আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর
আবুল মনসুর আহমেদ
প্রকাশক: খোশরোজ কিতাবমহল
আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৬৮ সালে। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষিতে কয়েকটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করা হয় (১৯৭৫ সালে) বইটির তৃতীয় সংস্করনে। সুতরাং বইটির নাম আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর হলেও বইটি ষাট বছর কিংবা তারও অধিক সময়ের রাজনৈতিক প্রতিবিম্ব। লেখক আবুল মনসুর আহমদ ব্যক্তি জীবনে রাজনীতির যেসব শাখা প্রশাখায় বিচরণ করেছেন, যেসব ঘটনার সাথে নিজেকে জড়িয়েছেন কিংবা ঘটনাক্রমে জড়িয়ে পড়েছেন সেসব ঘটনার বিষদ বিবরণ নিয়েই মূলত রচিত হয়েছে আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর বইটি। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে লেখকের জন্ম বলে ফরায়েজী ও ওহাবী আন্দোলনের প্রতি বিশেষ ধরনের দূর্বলতা প্রকাশ করেই বইটির সূচনা। প্রধানত নিজ ধর্মের প্রতি বিশেষ দূর্বলতা ও ইংরেজ বিদ্বেষী জাগ্রত চেতনা শিশু মনসুর আহমেদ এর উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলশ্র“তিতে তিনি অল্প বয়সেই ইংরেজ মনোনীত নায়েব সাহেবের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। মাত্র নয় বছর বয়সে প্রজা আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে ক্রমেই নিজের ভবিতব্যকে জড়িয়ে ফেলেছেন জাতীয় রাজনীতির সাথে। ধর্ম চেতনাকে রাজনীতির সাথে উপলব্ধি করে তৎকালীন সমাজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মক্ষেত্রে মুসলমানদের (উনিশ শতকের প্রথম দিকে) অনগ্রসরতা ও বিভিন্নভাবে মুসলিম সাধারনকে হেনস্তা করা প্রভৃতি বিষয় সমূহ লেখককে আরো বেশি সক্রিয় করে তোলে। (একজন শিক্ষক ক্লাসে তাকে মিয়া সাব বলায় তিনিও শিক্ষককে বাবুজী সম্ভাষণ করেছেন। উল্লেখ্য যে, উভয় সম্বোধনই অপমানজনক)।
.
১৯১৪ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর প্রতি মুসলিম সমাজের অগাধ সমর্থনের প্রধান কারন দেখা যায় তুর্কি খলিফার জার্মান সমর্থন। হিন্দু ও মুসলিম জাতি উভয়েই ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তবে স্ব স্ব ধর্মীয় আবেগকে বিন্দুমাত্র অবনমিত না করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন তারই প্রতিবিম্ব। স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা যতোটা প্রাধান্য পেয়েছে ধর্ম তার চাইতে কোন অংশে কম নয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীর পরাজয়, তুরস্কের ক্ষমতায় এসে কামাল আততুর্ক খিলাফত রদ করলে ক্রমেই খিলাফত আন্দোলন স্থিমিত হয়ে আসে। তবে ইংরেজ ও জমিদার শ্রেণীর প্রতি বিদ্বেষ কমে না বরং তা আরো প্রকট হতে থাকে। যারফলে ধনবাড়ির বিখ্যাত জমিদার সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী নির্বাচনে একজন গরিব সাধারন নেতার কাছে পরাজিত হন। এমতাবস্থায় ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্যোগে হিন্দু-মুসলিম স¤প্রীতি স্থাপনের জন্য বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। যার ফলে মুসলমানরা কর্মক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পায় এবং এই চুক্তির কারনে হিন্দু সমাজ উত্তেজিত হয়ে চুক্তি ভন্ডুল করার চেষ্টা করে। অবশেষে দেশবন্ধু ও মওলানা আকরাম খাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় সিরাজগঞ্জের এক সম্মেলনে বেঙ্গল প্যাক্ট গৃহীত হয়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনদাশ উপলব্ধি করেন হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি ছাড়া স্বরাজ অসম্ভব কিন্তু ১৯২৫ সালে দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর সাম্প্রদায়িক তিক্ততা চরমভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯২৬ সালে কলকাতার বিধ্বংসী দাঙ্গা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। এসময় হিন্দুনির্ভর কংগ্রেস নিরব ভূমিকা পালন করে কিন্তু মোঃ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ স¤প্রীতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যার ফলে ইংরেজদের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। জিন্নাহ বিরোধী এই ষড়যন্ত্র পরে অবশ্য মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও জিন্নাহর প্রচেষ্টায় মিটে যায়। পরে ১৯২৮ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বর্ষিক অধিবেশনে কংগ্রেস নেতা বিধানরায় মুসলমানদেরকে কটূক্তি করলে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা ব্যহত হয়। সেসময় প্রজাসত্ত্ব আইনের প্রশ্নে হিন্দুদের জমিদার পক্ষ অবলম্বন ও মুসলিমদের প্রজাপক্ষ অবলম্বন করায় আইন সভা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং এসময়েই বেঙ্গলপ্যাক্ট বাতিল করা হয়। এরপর কংগ্রেস থেকে মুসলমানরা বের হয়ে এসে মওলানা আকরাম খাঁর নেতৃত্বে নিখিল বঙ্গঁ প্রজা সমিতি গঠন করে ১৯২৯ সালে। এসময় কংগ্রেস নেতৃত্বের জমিদার প্রীতি প্রজা আন্দোলনে বিঘœ ঘটায়। পরে ১৯৩১ সালে মহাত্মা গান্ধী গ্রেফতার ও ১৯৩২ সালে কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষনা করা হয়। অপরদিকে ময়মনসিংহ জেলায় প্রজা আন্দোলনের বিস্তৃতি বাড়তে থাকে। এসময় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সিরাজগঞ্জে প্রজা সম্মিলনী আহ্বান করেন। মূলত এই সম্মেলনের উপর ভিত্তি করেই ১৯৩৬ সালে বঙ্গীয় কৃষি খাতক আইন ও ১৯৩৭ সালে ঋণ সালিশী বোর্ড স্থাপিত হয় এবং এর মাধ্যমে রাজনীতির ময়দানে ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ক্ষমতার প্রশ্নে মুসলিম সমাজ অর্ন্তদ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তা প্রশমিত করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া বাঙ্গালী হিন্দুরা মেজরিটি শাসন ও পূর্ন স্বায়ত্তশাসন উভয়ের বিরুদ্ধে থাকায় এই দুই অধিকারের জন্য আন্দোলনও খুব একটা জমে ওঠেনি। এর মাঝেই ফজলুল হক মন্ত্রীসভা গঠন করেন কিন্তু মন্ত্রীদের অর্š—দ্বন্দ্বের ফলে হক মন্ত্রীসভার পতন হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় হক মন্ত্রীসভার বিরোদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। কিন্তু হক সাহেব ততদিনে জাতির কাছে খাঁটি বাঙ্গালি ও খাঁটি মুসলিমের সংমিশ্রনে এক নতুন নেতৃত্বের স্বপ্নের দুয়ার উম্মোচন করেন। যার ফলে এই মন্ত্রীসভার (১৯৩৮-৪০) সময়টা বাংলার মুসলমান ও কৃষকপ্রজা খাতকের জন্য বিশেষ সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে।
.
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের পর জিন্নাহ ও সুভাষবাবু হিন্দু মুসলিম ঐক্যের আরেকটি উদ্যোগ নিলে তাও বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি মাহাত্মা গান্ধীর বিরূপ আচরনের কারনে। এরপর বাঙ্গালি জাতীয়তাবোধে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন কিন্তু আন্দোলনের একপর্যায়ে সুভাষবাবুর অন্তর্ধানে বাঙালী স্বাতন্ত্র্যের সংগ্রাম অনেকটাই স্থিমিত হয়ে পরে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে ফজলুল হক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার উদ্দেশ্যে কাজী নজরুল ইসলামকে নামে মাত্র সম্পাদক করে আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় নবযুগ পত্রিকার প্রচলন করেন। এরপর জিন্নাহ-হক দ্বন্ধে মুসলিম লীগ থেকে ফজলুল হক প্রত্যাবর্তন করেন ও শ্যামপ্রসাদকে নিয়ে প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পাটি গঠন করেন। এসময় ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে ভাগ্যগুনে হকসাহেব আবারো মন্ত্রীসভা গঠন করেন এবং নানাবিধ কারনে মুসলিম সমাজে অজনপ্রিয় হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে নাযিমুদ্দিন মন্ত্রীসভা গঠন করে এবং তার সময়েই (বাংলা ১৩৫০ সাল) ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ দেখা দেয় বাংলায়। ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আক্রমন প্রতিরোধের কৌশল হিসাবে খাদ্য মজুদ ও পরিবহন ধ্বংস করে ভারত সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবেই এ দূর্ভিক্ষর জন্ম দেয় বলে ধারনা করা হয়। ১৯৪৬ সালে খাজা নাযিমুদ্দিন হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলে সা¤প্রদায়িকতা নৃসংশ আকার ধারন করে এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। এসময় কলকাতাকে পূর্ববাংলার সাথে একীভূত করার জন্য হকসাহেব ও সোহরাওয়ার্দী বেশ চেষ্টা করেন কিন্তু পরে নাযিমউদ্দিন নেতৃত্বে আসার পর সে প্রচেষ্টায় ভাটা পড়ে। এসময় লিয়াকত আলী খাঁ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং বলিষ্ট নেতা সোহরাওয়ার্দীকে কোনঠাসা করে বাংলা প্রদেশে মুসলিম লীগ বিলুপ্ত করেন। তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন শুরু করা হয়। ১৯৪৮ সালে গান্ধীর মৃত্যুর পর ভারতের মুসলমানরা শংকিত হয় ও জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্যে স¤প্রদায়িকতা ঝড়ে পড়ে (তিনি বলেছিলেন ভারত একজন মহান হিন্দুকে হারালো)। ঠিক এসময়েই পাকিস্তানের গভর্নর জিন্নাহ সাহেব উর্দূকেই একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষনা করেন এবং তার প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে বাংলার ছাত্রসমাজ। ১৯৫০ সালে মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী সাহেব মুসলীম লীগের একক আধিপাত্যের বিপরীতে আওয়ামীলীগ এর ব্যানারে আরেকটি সংগঠন বেগবান করতে চাইলে নানাভাবে তাদেরকে বিব্রত করা হয়।
.
১৯৫১ সালে নাযিমুদ্দিনও মাতৃভাষা হিসেবে উর্দূকে ঘোষনা করলে পূর্ববাংলার মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা নিরব ভুমিকা পালন করে। পক্ষান্তরে সাধারণ শিক্ষার্থী সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মুসলীম লীগের উপর গনমানুষের তিক্ততা উপলব্ধি করে ১৯৫৪ সালে নির্বাচন দেয়া হয়। এসময় ফজলুল হক রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এসময়ই নির্বাচনী ইশতেহার হিসাবে ২১ দফা প্রণয়ন হয় ও নির্বাচনে ২৩৭ টি আসনের ২২৮ টি নিয়ে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। কিন্তু মন্ত্রীত্বের ভাগাভাগি নিয়ে হক-সরোয়ার্দী বিবাদের ফলে যুক্তফ্রন্টে ফাটল দেখা দেয়। যার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববাংলায় ৯২ক ধারা প্রয়োগ করে গভর্নর রুপে শাসন ক্ষমতা ইস্কান্দার মির্যাকে প্রদান করে এবং আওয়ামীলীগের উপর দমননীতি চালানো হয় সেক্রেটারী শেখ মুজিব সহ অন্যান্য নেতাদেও হয়রানি ও গ্রেফতারের মাধ্যমে। পরে প্রধানমন্ত্রী মোঃ আলীর ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্ট বিলুপ্ত হয়ে যায় ও আওয়ামীলীগ দূর্বল হয়ে যায়। পরে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার ও আওয়ামীলীগ ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র এবং ভাসানী কর্তৃক ন্যাপ গঠন তৎকালীন চলমান রাজনীতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্যা মার্শাল ল জারি করে ভাসানী, মুজিব, মনসুর আহমদ সহ অনেক জনপ্রিয় নেতাকে জেলে প্রেরন করে। এর মাঝেই জেনারেল আইয়ুব রাষ্ট্রক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেয়। গ্রেফতার, হয়রানি ও ষড়যন্ত্রের মধ্যে ১৯৬৯ সালে গনআন্দোলনের মুখে মার্চে এসে আইয়ুব খানের পতন ঘটে এবং ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াইয়া। মূলতঃ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখমুজিবকে গ্রেফতার-ই গনআন্দোলনে জোয়ার এনে দেয়। পরে ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামীলীগ ও পশ্চিমপাকিস্তানে পিপলস পার্টির একচেটিয়া জয় দুটি আলাদা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জানান দেয়। কেন্দ্রীয় পরিষদে ৩১৩ আসনের ১৬৭ টি জিতে আওয়ামীলীগ একক মেজরিটি দল হিসাবে সরকার গঠনের দাবীদার হয়ে উঠলে পশ্চিমারা ছয়দফা বাতিলের অজুহাতে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। এসময় ভূট্টো-ইয়াইয়া যোগসাজসে ঢাকায় বৈঠক স্থগিত করে এব; বাঙ্গালীর ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনের উপর পুলিশ গুলিবর্ষন করে। অতঃপর ৭ মার্চ জনতার সামনে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষন এবং সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষনা করা ও না করা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক, এসব ব্যাপারে লেখকের অভিমত স্থান পেয়েছে বইটির অনেক জায়গায় জুড়ে। ক্রান্তিকালে সিদ্ধান্ত দিতে মুজিবের দ্বিধাদ্বন্ধ ও ঘটনাকে নিয়ন্ত্রন না করে বরং ঘটনার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েও একজন ভাগ্যবান নেতা হিসেবে মুজিবের অভূতপূর্ব সাফল্য – এসব বিষয় বেশ আলোচিত হয়েছে এখানে। অবশেষে শেখ মুজিব পাকিস্তানের নেতৃত্বে এককভাবে না নিয়ে পশ্চিমপাকিস্তান ভূট্টোর হাতে ছেড়ে দেয়ার পর মুজিবের ভাগ্য নির্ধারিত হয় ভূট্টো-ইয়াইয়ার সিদ্ধান্তের উপর। (এক্ষেত্রে মুজিবের অদূরদর্শীতার কথা বোঝানো হয়েছে এখানে)। যার ফলে, ২৫ শে মার্চ ৭১, জাতির জীবনে নেমে আসে কালোরাত। অতঃপর শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। প্রথম দুই মাস কোনঠাসা বাঙালি জাতির উপর চলে অমানুতিক নির্যাতন, পরের পাঁচমাস চলে দখলদার বাহিনীর বিরোদ্ধে বাঙালির জনযুদ্ধ, শেষের দুইমাস জনসমর্থনহীন পাকবাহিনী ও জনমসর্থিত বাঙালী ও ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে একটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ। অতঃপর নয় মাসের ব্যবধানে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভুদয়। মূলতঃ ২৫ মার্চের নির্মম হামলা জাতির মনে যে বেগ সৃষ্টি করেছিল তা থেকে পাকিস্তান অখন্ডরাখা কোন ভাবেই সম্ভব হয় নাই। দেশস্বাধীনের পর বিভিন্ন নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে লন্ডন ও দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারী ১৯৭২, শেখ মুজিবের ঢাকা প্রত্যাবর্তনে স্বাধীন বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় দুষ্টচক্রের খেলার অবসান ঘটে। অতঃপর ভারত-বাংলাদেশ স¤প্রীতি, সমাজতন্ত্র-গনতন্ত্র বিতর্কের একপর্যায়ে ১৮ বছরে ভোটাধিকারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সংবিধান রচিত হয়। এর মাধ্যমে জাতীয় অধিকারের আন্দোলনে নিবেদিত ছাত্রসমাজের মূল্যায়ন করা হলো। কিন্তু সংসদে শেখ মুজিব “অপযিশন লিডার” পদ বিলুপ্ত করায় তা সংগ্রামী বাঙালী জাতির জন্য লজ্জ্বাজনক বিষয় হয়ে দাড়ায়। স্বাধীনতার পর আওয়ামীলীগ ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকবে বলে লেখক যে ভবিষ্যতবানী করেছিলেন তা আওয়ামী নেতাদের ক্ষমতালিপ্সতা ও অগনতান্ত্রিক আচরনের কারনে অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। বইটির বৃহত্তর অংশ জুড়ে পরিস্থিতির সাথে লেখকের অঙ্গাঅঙ্গি পদচারনায় বারবার দিয়ে এসেছে ফজলুল হকের বহুমুখী রাজনৈতিক মতাদর্শ। কখনো ইতিবাচক আবার কখনো নেতিবাচক রুপে উঠে এসেছে পূর্ববাংলার নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্র। তবে দেশ ভাগের (১৯৪৭ সালের পূর্বে) পূর্ব পর্যন্ত ধর্মই অধিকাংশক্ষেত্রে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করত। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। আর বইটির শেষ অংশে রাজনীতির অবস্থা স¤পর্কে লেখকের পর্যবেক্ষন গুলোই এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি কোন সময়ের বা জাতির ৫০ বছরের সামগ্রিক ইতিহাস নয় ইতিহাসের অংশ মাত্র। শুধুমাত্র সেই সময়ে লেখক যে ঘটনাগুলোকে ছুঁয়ে গেছেন তারই বহিঃপ্রকাশ আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর বইটি।