২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যা:
এ বছরের ভয়াবহ বন্যায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশের ৩৫টির ওপর জেলা এখন বন্যার কবলে। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা বর্ত মানে ১৪০ জন কিন্তু নিখোঁজ রয়েছে আরো অনেক মানুষ। সরকার ১৫ লাখের মত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বললেও, বিভিন্ন জেলায় খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা পয়ত্রিশ (৩৫) লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
২০০ বছরের ইতিহাসে ২০১৭ সালের এই সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখিন বাংলাদেশ। ভয়াবহ বন্যায় পানির নিচে তলিয়ে যাবে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ দুই-তৃতীয়াংশ জেলা। আগামী ৫ দিনের মধ্যে ঢাকার কিছু কিছু জায়গা প্লাবিত হতে পারে বলেও ধারণা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তাই সবাইকে সর্তক ও পূর্ব প্রস্তুতিমুলক ব্যবস্থাগ্রহণের নিদের্শ দেওয়া হয়েছে।
বন্যায় রোগসমুহ: পেটের পীড়া (ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড), বুকের প্রদাহ, জ্বর, চর্মরোগ, চোখের অসুখ, সর্প দংশন।
বন্যায় সময় সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকতে যেটি করবেন:
বন্যা আসে, বন্যা যায়। ধকলটা থাকে দীর্ঘ সময়। ধকল যেহেতু আসবেই, তাই আগেভাগে নিজেদের প্রস্তুত করে রাখা শ্রেয়। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতি হয় গ্রামাঞ্চলে। যার প্রভাব পড়ে শহরসহ সারাদেশেই। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের নানান উপায়ে এই সময়ে সচেতন করে রাখা উচিত।
বন্যায় সৃষ্ট রোগবালাই থেকে সুরক্ষা পেতে:
- যেহেতু বন্যায় পানির উত্স সংক্রমিত হয়ে যায় তাই পানি ভালোমতো না ফুটিয়ে পান করা নিরাপদ নয়।
- টিউবওয়েলের পানিও ফুটিয়ে পান করতে হবে। পানি ফুটানোর ব্যবস্থা না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (হ্যালোট্যাব) ব্যবহার করতে হবে।
- ডায়রিয়া দেখা দিলেই পরিমাণমতো খাবার স্যালাইন খেতে হবে। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী বন্যার্তদের সাহায্যে নিয়োজিত রয়েছেন তাদের কাছে পর্যাপ্ত স্যালাইন থাকতে হবে। যদি পাতলা পায়খানা ও বমির মাত্রা বেড়ে যায় সে ক্ষেত্রে শিরাপথে স্যালাইন দিতে হবে।
- বন্যায় নিরাপদ পয়ঃপ্রণালীর অভাব ঘটে। পয়ঃনিষ্কাশন নিরাপদ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময়ে কৃমির ওষুধ খেতে হয়। কেননা নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবে কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। যেখানে সেখানে পায়খানা না করে একটি নির্দিষ্ট নিরাপদ পায়খানার ব্যবস্থা করতে হবে।
- খাবার গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। খাবার যাতে পচে না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
- বন্যায় চর্মরোগ হতে পারে। যতটা সম্ভব শরীর শুকনো রাখতে হবে। একই গামছা বা তোয়ালে অনেকজন ব্যবহার করবেন না।
- চোখের প্রদাহ হলে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে গুটিয়ে রাখবেন। কেননা সমস্যাটি ভাইরাসজনিত হলে তা অন্যদের মাঝেও সংক্রমিত হবে। ক্লোরাম ফেনিকল আই ড্রপ হাতের কাছে রাখতে হবে। নিকটস্থ স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিত্সকের পরামর্শক্রমে তা ব্যবহার করতে হবে। চোখে অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- বন্যায় মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। ব্যাপক মশা নিধনের ব্যবস্থা না করলে ম্যালেরিয়া হতে পারে।
- এক সময় মনে করা হতো বন্যা পাপের ফল। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো বন্যা এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবেলা করতে হলে সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে। বন্যাকে নিয়তির লিখন হিসেবে চিহ্নিত না করে বন্যায় যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে তার নিরসন করতে কার্পণ্য করা উচিত নয়।
বন্যায় সম্পদ, জানমাল সুরক্ষায় করণীয়:
- বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে শাক-সবজি, শস্য, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগীসহ নিজেদের পরিবার পরিজন ও আবাসস্থল রক্ষায় চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যান গ্রামের মানুষ। এই অবস্থায় মাথায় হাত দিয়ে হতাশায় ডুবে যাবার মানে নেই। এমন পরিস্থিতিতে কী করণীয় তার একটা ছোট ধারণা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো-
- বন্যায় যদি বীজতলা ডুবে যায়, তাহলে নানানভাবে চারা উৎপাদনের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখা ভালো। যেমন – কলাগাছের ভেলা বানিয়ে সেই ভেলার উপর কাদামাটির প্রলেপ দিয়ে বীজ ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। আর যদি বীজতলায় কোনো চারা আগে থেকেই থাকে তাহলে মাটিসহ তুলে কোনো উঁচুস্থানে রাখতে হবে।
- বন্যার পানি বেড়ে যাবার সাথে সাথে ড্রাম, টব, চাড়ি বা অন্য কোনো বড় পাত্রে মাটিসহ গাছের চারা রোপণ করে উঁচুস্থানে রাখতে হবে।
- বন্যায় মাছ চাষের বরাদ্দকৃত জায়গার চারপাশে পানি থেকেও কয়েক ফুট উঁচু জাল দিয়ে রাখতে হবে।
- গবাদিপশু রক্ষায় আগেভাগেই ক্কুরা, বাদলা, তড়কা ও অন্যান্য রোগের টিকা দিতে হবে। বন্যায় যদি কোনো গবাদিপশু মারা যায়, তাহলে সেই মরা পশু পানিতে ভাসিয়ে না দিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
- বন্যার সময় হাঁস –মুরগীর কৃমির প্রকোপ বাড়ে, তাই আগেভাগে এসবের ওষুধ খাওয়াতে হয়। তবে সবচেয়ে উত্তম কাজ, বন্যার সময় হাস-মুরগি বিক্রি করে ফেলা।
- গাছের যত্নে গাছের গোড়ায় মাটি দিতে হয়, চারাগাছ হলে খুঁটি দিতে হয়, বন্যার পর রাসায়নিক সার ও জৈব সার প্রয়োগ করতে হয়।
- বন্যার সময় খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এ জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ রাখতে হবে। সময়মতো ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সরবরাহ করাও অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া বন্যার পানি চলে যাওয়ার পরও দেখা দেয় ডায়রিয়াসহ নানা রোগব্যাধি। এ জন্য খাওয়ার স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে।
আরো দেখুন:
বন্যায় সময় সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকতে যেটি যা করণীয়
বন্যায় রোগসমুহ ও সুরক্ষা পেতে করণীয়
উত্তরাঞ্চলে বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি ২০১৭
ভারি বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
0 responses on "বন্যায় সময় সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকতে যা যা করণীয় (সর্তকতা ও পূর্ব প্রস্তুতি এবং বন্যার সময়ে করণীয়)"