোনো গণতন্ত্রপন্থী প্রেসিডেন্ট না বসেন, সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের কী দশা হবে তা দেখার জন্যও আরো অপেক্ষা করতে হবে।
./
সূত্র: আতাউর রহমান কাবুল , কালের কণ্ঠ ।