বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া-চীন
.
কোন পথে ভূরাজনীতি?
,
আধুনিক ভূরাজনীতির মূল ধারাটা গেম অব থ্রোনের তরিকা মেনে চলছে, যেখানে বহু দেশ এত চাপের মুখে আছে যে, তাদের একমাত্র আশা, প্রতিপক্ষ তাদের আগে ভেঙে পড়বে। সে কারণে এসব দেশের সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে, আর প্রতিপক্ষের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হচ্ছেন এ তরিকার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সিরিয়া ও ইউক্রেনে তিনি যেটি করলেন, তাতে তাঁকে ভূরাজনীতির দস্যু বলে মনে পারে। কিন্তু তাঁর এই দুঃসাহসিকতার মূল উৎস হচ্ছে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা। তিনি যে ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ করলেন, সেটা আসলে নিজের জমানার বৈধতা নবায়ন করার জন্যই করেছিলেন।
রাশিয়ার প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশটিতে নানা অবরোধ আরোপ করেছিল। তারা ভেবেছিল, রাশিয়ার অর্থনীতি যেহেতু গ্যাস ও তেলকেন্দ্রিক, তাই অবরোধ আরোপ করলে দেশটির অভিজাত মহলে ফাটল দেখা দেবে। অন্যদিকে পুতিন আশা করছেন, ইউক্রেনের ধসে পড়ার আগ পর্যন্ত রুশ অর্থনীতি টিকে থাকবে। এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ক্রেমলিন ইউক্রেনকে অস্থিতিশীল করার কোনো চেষ্টাই বাদ দেয়নি—তারা যেমন সামরিক অভিযান চালিয়েছে, তেমনি ইউক্রেনের রাজনীতিকে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছে, আবার জ্বালানি খাতে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং তথ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।
পুতিন বিশ্বাস করেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যে ভুল ছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই ভুলে দুষ্ট। তিনি মনে করেন, এটা এক অবাস্তব বহুজাতিক প্রকল্প, যেটা তার নিজের বৈপরীত্যের চাপেই ভেঙে পড়বে। এ ক্ষেত্রেও ক্রেমলিন একই কাজ করল, তারা আগুনে ঘি ঢালার জন্য ইউরোপজুড়ে অতি ডানপন্থী দলগুলোকে উসকানি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, পুতিন এই আশায় বুক বেঁধেছেন, যুক্তরাজ্য যদি গণভোটের মাধ্যমে ব্রেক্সিট করেই ফেলে এবং ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের মেরি লা পেন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, সেটা আর চালিয়ে যেতে পারবে না।
এখানেই শেষ নয়, তুরস্ক গত নভেম্বরে এক রুশ বিমান ভূপাতিত করলে রাশিয়া তুরস্কের পেছনেও লাগে। অভিযোগ আছে, তিনি জঙ্গি সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে অস্ত্র দিয়েছেন। রাজনীতি বিজ্ঞানী ইভান ক্রাস্তেভ বলেন, ‘মনে হচ্ছে, পুতিন তুর্কি অর্থনীতির পা ভেঙে দেওয়া এবং এরদোয়ানের রাজনীতিকে খাটো করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।’ ওদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের রাজতন্ত্র ও ইরানের ধর্মতন্ত্র অস্তিত্বের জন্য এক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। বহু বছর আন্তর্জাতিক অবরোধের মুখে থাকায় ইরানের অর্থনীতি ভঙ্গুর দশায় পতিত হয়েছে, আবার দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করার পরও অর্থনীতি পুনর্গঠনে এর সুযোগ নিতে পারেনি। কিন্তু তারা বিশ্বের শিয়া মুসলমানদের নেতা হিসেবে জনগণের সমর্থন পেয়েছে, যারা আবার ইরাক, সিরিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনে সৌদি আরবকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে।
ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সৌদ বংশের পতন এখন মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক রাজনৈতিক ভাষ্যের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সৌদি আরব বাজি ধরেছে, তারা বহুদিন তেলের দাম কম রাখতে পারবে এবং মার্কিন জ্বালানি কোম্পানি শেলকে ব্যবসা করতে দেবে না। সৌদি তেলমন্ত্রী আলী আল-নাইমি বলেই দিয়েছেন, ‘তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ২০ ডলারে নামলেও তেলের উৎপাদন কমানো হবে না। দাম কমলে তো কমবেই। কিন্তু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই অন্যরা মারাত্মকভাবে ভুগবে।’
এবার আরও পূর্বদিকে যাই। চীনাদের বিশ্বাসের সৌধ তো ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। বিশ্লেষক মিনঝিন পেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শাসনের অবসান হতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রবৃদ্ধির হার কমছে। আর পার্টিও একদম এলোমেলো হয়ে পড়েছে, কারণ তারা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ মেটানোর জন্য যে নিয়মকানুন করেছিল, তা ভেঙে পড়েছে…ওদিকে মধ্যবিত্তের যে মৌন সম্মতি ছিল, সেটাও পরিবেশ বিপর্যয়, নিম্নমানের সেবা, অসমতা ও দুর্নীতির কারণে নষ্ট হতে বসেছে।’
চীনা শাসকেরা অবশ্য বাজি ধরেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচক একদম নাক বরাবর পড়ে গেলেও দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে, যার মাধ্যমে এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাবে। তবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আশাবাদী হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ভয়াবহ অবস্থা। অনেক বছর ধরেই কংগ্রেস অভ্যন্তরীণ সংস্কারকে কেন্দ্র করে স্থবির হয়ে আছে, আর পৃথিবী তো এখন ভাবছে, সামনের নভেম্বরের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে গেলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
চীনা জাতীয়তাবাদীরা আশা করে, পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিক ক্ষমতা কমে এলে তারা সেখান থেকে হাত গুটিয়ে নেবে, যেভাবে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকে সরে গেছে। গত মাসে চীনের কাগজ পিপলস ডেইলিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখক সন্দেহ প্রকাশ করেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল করে এ অঞ্চলে চীনকে মূল শক্তি হতে সাহায্য করতে পারে। তারা মনে করে, মার্কিন জনগণ আন্তর্জাতিক বিষয়ে তেমন মাথা ঘামায় না, এমনকি হিলারি ক্লিনটনও যদি নির্বাচনে জেতেন, তাহলেও তারা মুক্ত বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করার নীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
নিজের নাক কেটে হলেও অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা বাণিজ্যের জগতে খুবই পরিচিত এক কৌশল, যেখানে কোম্পানিগুলো মূল্যের যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা আশা করে, প্রতিযোগী কোম্পানিরই প্রথম লালবাতি জ্বলবে, ফলে তারা মাঠ ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু ভূরাজনীতিতে এটা তেমন এটা দেখা যায় না।
ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ১৯৯২ সালে দ্য এন্ড অব হিস্টরি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান গ্রন্থে বলেছেন, পৃথিবী আর্থসামাজিক উন্নয়নের শেষ প্রান্তে চলে গেছে। তাঁর মতে, ‘উদার গণতন্ত্রই’ হলো সেই লাস্ট ম্যান বা শেষ ব্যক্তি, এই উন্নয়নের শেষ প্রান্ত। এর চেয়ে বড় ভুল তিনি করতে পারেন না। আজ বিশ্বের মহান শক্তিগুলো নিজেদের শেষ ব্যক্তি হিসেবে দাবি করছে না, তারা শুধু আশা করতে পারে যে, শেষ ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে আছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
মার্ক লিওনার্ড: ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের পরিচালক।
প্রথম আলো। ১জুন।
0 responses on "বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া–চীন"