নোটারি পাবলিক
নোটারি কী, কেন এবং কিভাবে করানো হয় এই সকল বিষয়ে অভিজ্ঞ লোক সচরাচর খোঁজে পাওয়া যায় না। ফলে এই সংক্রান্ত কোনো কাজের প্রয়োজন পড়লে আমদেরকে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হতে হয় আর এই সংক্রান্ত ভোগান্তির কথা নাইবা বললাম।
আপনাদের এই বিষয়ে অদ্ভুত প্রশ্নসমূহের উত্তর উপস্থাপিত করার প্রয়াস রয়েছে নিম্নের লেখায়।
সরকারি কর্মকর্তাকে দিয়ে ছবি সত্যায়িত করার অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আছে অনেকের। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজের নিমিত্তে এই কাজটি আমাদের বিভিন্ন সময় করা প্রয়োজন হয়ে পরে।
নোটারিও সত্যায়িত করার মতোই একটি বিষয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আপনার বিভিন্ন দলিল বা ডকুমেন্ট সরকারিভাবে সত্যায়িত করাকেই নোটারি বা নোটারি পাবলিক বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নোটারির প্রচলন রয়েছে।
আর একটু কঠিন ভাষায় বললে – “কোন বিনিময়ে দাবিকৃত অর্থের প্রতিবাদ জানানো এবং প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রের অন্যান্য বিষয় ও আইনি দায়িত্ব পালনের জন্য চুক্তিপত্র, কবুলিয়তনামা ইত্যাদির খসড়া প্রণয়ন অথবা সনদ প্রদান করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন সরকারি কর্মকর্তার অনুমোদন প্রাপ্তিকে বোঝায়।
নোটারি পাবলিককে সংক্ষেপে নোটারি বলা হয়ে থাকে। নোটারি শব্দের মূল নামপদ ‘note’ এবং ‘ary’ অনুসর্গ নিয়ে গঠিত। শব্দটি এসেছে লাতিন ভাষার nota+arius থেকে, এর অর্থ শর্টহ্যান্ড লেখক, কেরানি ইত্যাদি।
যারা নোটারি করতে পারবেনঃ
বাংলাদেশের আইন অঙ্গনেও নোটারি পাবলিক এক অতি পরিচিত নাম। নোটারিস অর্ডিনেন্স এবং নোটারিস রুলস , ১৯৬৪ দ্বারা বাংলাদেশে নোটারি পেশা নিয়ন্ত্রিত হয় । সাধারণত কোন ব্যক্তি যিনি কমপক্ষে সাত বছর আইনজীবী হিসেবে কর্মরত আছেন অথবা বিচার বিভাগের সদস্য হিসেবে কমপক্ষে পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন অথবা সরকারের লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং এবং সরকারের আইন প্রনয়ণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি নোটারি হিসেবে নিয়োগ পাবার যোগ্য।
নোটারি কেন করা হয়?
গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে ডকুমেন্ট উপস্থাপন করতে হলে সাধারণত নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সত্যায়িত করে জমা দিতে হয়। যেমন-
১) কোন দলিল প্রতিপাদন, প্রামাণীকরণ, সনদ প্রদান কিংবা সত্যায়ন।
২)ঋণখত,হুন্ডি গ্রহণ অথবা পরিশোধের জন্য দাবিনামা অথবা অধিকতর নিরাপত্তা বিধান দাবিনামা তৈরি।
৩) কোন ঋণখত, হুন্ডি বা দাবিনামা গ্রহনীয় বা পরিশোধিত না হয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে অথবা অধিকতর নিরাপত্তার বিধানের জন্য প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করা অথবা প্রতিবাদ জানানো নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট ১৮৮১ এর আওতায় Acts of Honour প্রস্তুত করা অথবা এসব নোট বা প্রতিবাদের নোটিশ প্রেরণ।
৪) জাহাজের প্রতিবাদ, নৌকার প্রতিবাদ অথবা ক্ষয়ক্ষতি অন্যান্য বাণিজ্যিক বিষয় সংশ্লিষ্ট বিষয় নোট করা এবং খসড়া প্রণয়ন।
৫) কাউকে শপথবাক্য পাঠ করানো অথবা এফিডেভিট নেওয়া।
৬)বিমাচুক্তি ও পণ্যের ওপর ঋণ নেওয়ার বন্ড প্রস্তুত করা, চুক্তির বিভিন্ন পক্ষ ও অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের চুক্তি তৈরি।
৭) বাংলাদেশের বাইরে যে কোন জায়গায় কর্যকর হবে এমন উদ্দেশ্যে কোন দলিল তৈরি, সত্যায়ন ও প্রমাণীকৃত করা-এমনভাবে ও ভাষায় যেন তা সেখানকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
৮) এক ভাষায় থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা এবং অনুবাদের যথার্থতা যাচাই করা।
৯) নির্দেশনা সাপেক্ষে অন্য কোন কাজ সম্পাদন।
এ ছাড়া পেমেন্ট অথবা ডিমান্ডের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা জোরদার করতে, বটম্রি এবং রেসপনডেনটিয়া বন্ড (bottomry and respondantia bonds ), চার্টার পার্টি এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক দলিলপত্র তৈরিতে নোটারির ব্যবহার রয়েছে।
যেভাবে করা যায়ঃ
নোটারি পাবলিক করতে গেলে একজন আইনজীবী প্রথমেই আপনার মূল কাগজপত্র যাচাই করে দেখবেন। মূল কাগজপত্র বলতে বোঝায় আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, জন্ম সনদ, চারিত্রিক সনদ ইত্যাদি। আর আপনি যদি বিয়ে, তালাক কিংবা হলফনামা তৈরি করতে চান তাহলে উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে আপনার নোটারি করতে হবে। এসকল বিষয়ে সমূহ যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হয়ে তিনি সত্যায়িত করবেন।
নোটারি বিধিমালা (৬০ক) অনুযায়ী, একজন নোটারিয়ান বা যিনি নোটারি করে দেন তাঁর নির্দিষ্ট কার্যালয় থাকতে হবে। আর নোটারি করার সাইনবোর্ড কার্যালয় ছাড়া অন্য কোথাও ঝোলানো যাবে না।
নোটারি করতে যে খরচঃ
নোটারি পাবলিক করতে গেলেই সবার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে কেমন খরচ লাগবে নোটারি করতে। এই বিষয়ে যিনি অভিজ্ঞ তিনিই কেবল পারবেন এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে। তবে যদি উপযুক্ত ব্যাক্তির কাছে এই প্রশ্ন না করা হয় তবে আপনি বিভিন্ন ভুল তথ্য পেয়ে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত হতে পারেন।
এক্ষেত্রে উল্লেখ যে এক শ্রেণীর দালাল নোটারি পাবলিকের ব্যবসা খুলে সাধারণের কাছ থেকে হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ কাজের জন্য সরকারের নির্ধারিত ফি রয়েছে। সরকার নির্ধারিত ফি সত্যায়নের কাজে ১০ টাকা, আর যেকোনো স্ট্যাম্পে হলফনামা, চুক্তিপত্রের ক্ষেত্রে ২০-২৫ টাকা খরচ হয়। অথচ মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে জানা যায় যে অনেক নোটারি পাবলিক প্রার্থীদের কাছ থেকে ৫০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকেন যেটি বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কুচক্রি মহল হইতে সাবধানতাঃ
আইনানুযায়ী কাগজপত্র নোটারি করার সময় আপনার নিজের আইনজীবীর সামনে উপস্থিত থাকতে হবে। অনেক সময় প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে নোটারির কাজ সম্পাদন ও ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে নোটারি করা হয়। যেটি আপনার জন্য বয়ে আনতে পারে সমূহ বিপদ ও আইনি ঝামেলা।
সাধারণত নোটারির কাজ হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। অনেক অবৈধ মহল নোটারি পাবলিক নামে নিজেরাই সিলমোহর বানিয়ে প্রতারিত করে থাকেন। কাজেই এ বিষয়ে সতর্ক নজর রাখতে হবে। তাছাড়া মারা গেছেন এমন নোটারি পাবলিকের সিলমোহর ব্যবহার করেও অনেকে প্রতারিত করতে পারেন। বয়সের মিথ্যা তথ্য দেওয়া সনদ, বিবাহবিচ্ছেদ ও মামলার কাজে মিথ্যা হলফনামা, পেছনের তারিখে দলিল তৈরি, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত বানিয়ে আমমোক্তারনামা বানানো, মিথ্যা চুক্তিপত্র, ভুয়া আপসনামাসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা সনদ এবং দলিল সম্পাদনার কাজ করছেন এক শ্রেণীর অবৈধ নোটারি পাবলিক।
0 responses on "নোটারি পাবলিক"