সুশাসন
প্রত্যয় হিসেবে ‘সুশাসন’এর আবির্ভাব ৯০ – এর দশকের প্রথমদিকে। দাতা সংগঠন এবং উন্নত দেশগুলো থেকে প্রাপ্ত সাহায্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার কিভাবে ব্যবহার করবে সেই ধারণার সাথে ‘সুশাসন’এর ধারণা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। এই পেক্ষাপটে ২০০৫-এর ৭ ও ৮ জুলাই স্কটল্যান্ডের গ্লেনেজলিতে হয়ে যাওয়া জি-৮ সম্মেলনে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নিম্ন আয়ের দেশগুলো এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, তারা প্রাপ্ত সাহায্য দারিদ্র্য নির্মূল, গণতন্ত্র এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করবে। আফ্রিকার অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা এই মর্মে একটি রিপোর্টও সেখানে প্রদান করেন। রিপোর্টটির মূল বক্তব্য ছিল সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাহায্যের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সাহায্য তখনই কার্যকর হয় যখন সরকারের দৃঢ় নীতিমালা থাকে, থাকে নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং সম্পদ আহরণের সক্ষমতা। এই বিষয়গুলোকে কার্যকর করণে যুক্তরাষ্ট্র মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্চ এ্যাকাউন্ট নামে একটি পদক্ষেপ নেয়। এখানে কাজ করা দীর্ঘ মেয়াদী পর্যবেক্ষকরা গুরুত্ব দেন সরকারের সংস্কার, স্বচ্ছতার জন্য পলিসি প্রেসক্রিপশন, আইনের শাসন, পাবলিক ফিন্যান্সে জবাবদিহিতা ইত্যাদির প্রতি। এরই ধারাবাহিকতায় নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী নোজি ওকোইয়া জোয়ালা ঘোষণা দেন, নাইজেরিয়ার সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। এর মধ্যে অর্থনীতিবিদ জগদিশ ভাগওয়াতি, জাতিসংঘের মহাসচিব এবং আফ্রিকার বিশেষ উপদেষ্টা ইব্রহিম গানবারি আহবান জানান, যে সমস্ত দেশে সুশাসন আছে, কেবল সেসমস্ত দেশেই ঋণ মউকুফ করবার। মূলত এই সমস্ত প্রেক্ষাপট ‘সুশাসন’ এর উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সুশাসনের কোন স্পষ্ট পরিমাপক না থাকায় টার্মটি এখনো পর্যন্ত অষ্পষ্ট রয়ে গেছে।যে শাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনের জবাবদিহিতা, বৈধতা, স্বচ্ছতা অংশগ্রহণ সুযোগ উন্মুক্ত, বাক-স্বাধীনতাসহ সকল রাজনৈতিক স্বাধীনতা সুরক্ষিত বিচার বিভাগ স্বাধীন আইনের শাসন উপস্থিত, আইনসভার নিকট শাসন বিভাগের জবাবদিহিতার নীতি কার্যকর সে শাসন ব্যবস্থাকে সুশাসন বলে।
সুশাসনের অন্যতম শর্ত- শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক, স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা।
সুশাসন প্রত্যয়টি ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক উদ্ভাবিত আধুনিক শাসন ব্যবস্থার সংযোজিত রূপ।
শাসন ব্যবস্থার সাথে ‘সু’ (ভাল/উৎকৃষ্ট) প্রত্যয় যোগ করে সুশাসন শব্দটি গঠিত হয়েছে।
সুশাসন এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Good governance. যার অর্থ নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন।
ম্যাককরনী’র মতে, ‘সুশান বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বোঝায়।
সুশাসনের বৈশিষ্ট্য-প্রশাসনের জবাবদিহিতা বৈধতা ও স্বচ্ছতা।
সুশাসনের অন্যতম শর্ত- জনগণের অংশগ্রহণের উন্মুক্ত সুযোগ, বাক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকারের সুরক্ষা, স্বাধীন বিচার বিভাগ, আইনের অনুশাসন এবং আইনসভার নিকট শাসন বিভাগের জবাবদিহিতা।
সুশাসনের মুল লক্ষ্য আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্ককে ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণকর করা।
’সুশাসনের’ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৮০ দশক থেকে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষ করে সাব-সাহারান দেশগুলোতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে। যেমন: আইএমএফ-এর পরামর্শে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ঘানায় ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়। কিন্তু, তারপরও ঘানা অবিরত বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যার সম্মুখিন হতে থাকে। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ঘানাতে যে স্ট্রাক্চারাল এ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম নেয়া হয়েছিল, সে সব মানুষের জন্য আশির্বাদ বয়ে আনতে পারেনি।
সুশাসনের ধারণা বহুপাক্ষিক দাতা সংগঠন এর্ব দাতা দেশগুলোর মাধ্যমে ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলোতে এসেছে। এখানে সরাসরি শাসনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে তুলে ধরা হয়। এর ধারণা যাই হোকনা কেন, তা সুশাসনকে প্রভাবিত করে এবং এটি সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে ইতিহাসকে বুঝতে তেমন ফলপ্রসূ হয়না। মূলত, শাসনের মধ্য দিয়ে কিভাবে মানুষ নিয়মে আবদ্ধ হয়, রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে সেসমস্ত কিছুই চিহ্নিত হয়।
দার্শনিক হব্স (Hobbes) ও লক (Locke)-এর মতে, ‘রাষ্ট্র একটি মৃত যন্ত্রের মতো’ হলেও ফরাসি বিপ্লবের মহানায়ক রুশো (Rousseau) বলেছেন ভিন্নকথা। তার মতে, ‘রাষ্ট্র একটি প্রাণবন্ত চলত্শক্তিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান।’ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রুশোর মতকেই অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। আসলে রাষ্ট্র কখনও গতিহীন নয় বরং এক নান্দনিক ও ছন্দময় গতিময়তায় আন্দোলিত। প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তায় আদর্শ রাষ্ট্রের লক্ষ্য উত্তম জীবন। তাই তিনি মনে করেন, শুধু তারাই আদর্শ রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণের যোগ্য যারা জানেন সমাজ জীবনের সর্বোত্তম পন্থা কী! শুধু তারাই শাসনদণ্ড ধারণ করার যোগ্য যারা নাগরিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা সম্পর্কে সচেতন এবং জ্ঞানের আলোয় সমুজ্জ্বল। সুতরাং রাজদণ্ড গ্রহণ যেমন সবার জন্য যৌক্তিক নয়, ঠিক তেমনিভাবে নাগরিকের উত্তর জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা বিধানে ব্যর্থতাও সফল রাষ্ট্রের মানদণ্ড নয়।
সুশাসনের ধারণা থেকেই আধুনিক রাষ্ট্রের উত্পত্তি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সরকার ক্রিয়াশীল থাকে। কোন দেশে কী ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকবে তা সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বোধ-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা সর্বোপরি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ধারার ওপর নির্ভর করে। তবে আধুনিক বিশ্ব গণতন্ত্রায়নের বিশ্ব। সেক্ষেত্রে আধুচলমান বিশ্ব, কারেন্ট আফেয়ার্স এর সকল আপডেট তথ্য পাবেন, আমাদের ব্লগে এবং আমাদের ফেসবুকে পেইজে facebook.com/eshikhon
পরের পাতাসমুহ >>
0 responses on "বিসিএস ক্র্যাশ - চিকিৎসা - 1"