
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার পাশাপাশি নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও নিজস্ব স্বকীয়তা ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের হয়তো অনেক ভাষা শিখতে হবে, অনেক কিছু জানতে হবে, প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু আমাদের স্বকীয়তা; সেটা কিন্তু আমাদের বজায় রাখতে হবে। সেটা বজায় রেখেই আমরা এগিয়ে যেতে পারি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য যেন কখনো ভুলে না যাই।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের প্রত্যেকটা অর্জনের পেছনে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অনেক ঐতিহ্য রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ঐতিহ্য তুলে ধরার সুযোগও আছে। স্বাধীনতার অর্জন যেন কোনোভাবেই নস্যাৎ না হয় সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
এ দেশের মাটিতে এখনো পাকিস্তানি প্রেতাত্মা রয়ে গেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হয়তো পাকিস্তান নামক দেশটা থেকে আলাদা হয়ে আজকে আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। কিন্তু সেই পাকিস্তানিদের কিছু প্রেতাত্মা এখনো এ মাটিতে রয়ে গেছে, যারা তাদের ওই প্রভুদের ভুলতে পারে না বলেই আমাদের ঐতিহ্যের ওপর আঘাত আসে, ভাষার ওপর আঘাত আসে। বার বার আমাদের সংগ্রাম করতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক অধিকারের ওপর আঘাত আসে।
ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে সবার সহযোগিতা চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইতিহাস পর্যন্ত বিকৃত করা হয়েছিলো। বাঙালি হিসেবে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে আমাদের যে মর্যাদা সেটাও কিন্তু হারিয়ে যেতে বসেছিলাম। অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
ভিন্ন ক্ষেত্রে ‘গৌরবদীপ্ত অবদানের’ স্বীকৃতি হিসেবে ২১ বিশিষ্ট নাগরিক এবার একুশে পদক পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মনোনীত ও তাদের প্রতিনিধিদের হাতে পদক তুলে দেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালের একুশে পদকের জন্য মনোনীতদের নাম ঘোষণা করে। পদক বিজয়ী প্রত্যেকে পেয়েছেন ১৮ ক্যারেট মানের ৩৫ গ্রাম সোনার একটি পদক, দুই লাখ টাকার চেক ও সম্মাননাপত্র।
ভাষা আন্দোলনের জন্য এবার মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আ জ ম তকীয়ূল্লাহ। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে তকীয়ূল্লাহ বাংলাদেশের বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রণেতা।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের যেসব আলোকচিত্র এখনও পাওয়া যায়, সেগুলো তকীয়ূল্লাহরই তোলা। তার মেয়ে শান্তা মারিয়া অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে বাবার পদক গ্রহণ করেন।
তকীয়ূল্লাহর সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে এ বছর একুশে পদক পেয়েছেন অধ্যাপক মির্জা মাজহারুল ইসলাম। ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন মাজহারুল ইসলাম । ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে তিনি প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে যুক্ত ছিলেন।
সেই আন্দোলনে বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি নিজে যেমন পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, ১৯৫২ সালের একুশ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলির পর আহত অনেক ভাষাসৈনিককে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাও দিয়েছিলেন।
সংগীতে অবদানের জন্য এবার একুশে পদক পেয়েছেন শেখ সাদী খান, যিনি সংগীত পরিচালক হিসাবে তিনবার ‘বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ পেয়েছেন এর আগে।
একই বিভাগে একুশে পদক পেয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত পরিচালক ও সুরকার সুজেয় শ্যাম, ইন্দ্র মোহন রাজবংশী, মো. খুরশীদ আলম ও মতিউল হক খান।
‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘মুজিব একই পথ সংগ্রাম’ ও ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’সহ একাত্তরের অনুপ্রেরণাদায়ী নয়টি গানের সুর ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম। ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে তার সংগীত পরিচালনায় লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ।
নৃত্যে এবার একুশে পদক পেয়েছেন মীনু হক, যিনি মীনু বিল্লাহ নামেই বেশি পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৭ বছর বয়সী মীনু হক ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে’ সেবিকার ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগের কার্যক্রম চালুর ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
অভিনয়ে এবার মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি, যার অনুষ্ঠানিক নাম হুমায়ূন কামরুল ইসলাম। চার দশকের বেশি সময় মঞ্চ, টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করা এই শিল্পীর পক্ষে তার মেয়ে শারারাত ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক গ্রহণ করেন।
এ বছর নাট্যকলায় অবদানের জন্য নিখিল সেন (নিখিল কুমার সেনগুপ্ত), চারুকলায় কালিদাস কর্মকার এবং আলোকচিত্রে গোলাম মোস্তফা একুশে পদক পেয়েছেন।
কালিদাস কর্মকার বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রশিল্পে বিভিন্ন মাধ্যম ও আঙ্গিকের প্রবর্তন করেছেন। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম মিশ্র মাধ্যম শিল্প, পরিবেশ শিল্প, স্থাপন শিল্প ও পারফরমেন্স শিল্পের সূচনা করেন।
গবেষণার জন্য এবার মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন ভাষাসৈনিক অধ্যাপক জুলেখা হক। তার মেয়ে তুষা হক প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক গ্রহণ করেন।
সাংবাদিকতায় এবারের একুশে পদক পাওয়া রণেশ মৈত্র একাধারে সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, লেখক ও সংগঠক। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন মেয়াদে মোট দশবার কারারুদ্ধ হয়ে বিনা বিচারে ১৫ বছর কারাভোগ করেন। কারাগারেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন। রণেশ মৈত্র দেশের বাইরে থাকার তার পক্ষে পদক গ্রহণ করেন তার ছেলে প্রলয় মৈত্র।
সমাজসেবায় এ বছর একুশে পদক পেয়েছেন অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর তিনি শুরু করেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন। ২৪ বছরে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে তিনি সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেছেন। পাঁচশর বেশি এসএসসি পাস বেকার যুবককে বিনামূল্যে গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণ দিয়েছে তার সংগঠন।
এছাড়া অর্থনীতিতে ড. মইনুল ইসলাম, ভাষা ও সাহিত্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম খান (কবি হায়াৎ সাইফ ), সুব্রত বড়ুয়া, রবিউল হুসাইন এবং প্রয়াত খালেকদাদ চৌধুরীর পক্ষে তার ছেলে হায়দারদাদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক গ্রহণ করেন।
আরো পড়ুন: