৪০. বিসর্গ (: ) ব্যবহার:
বিসর্গ একটি বাংলা বর্ণ— এটি কোনো চিহ্ন নয়। বর্ণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বিসর্গ (ঃ) হলো অঘোষ ‘হ্’-এর উচ্চারণে প্রাপ্ত ধ্বনি। ‘হ’-এর উচ্চারণ ঘোষ কিন্তু বিসর্গ (ঃ)-এর উচ্চারণ অঘোষ। বাংলায় ভাষায় বিস্ময়াদি প্রকাশে বিসর্গ (ঃ )-এর উচ্চারণ প্রকাশ পায়। যেমন— আঃ, উঃ, ওঃ, ছিঃ, বাঃ । পদের শেষে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার হবে না। যেমন— ধর্মত, কার্যত, আইনত, ন্যায়ত, করত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ ইত্যাদি। পদমধ্যস্থে বিসর্গ ব্যবহার হবে। যেমন— অতঃপর, দুঃখ, স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তঃস্থল, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। অর্ধ শব্দকে পূর্ণতা দানে অর্থাৎ পূর্ণ শব্দকে সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশে বিসর্গ ব্যবহার করা হলেও আধুনিক বানানে ডট ( . ) ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন— মোহাম্মদ> মো. (মোঃ), মোসাম্মত> মোসা. (মোসাঃ), ডাক্তার>ডা. (ডাঃ) ইত্যাদি। বিসর্গ যেহেতু বাংলা বর্ণ এবং এর নিজস্ব ব্যবহার বিধি আছে— তাই এ ধরনের বানানে (মোহাম্মদ>মো., ডাক্তার>ডা.) বিসর্গ ব্যবহার বর্জন করা হয়েছে। কারণ বিসর্গ যতিচিহ্ন নয়।
[সতর্কীকরণ: বিসর্গ (ঃ)-এর স্থলে কোলন ( : ) কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। যেমন— অত:পর, দু:খ ইত্যাদি। কারণ এটি কোনো বর্ণ নয়, চিহ্ন। যতিচিহ্ন হিসেবে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার যাবে না। যেমন— নামঃ রেজা, থানাঃ লাকসাম, জেলাঃ কুমিল্লা, ১ঃ৯ ইত্যাদি।]
বিসর্গসন্ধি:
বিসর্গ (ঃ )-এর সঙ্গে স্বরধ্বনি কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির যে সন্ধি হয়, তাকে বিসর্গসন্ধি বলে। উচ্চারণের দিক থেকে বিসর্গ দু রকম :
১. র্ -জাত বিসর্গ : শব্দের শেষে র্ থাকলে উচ্চারণের সময় র্ লোপ পায় এবং র্-এর জায়গায় বিসর্গ (ঃ) হয়। উচ্চারণে র্ বজায় থাকে। যেমন— অন্তর>অন্তঃ+গত=অন্তর্গত ( অন্তোর্গতো)।
২. স্-জাত বিসর্গ : শব্দের শেষে স্ থাকলে সন্ধির সময় স্ লোপ পায় এবং স্-এর জায়গায় বিসর্গ ( ঃ ) হয়। উচ্চারণে স্ বজায় থাকে। যেমন : নমস্ > নমঃ + কার = নমস্কার ( নমোশ্কার্)।
বিসর্গসন্ধি দু-ভাবে সাধিত হয় : ১. বিসর্গ ( ঃ ) ও স্বরধ্বনি মিলে; ২. বিসর্গ ( ঃ ) ও ব্যঞ্জনধ্বনি মিলে।
১. বিসর্গ ও স্বরধ্বনির সন্ধি:
ক. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে অ-ধ্বনি থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি স্থলে ও-কার হয়। যেমন—
ততঃ + অধিক = ততোধিক
যশঃ + অভিলাষ = যশোভিলাষ
বয়ঃ + অধিক = বয়োধিক
খ. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে অ, আ, উ-ধ্বনি থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি মিলে র হয়। যেমন—
পুনঃ + অধিকার = পুনরধিকার
প্রাতঃ + আশ = প্রাতরাশ
পুনঃ + আবৃত্তি = পুনরাবৃত্তি
পুনঃ + উক্ত = পুনরুক্ত
২. বিসর্গ ও ব্যঞ্জনধ্বনির সন্ধি
ক. অ-ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে বর্গের ৩য়/ ৪র্থ/ ৫ম ধ্বনি অথবা য, র, ল, হ থাকলে বিসর্গ ও অ-ধ্বনি স্থলে র-জাত বিসর্গে র/ রেফ (র্) এবং স-জাত বিসর্গে ও-কার হয়। যেমন—
র-জাত বিসর্গ : র্
অন্তঃ + গত = অন্তর্গত
পুনঃ + জন্ম = পুনর্জন্ম
অন্তঃ + ধান = অন্তর্ধান
পুনঃ + বার = পুনর্বার
অন্তঃ + ভুক্ত = অন্তর্ভুক্ত
পুনঃ + মিলন = পুনর্মিলন
স-জাত বিসর্গ : ও
মনঃ + গত = মনোগত
সদ্যঃ + জাত = সদ্যোজাত
তিরঃ + ধান = তিরোধান
তপঃ + বন = তপোবন
অধঃ + মুখ = অধোমুখ
মনঃ + যোগ = মনোযোগ
মনঃ + রম = মনোরম
মনঃ + লোভা = মনোলোভা
মনঃ + হর = মনোহর
খ. বিসর্গের পরে চ/ছ থাকলে বিসর্গের স্থলে শ; ট/ঠ থাকলে ষ এবং ত/থ থাকলে স হয়। যেমন—
নিঃ + চয় = নিশ্চয়
দুঃ + চরিত্র = দুশ্চরিত্র
ধনুঃ + টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার
নিঃ + ঠুর = নিষ্ঠুর
চতুঃ + টয় = চতুষ্টয়
দুঃ + তর = দুস্তর
নিঃ + তেজ = নিস্তেজ
ইতঃ + তত = ইতস্তত
দুঃ + থ = দুস্থ
গ. অ/আ ভিন্ন অন্য স্বরের সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে স্বরধ্বনি, বর্গের ৩য় / ৪র্থ / ৫ম ধ্বনি অথবা য, র, ল, হ থাকলে বিসর্গ স্থলে র হয়। যেমন—
নিঃ + অবধি = নিরবধি
নিঃ + আপদ = নিরাপদ
নিঃ + গত = নির্গত
নিঃ + ঘণ্ট = নির্ঘণ্ট
নিঃ + বাক = নির্বাক
নিঃ + ভয় = নির্ভয়
আবিঃ + ভাব = আবির্ভাব
আশীঃ + বাদ = আশীর্বাদ
দুঃ + অবস্থা = দুরবস্থা
দুঃ + আচার = দুরাচার
দুঃ + গতি = দুর্গতি
দুঃ + বোধ = দুর্বোধ
প্রাদুঃ + ভাব = প্রাদুর্ভাব
দুঃ + মর = দুর্মর
দুঃ + যোগ = দুর্যোগ
দুঃ + লভ = দুর্লভ
ঘ. র-জাত বিসর্গের পরে র থাকলে বিসর্গ লোপ পায় এবং প্রথমে ই-কার থাকলে তা ঈ-কার হয়। যেমন—
নিঃ + রব = নীরব
নিঃ + রস = নীরস
নিঃ + রোগ = নীরোগ
ঙ. অ/আ ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে ক, খ, প, ফ থাকলে বিসর্গ স্থলে স হয়। যেমন—
নমঃ + কার = নমস্কার
তিরঃ + কার = তিরস্কার
পুরঃ + কার = পুরস্কার
ভাঃ + কর = ভাস্কর
চ. ই/উ ধ্বনির সঙ্গে বিসর্গ এবং পরে ক, খ, প, ফ থাকলে বিসর্গ স্থলে ষ হয়। যেমন—
নিঃ + কাম = নিষ্কাম
নিঃ + পাপ = নিষ্পাপ
নিঃ + ফল = নিষ্ফল
বহিঃ + কার = বহিষ্কার
চতুঃ + পদ = চতুষ্পদ
চতুঃ + কোণ = চতুষ্কোণ
ছ. কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ধির বিসর্গ লোপ পায় না। যেমন—
প্রাতঃ + কাল = প্রাতঃকাল
মনঃ + কষ্ট = মনঃকষ্ট
শিরঃ + পীড়া = শিরঃপীড়া
অন্তঃ + করণ = অন্তঃকরণ
৪১. ম-ফলা ও ব-ফলার উচ্চারণ:
ম-ফলার উচ্চারণ:
ক. পদের প্রমে ম-ফলা থাকলে সে বর্ণের উচ্চারণে কিছুটা ঝোঁক পড়ে এবং সামান্য নাসিক্যস্বর হয়। যেমন— শ্মশান ( শঁশান্), স্মরণ (শঁরোন্)।
কখনো কখনো ‘ম’ অনুচ্চারিত থাকতে ও পারে। যেমন— স্মৃতি (সৃতি বা সৃঁতি)।
খ. পদের মধ্যে বা শেষে ম-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে সে বর্ণের দ্বিত্ব হয় এবং সামান্য নাসিক্যস্বর হয়। যেমন— আত্মীয় (আত্তিঁয়), পদ্ম (পদ্দোঁ), বিস্ময় (বিশ্শঁয়), ভস্মস্তূপ (ভশ্শোঁস্তুপ্), ভস্ম (ভশ্শোঁ), রশ্মি (রোশ্শিঁ)।
গ. গ, ঙ, ট, ণ, ন, বা ল বর্ণের সঙ্গে ম-ফলা যুক্ত হলে, ম-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যুক্ত ব্যঞ্জনের প্রথম বর্ণের স্বর লুপ্ত হয়। যেমন— বাগ্মী (বাগ্মি), যুগ্ম (যুগ্মো), মৃন্ময় (মৃন্ময়), জন্ম (জন্মো), গুল্ম (গুল্মো)।
ব-ফলার উচ্চারণ:
ক. শব্দের প্রমে ব-ফলা যুক্ত হলে উচ্চারণে শুধু সে বর্ণের উপর অতিরিক্ত ঝোঁক পড়ে। যেমন— ক্বচিৎ (কোচিৎ), দ্বিত্ব (দিত্তো), শ্বাস (শাশ্), স্বজন (শজোন), দ্বন্দ্ব (দন্দো)।
খ. শব্দের মধ্যে বা শেষে ব-ফলা যুক্ত হলে যুক্ত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন— বিশ্বাস (বিশ্শাশ্), পক্ব (পক্কো), অশ্ব (অশ্শো)।
গ. সন্ধিজাত শব্দে যুক্ত ব-ফলায় ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন— দিগ্বিজয় (দিগ্বিজয়), দিগ্বলয় (দিগ্বলয়)।
ঘ. শব্দের মধ্যে বা শেষে ‘ব’ বা ‘ম’-এর সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। যেমন— তিব্বত (তিব্বত). লম্ব (লম্বো)।
ঙ. উৎ উপসর্গের সঙ্গে ব-ফলা যুক্ত হলে ব-এর উচ্চারণ বহাল থাকে। যেমন— উদ্বাস্তু (উদ্বাস্তু), উদ্বেল (উদ্বেল্)।
[দ্রষ্টব্য: আমাদের অবশ্যই বাংলা বানান ও বাংলা বানানের উচ্চারণ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কারণ বাংলা বানান ও উচ্চারণের পার্থক্য রয়েছে। যেমন— আছ (আছো), দেখা (দ্যাখা), একা (অ্যাকা) ইত্যাদি।]
এই লেকচারের পরের পেইজে যেতে নিচের …. তে ক্লিক কর।