মোদীর ঢাকা সফরআঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক তাত্পর্য

মুহাম্মদ রুহুল আমীন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কিন্তু তাঁর এ সফর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পরিসরেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ও ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ভারতকে দেখা হতো দক্ষিণ এশিয়ার নিষ্ঠুর বৃহত্ শক্তি হিসেবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ভারতের এ বৈশ্বিক-মন্দ-ইমেজ দূর করে পৃথিবীর জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। এমন এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ঢাকা সফর নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে।
.
যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে পড়াশুনা করেন তাঁরা জানেন এখানকার মানুষ ও রাজনীতিবিদগণ পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জায়গা থেকে অন্যদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ এশিয়ায় এ সর্বজনস্বীকৃত ধারণা পাল্টে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে শান্তি, বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ আনতে সচেষ্ট আছেন। ইতোমধ্যে তিনি নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার সফর করে এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন যে, অত্রাঞ্চলের রাজনীতিবিদ ও জনগণের মনোকাঠামোয় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তাঁর ঢাকা সফর এক্ষেত্রে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ। ঢাকা সফরকালে ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা চুক্তি স্বাক্ষর করে মোদী বুঝিয়েছেন, ভারতের মানচিত্র পুনঃনির্মাণেও মোদী সরকারের কোনো সংস্কার নেই। অপরদিকে দু’দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন (connectivity) চুক্তি, ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা এবং সিলেট-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস চালু করে হাসিনা ও মোদী পারস্পরিক আস্থা আনয়নে সংযোগ স্থাপন নীতির তাত্পর্য তুলে ধরেছেন।
.
ইতোপূর্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রানজিট ইস্যুটি বেশ বিতর্কিত ছিল। সেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে মোদীর সফরকালে দুটি দেশের মধ্যে যে সংযোগ (connectivity) স্থাপিত হয়েছে, তা উভয়ের জন্যই কল্যাণকর। কেননা, এ সংযোগ দু’দেশের স্থল, নৌ এবং রেলপথে বিস্তৃত এবং বেশ স্পর্শকাতর। ইতিপূর্বে মোদী ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মিয়ানমার সফরে গিয়ে এমন সংযোগ স্থাপনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেননি। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে এ সংযোগ চালু করে দু’দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
.
প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে ইন্দিরা-মুজিব স্বাক্ষরিত সীমানা চুক্তি (এলবিএ) এতদিন নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতের শাসনক্ষমতায় থাকাকালে কংগ্রেস নেতৃত্বের সরকার এ সমস্যার সমাধানে তত্পর হলে তদানীন্তন বিরোধী দল বিজেপি’র একগুঁয়েমির কারণে তা সম্ভব হয়নি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সীমানা চুক্তি স্বাক্ষর করতে তত্পর হয়ে এটাই প্রমাণ করলো যে, নরেন্দ্র মোদীর শান্তি-বান্ধব পররাষ্ট্রনীতি এবং ব্যবসা-বান্ধব অর্থনৈতিক নীতি ভারত-বাংলাদেশের পররাষ্ট্রিক জটিলতা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। একচল্লিশ বছর পূর্বে স্বাক্ষরিত সীমানা চুক্তি বাস্তবায়নের এ রোমাঞ্চকর মুহূর্তে দু’দেশের সীমানা পুনঃনির্ধারিত হতে চলেছে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংযোজিত করছে। একজন সিনিয়র কূটনীতিক এ বিষয়ের চমত্কার উপমায় বর্ণনা করে বলেছেন, দু’দেশের মধ্যকার সংযোগ স্থাপন একটি কেকের মত এবং সীমানা চুক্তি সেই কেকের উপর যেন বরফ ঢেলে দেয়া।
.
ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোদীর সফর এ কারণেও তাত্পর্যপূর্ণ যে, দক্ষিণ এশিয়ায় গতানুগতিক রাজনীতিতে ‘ভারত ফ্যাক্টর’ এর যে ভীতি রয়েছে এবং প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতের যে বড় বোনসুলভ (big sisterly) মনোভাব রয়েছে এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে দখলদায়িত্ব তত্ত্বের (hegemoric stability theory) দক্ষিণ এশীয় বৈশিষ্ট্যে যে ‘ভারত-মতবাদ’ (India doctrine) প্রচলিত আছে, তার অপনোদন ঘটিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিকতার (reciprocity) বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ দু’দেশের সংযোগ স্থাপন নীতির কারণে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই তৃতীয় কোনো দেশে যাতায়াত বা বাণিজ্যের প্রয়োজনে একে অপরের সীমানা ব্যবহার করার অধিকার অর্জন করেছে।
.
একইভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ছিটবাসী এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ছিটবাসীরা সমানভাবে স্বাধীনতা ভোগ করবেন তাদের বসবাসের ক্ষেত্রে। তারা বসবাসের জন্য স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। অর্থাত্ তারা যদি চায়, তাহলে তারা বাংলাদেশ বা ভারত যেকোনো রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারবেন।
.
এখন আমরা আলোচনা করবো নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর কিভাবে ভারত এবং বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। আমরা পররাষ্ট্রনীতিতে মূলত সংশ্লিষ্ট দেশের স্বার্থের বিষয়ে অগ্রাধিকার প্রদান করি। ফলে নরেন্দ্র মোদীর এ সফর কিভাবে ভারত ও বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করবে সে বিষয়ে আমরা মনোনিবেশ করবো।
.
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ভারতের মত একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাথে সীমানা চুক্তি এবং যোগাযোগ চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নের সুযোগ লাভ। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় পক্ষ আন্তর্জাতিক চুক্তি, সনদ ও রীতি অনুসরণ করে আলোচনার ভিত্তিতে দু’দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিটের মাশুলের হার ঠিক করবে এবং উভয় দেশকেই এ মাশুল দিতে হবে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতীয় ভিসা সহজ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালুর ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। এছাড়া. ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সার্ভিসও উদ্বোধন করা হয়েছে।
.
বাংলাদেশের মত প্রায় ভূবেষ্টিত রাষ্ট্রের জন্য এ যোগাযোগ-সুবিধা বৃহত্তম ভারতের সর্বত্র বাংলাদেশের পণ্য ও নাগরিকদের অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে, যেটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রভূত উত্কর্ষতা লাভ করবে।
.
নরেন্দ্র মোদী ঢাকা সফরের ফলে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ সহজ শর্তে ঋণ পেতে যাচ্ছে, যেটি অবকাঠামো বিদ্যুত্, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ২০১০ সালে মাত্র ১ শতাংশ হারে ২০ বছরের জন্য ১০০ কোটি ঋণদানের ঘোষণা দেয়া হয়। মোদীর সফরের ফলে প্রথম ঋণ চুক্তির ন্যায় সহজ শর্তে দ্বিতীয় ঋণ চুক্তির দুয়ার উন্মোচিত হলো। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেই শত শত কোটি ভারতীয় ঋণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে রয়েছে মোদীর সফরকালে স্বাক্ষরিত চুক্তিসমূহ এবং সমঝোতা স্মারক। উল্লেখযোগ্য চুক্তিগুলো হলো- বাণিজ্য, ঋণ, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল ও পণ্যের মান পরীক্ষা করা। সমঝোতা স্মারকের মধ্যে অন্যতম হলো- মানবপাচার, জালনোট প্রতিরোধ, যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল ও উপকূলীয় রক্ষীদের সহযোগিতা। তাছাড়া বিদ্যুত্, সামুদ্রিক অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবিলা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়েও বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থার্জনের পথে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
.
নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের ফলে ভারতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের ভারত বিরোধী মনোভাবের অপনোদন। বাংলাদেশের গত ছেচল্লিশ বছরের ইতিহাসে যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, তাদেরকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য বিরোধী দল ভারত-বিরোধী মনোভাবকে ব্যবহার করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, টাটা গ্রুপের সাথে যখন বিএনপি সরকার বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে উদ্যত হয়, তখন তদানীন্তন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে যে, বিএনপি ভারতের কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছে। একইভাবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপি’র অভিযোগ যে, আওয়ামী লীগ ভারতের কাছে দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর এ ভারত বিরোধী মনোভাব অনেকটা দূর করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ে নরেন্দ্র মোদীকে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানাচ্ছে। মোদীর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিনব নেতৃত্ব এবং শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। ভারত-মতবাদের দুুর্নাম কাটিয়ে ভারত এখন প্রমাণ করছে যে, ভারতের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ আস্থা রাখতে পারে। ফলে ভারতের জন্য বৈশ্বিক নেতৃত্বের পথও সুগম হচ্ছে। ভারতের জন্য আরেকটি বিরল অর্জন হলো ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহেই সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্ব্যর্থহীন সহযোগিতা ও ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান। সর্বোপরি, একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি থেকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার ভারতীয় অভিপ্রায় নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের মাধ্যমে বাস্তবায়নের কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছে।
.
লেখক: প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিন, স্কুল অব বিজনেস, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
১২ জুন, ২০১৫ ইং , ইত্তেফাক””

আরো পড়ুন:

বাংলা একাডেমি চত্বরে বাঙালির প্রাণের বই মেলা উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চার দিনব্যাপী বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন শুরু হয়েছে

মাদ্রাসা শিক্ষা জাতীয়করণসহ চার দফা দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

 

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline