আন্তর্জাতিক রাজনীতি ,চীন এখন সামরিক পরাশক্তি

আন্তর্জাতিক রাজনীতি
চীন এখন সামরিক পরাশক্তি

=

চীন উত্তরোত্তর এক সম্প্রসারণবাদী সামরিক শক্তি হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে। বিশ্বজুড়ে আপন শক্তিকে জাহির করার পাশাপাশি চীন বিদেশে ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। চীনের সশস্ত্রবাহিনীর উপর সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশটির বৈশ্বিক সামরিক আশা আকাক্সক্ষাগুলো প্রকাশ পেয়েছে বলে পেন্টাগন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
.
এর আগের কয়েক দশকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে চীনের প্রধান সামরিক দৃষ্টি তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা আঞ্চলিক যুদ্ধ চালানোর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। সেই প্রস্তুতির রূপটা হলো একশ মাইল চওড়া তাইওয়ান প্রণালীজুড়ে সংঘর্ষের লক্ষ্যে তার বাহিনীর আধুনিকায়ন ঘটানো।

তবে সমালোচকরা চীনের এতদিনের দেয়া এই ব্যাখ্যাকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ওটা ছিল চীনের আসল উচ্চাভিলাষকে আড়াল করার প্রয়াস। আর সেই উচ্চাভিলাষ হলো বিশ্ব পরাশক্তি আসন থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে দিয়ে সে স্থানটি দখল করে নেয়া এবং চীনা প্রেসিডেন্ট জি জিনপিংয়ের ভাষায় চীনের স্বপ্ন পূরণ করা যেখানে চীন বিশ্বে একটা আঞ্চলিক আধিপত্যকারী শক্তিমাত্র থাকবে না বরং হবে এক বৈশ্বিক পরাশক্তি।
.
এক দশক আগে অনেকের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে চীনের সামরিক উচ্চাভিলাষ শুধু তাইওয়ান অঞ্চলকে ঘিরে আবদ্ধ নয় বরং বিশ্ব পরিসরে ব্যাপ্ত। মার্কিন বিশ্লেষক রিক ফিশারের মতে গত ১৫ বছর ধরে চীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলেছে এবং সেটাকে এখন সামরিক সুযোগ-সুবিধা ও প্রভাবে রূপান্তরিত করছে। চীন যেভাবে বৈশ্বিক সামরিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের পথে এগোচ্ছে তাতে ২০২০ এর দশক নাগাদ শেষটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নতুন হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে ফিশার উল্লেখ করেন।
.
প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, চীন ভারত মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের গভীর জলরাশিতে সামরিক শক্তি মোতায়েনের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তা লাভের জন্য আগে থেকে বিদেশীবন্দর ব্যবহারের সুযোগ সম্প্রসারিত করছে। মার্কিন সামরিক পরিকল্পকদের কাছে বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো এই যে চীন লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মধ্যবর্তী স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বপূর্ণ আফ্রিকাশৃঙ্গে অবস্থিত ক্ষুদে রাষ্ট্র জিবুতিতে সামরিক সহায়তা স্থাপনা গড়ে তুলতে যাচ্ছে। চীন অবশ্য বলেছে যে, এই স্থাপনা তার সেনা ও নৌবাহিনী জাতিসংঘ শান্তি মিশনে, সোমালিয়া ও এডেন উপসাগরে এসকর্ট অভিযানে এবং মানবিক সাহায্য যোগানোর কাজে ব্যবহার করা হবে। তবে ব্যাপারটা শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিদেশে এ জাতীয় স্থাপনা ও ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে চীন তার ভূ-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি চরিতার্থ করতে চায়। নিজের প্রভাব ও সশস্ত্র বাহিনীর আওতা প্রসারিত করতে চায়। চীন নিজের আধুনিকায়নের জন্য বিদেশী তেলের উপর ক্রমবর্ধমান হারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এই তেল আনা নেয়ার গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক যোগাযোগ পথগুলো রক্ষা করার কাজেও সে এই বৈদেশিক ঘাঁটি ও স্থাপনাগুলো ব্যবহার করবে।
.
উল্লেখ্য, চীন তার ব্যবহৃত জ্বালানির ৬০ শতাংশের জন্য বিদেশী তেলের উপর নির্ভরশীল। ২০২০ সাল নাগাদ এই নির্ভরশীলতা বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়াবে।
.
পাকিস্তানের মতো যেসব দেশের সঙ্গে চীনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও অভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ আছে সেসব দেশে সে তার নৌবাহিনীর জন্য বাড়তি লজিস্টিক কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা করবে এমন সম্ভাবনাই প্রবল। ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি পিএলএ’র নতুন স্ট্র্যাটেজির অংশ। পাকিস্তানে চীন গোয়াদার বন্দর নির্মাণ করেছে। বন্দরটি আরব সাগরের এমন এক স্ট্র্যাটেজিক জায়গায় অবস্থিত যেটি তেলবাহী ট্যাঙ্কারের ব্যবহৃত সমুদ্র পথ থেকে বেশি দূরে নয়। ভবিষ্যতে এই বন্দরটি চীনা যুদ্ধজাহাজের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
.
তবে আজ অবধি চীন ভারত মহাসাগরে মার্কিন কায়দায় কোন বিদেশী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেনি বা করতে পারেনি। এমন ঘাঁটি গড়া চীনের পক্ষে সহজও হবে না। কারণ কিছু কিছু দেশ পিএলএর মতো বাহিনীকে ঘাঁটি স্থাপন দিতে রাজি হবে না। এ অবস্থায় চীন বিদেশের বাণিজ্যিক বন্দরগুলোতে তার সামরিক বাহিনীর জন্য এমন সব সুযোগ-সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে যেগুলো অপ্রকাশ্য থাকবে। পেন্টাগন রিপোর্টে বলা হয় যে, বর্তমানে ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর লজিস্টিকস্্ ক্ষমতা এমন নয় যে তা দক্ষিণ এশিয়ায় বড় ধরনের যুদ্ধাভিযানের সহায়ক হতে পারে। তবে আরও কিছু নৌঘাঁটি পেলে চীনা নৌবাহিনী তার তৎপরতা প্রসারিত করে সমুদ্রপথের নিরাপত্তা রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। রিপোর্টে দক্ষিণ চীন সাগরে সমুদ্রসীমা বিরোধের ক্ষেত্রে সামরিক ও কূটনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে চীনের জবরদস্তির আশ্রয় নেয়ার কৌশলের কথা উল্লেখ করা হয়।
.
এতে বলা হয় পিএলএ যতই শক্তিশালী হচ্ছে চীনা নেতারা দেশের স্বার্থ হাসিলে ততই সে ধরনের কৌশল অবলম্বনের দিকে যাচ্ছেন সেটাকে সশস্ত্র সংঘাতের কাছাকাছি বলা যেতে পারে। চীনের বর্তমান সামরিক তত্ত্বটিকে সক্রিয় আত্মরক্ষা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এর অর্থ হলো আক্রমণ করা নয় তবে আক্রমণাত্মকভাবে জবাব দেয়া।
.
সেই ২০০৫ সালে পেন্টাগনের এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে চীন বিশ্বের সমুদ্রপথ বরাবর ঘাঁটির একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাছে অবতীর্ণ হয়েছে। এটাকে ‘মুক্তার মালা’ কৌশল নাম দেয়া হয়। ভবিষ্যতের ঘাঁটিগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ চীন সাগরের বিভিন্ন স্থাপনা।
.
পশ্চিম গোলার্ধে কোন সংঘাতে জড়ালে চীন পানামা খালের দুই প্রান্তে এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে চীনা মালিকানাধীন বন্দর স্থাপনাগুলোকে কাজে লাগাতে পারে।
.
নিজের জ্বালানি সরবরাহ পথের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতাই সম্ভব চীনের সামরিক সম্প্রসারণের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। চীন তার সামরিক শক্তিকে সেইসব জায়গায় বিন্যস্ত করছে যাতে করে সঙ্কট বা সংঘাতের সময় জ্বালানির সরবরাহ পথগুলো অক্ষুণœ রাখা যায়।
.
চীনের সামরিক নেতারা জানেন যে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে অতি উন্নতমানের নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্র আছে। সেই সঙ্গে তারা প্রোম্পট গ্লোবাল স্ট্রাইক নামে দূরপাল্লার দ্রুত আক্রমণের সময় এমন অস্ত্র উদ্ভাবন করছে, যেটি দিয়ে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে বিশ্বের যে কোন টার্গেটের উপর আঘাত হানা যায়। তার মানে সংঘাতের সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনের তেল ও জ্বালানি স্থাপনা এবং সরবরাহ লাইন ধ্বংস করে দিয়ে দেশটিকে পঙ্গু করে দিতে পারে। সে জন্যই জ্বালানি সরবরাহের পথগুলো রক্ষা করতে চীন এত মরিয়া।
.
এনামুল হক , ইত্তেফাক

 

Leave a Reply

স্যার, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

Click one of our representatives below

Customer Support
Customer Support

Syeda Nusrat

I am online

I am offline

Technical Support
Technical Support

Ariful Islam Aquib

I am online

I am offline